সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ
সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ বলতে একটি রাজনৈতিক দর্শন বা ভাবাদর্শকে বোঝায় যার আলোচ্যসূচিতে বলা হয় যে ধর্ম, ভাষা, সামাজিক শ্রেণী বা জনগণের অন্য কোনও শ্রেণীর ভিত্তিতে যদি একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থাকে, তাহলে সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সমাজে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার প্রাধান্যের অধিকার থাকে এবং সমাজের উপর প্রভাব বিস্তারকারী সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার থাকে। এই ঐতিহ্যবাহী দৃষ্টিভঙ্গিটি উত্তরোত্তর অধিকতর সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে এবং উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলিতে উত্তরোত্তর অধিক হারে সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোটের কাজের সীমা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে, যাতে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকে।[১] যেসব নির্বাচনী ব্যবস্থাতে কেবলমাত্র তুলনামূলক সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের ভিত্তিতে প্রার্থীদের বিজয় নির্ধারিত হয়, তার সাথে প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠতার (শতকরা ৫০ ভাগের বেশি ভোট) পার্থক্য আছে। ঐসব ব্যবস্থাকে কদাচিৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক ব্যবস্থা বলে ডাকা হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এগুলি সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নয়, বরং তুলনামূলক সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের ভিত্তিতে বিজয়ী নির্বাচন করে। কিছু কিছু নির্বাচনী ব্যবস্থা যেমন দ্রুত-মীমাংসাকারক ভোটদান ব্যবস্থাতে গণনাকৃত ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা বিজয়ীকে নির্বাচন করা হয়, তবে সর্বদা নয়। কোনও সংসদ বা আইনসভা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের অধিকারী কোনও দলকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করে, তাহলে সেটিকে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী সংসদ বলে ডাকা হতে পারে। যুক্তরাজ্যসহ আরও বেশ কিছু দেশের আইনসভা এর উদাহরণ।
একটি গণতান্ত্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী রাজনৈতিক কাঠামোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল কোনও সংখ্যালঘু দলকে ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে অংশগ্রহণ থেকে বাদ দেয় না। সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদকে কখনও কখনও এর বিরোধিতাকারী সমালোচকেরা নেতিবাচক অর্থে "উচ্ছৃঙ্খল গণশাসন" বা "সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরশাসন" হিসেবে নির্দেশ করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদকে প্রায়শই সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হিসেবে ডাকা হয়, যা দিয়ে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ সামাজিক শ্রেণীর দ্বারা একটি সংখ্যালঘু সামাজিক শ্রেণীর উপর শাসন করাকে বোঝানো হতে পারে। তবে এর সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠের নিয়ম নামক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন বলতে এমন বিশ্বাসকে বোঝায়, যা অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় ইচ্ছামত যেকোনও উপায়ে দেশ শাসন করতে পারে। তবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা সম্প্রদায়গুলির সক্রিয় বি-ক্ষমতায়নের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের অধিকার হিসেবে যা দাবি করা হয়, তা শুধুমাত্র ভোটারদের এক সংখ্যালঘু অংশমাত্র দ্বারা সমর্থিত হয়ে থাকে।
সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের সপক্ষে ওকালতিকারীরা এই যুক্তি দেন যে সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর যেকোন ধরনের সীমা বেঁধে দেওয়া সহজাতভাবেই অগণতান্ত্রিক। যদি কোনও গণতন্ত্র এমন একটি সংবিধান দ্বারা সীমায়িত থাকে, যে সংবিধানকে একটি সরল সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্ত দ্বারা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, তাহলে বিগতকালের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে বর্তমান কালের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অপেক্ষা বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। যদি এটিকে কোনও ছোট দল যেমন অভিজাত শ্রেণী, বিচারক, সেনা বা দার্শনিকদের দ্বারা সীমায়িত করা হয়, তাহলে সমাজ একটি সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্র বা সংখ্যাল্পের শাসনে পরিণত হয়। একটি সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী ব্যবস্থাতে একমাত্র গ্রহণযোগ্য নিয়ন্ত্রণ-সীমা হল এই যে বর্তমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দলটি ভবিষ্যতে ভিন্ন একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের উদয় প্রতিরোধ করার কোনও অধিকার রাখে না।
সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের বিরোধীদের একটি নেতিবাচক সমালোচনা অনুযায়ী যেসব ব্যবস্থাতে নিয়ম বদলের জন্য অতি-সংখ্যাগরিষ্ঠতার শর্ত নেই, সেগুলি সাধারণত স্থিতিশীল হয় না।[২] অধিকন্তু অনেক সিদ্ধান্তই তুলনামূলক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা গৃহীত হয়, প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়, যদি না এমন একটি ভোটদান ব্যবস্থা থাকে, যেখানে পছন্দ মাত্র দুইটিতে সীমাবদ্ধ থাকে, যেমন সাপেক্ষ ভোটদান (Contingent voting), দুই দফায় ভোটদান এবং দ্রুত মীমাংসাকারক ভোটদান (Instant-runoff voting)।[৩] গিবার্ডের উপপাদ্য ও অ্যারো-র কূটাভাস অনুযায়ী দুইয়ের বেশি পছন্দযুক্ত কোনও ভোটদান ব্যবস্থা "ন্যায্যতা" এবং যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ - এই দুইটি মানদণ্ডকে একত্রে পূরণ করতে পারে না।[৩][৪] এছাড়া অসংযত, অনিয়ন্ত্রিত সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ সংখ্যালঘুদের অধিকারের জন্য হুমকি হতে পারে।[৫]
কিছু কিছু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে এই সমস্যাটিকে সমাধান করার উদ্দেশ্যে মৌলিক অধিকারগুলিতে যেকোনও পরিবর্তনের জন্য অতি-সংখ্যাগরিষ্ঠতা আবশ্যক করা হয়েছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে বাকস্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারগুলিকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, যার অর্থ এই অধিকারগুলি বাতিল করতে হলে কংগ্রেস বা আইনসভার সরল সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেয়েও বেশিসংখ্যক সদস্যের সমর্থন লাগবে।[৬] অন্যান্য গণতন্ত্রগুলিতে সমানুপাতিক ভোটদান ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়, যেমনটি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে পরিলক্ষিত হয়।[৭][৮] এই পদ্ধতিগুলি আদৌ সংখ্যালঘুদের স্বার্থকে সুরক্ষাদানে সফল হয়েছে কি না, সে ব্যাপারটি এখনও বিতর্কিত।[৯]
আরও দেখুন
সম্পাদনা- বহুজন অনুসারী যুক্তি
- সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনুসারী যুক্তি
- সংঘক্রিয়াবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ
- ঐকমত্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ
- ঐকমত্যভিত্তিক গণতন্ত্র
- সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক গণতন্ত্র
- সংখ্যালঘুবাদ (বিপরীত ধারণা)
- সংখ্যালঘুর অধিকার
- উচ্ছৃঙ্খল গণশাসন
- লোকায়ত গণতন্ত্র
- জনতুষ্টিবাদ
- সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরশাসন
- উপযোগবাদী নীতিশাস্ত্র
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ A Przeworski, JM Maravall, I NetLibrary Democracy and the Rule of Law (2003) p. 223
- ↑ Salvador, Barbera; Jackson, Matthew O. (২০০৪)। "Choosing How to Choose: Self-Stable Majority Rules and Constitutions"। Quarterly Journal of Economics। 119 (3): 1011–48। ডিওআই:10.1162/0033553041502207। সাইট সিয়ারX 10.1.1.490.6553 ।
- ↑ ক খ Riker, William (১৯৮৮) [First published in 1982]। Liberalism Against Populism। Prospect Heights, Illinois: Waveland Press। আইএসবিএন 978-0-88133-367-1।
- ↑ Reny, Philip J. (২০০১-০১-০১)। "Arrow's theorem and the Gibbard-Satterthwaite theorem: a unified approach"। Economics Letters (ইংরেজি ভাষায়)। 70 (1): 99–105। আইএসএসএন 0165-1765। ডিওআই:10.1016/S0165-1765(00)00332-3।
- ↑ ULRICH, SIEBERER; DUTKOWSKI, JULIA; MEIßNER, PETER; MÜLLER, WOLFGANG (অক্টোবর ১৮, ২০১৯)। "'Going institutional' to overcome obstruction: Explaining the suppression ofminority rights in Western European parliaments, 1945–2010"। European Journal of Political Research। 59 (4): 731–975। এসটুসিআইডি 214451776। ডিওআই:10.1111/1475-6765.12376 ।
- ↑ "Full Text of the U.S. Constitution | Constitution Center"। National Constitution Center – constitutioncenter.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-২০।
- ↑ "What is MMP?"। Elections (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-২০।
- ↑ Bowler, Shaun; Grofman, Bernard, সম্পাদকগণ (২০০০)। Elections in Australia, Ireland, and Malta under the Single Transferable Vote: Reflections on an Embedded Institution। University of Michigan Press। আইএসবিএন 978-0-472-11159-6। জেস্টোর 10.3998/mpub.16507। ডিওআই:10.3998/mpub.16507।
- ↑ McGann, Anthony J. (২০০২-১০-০১)। "The Tyranny of the Super-Majority: How Majority Rule Protects Minorities" (ইংরেজি ভাষায়)।