শ্রবণশক্তি হানি

শ্রবণেন্দ্রিয়ের এক ধরনের বিকার
(শ্রবণশক্তিহানি থেকে পুনর্নির্দেশিত)

শ্রবণশক্তি হানি বা শ্রুতিহানি বলতে কানে শোনা বা শ্রবণ করার আংশিক বা পূর্ণ অক্ষমতাকে বোঝায়।[] শ্রবণশক্তি হানি জন্মের সময়েই উপস্থিত থাকতে পারে কিংবা পরবর্তী জীবনে যেকোনও মুহূর্তে অর্জিত হতে পারে।[][] শ্রবণশক্তি হানি এক বা দুই কানেই ঘটতে পারে।[] শিশুদের ক্ষেত্রে শ্রবণশক্তির সমস্যা ভাষা অর্জন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে এটি সামাজিক আন্তঃক্রিয়া ও পেশাদারি কাজকর্মে ঝামেলার সৃষ্টি করতে পারে।[] শ্রবণশক্তি হানি সাময়িক বা স্থায়ী হতে পারে। বার্ধক্যজনিত কারণে শ্রবণশক্তি হানি সাধারণত দুই কানেই ঘটে থাকে; মূলত কর্ণকম্বুস্থ কেশকোষ হানির কারণে এটি ঘটে।[] কিছু ব্যক্তি, বিশেষ করে বৃদ্ধ বা প্রবীণ ব্যক্তিরা শ্রবণশক্তি হানির কারণে নিঃসঙ্গতায় ভুগতে পারেন।[] বধির ব্যক্তিদের সাধারণত খুবই কম শ্রবণশক্তি থাকে বা একেবারেই থাকে না।[]

শ্রবণশক্তি হানি
প্রতিশব্দবধির, কালা; পূর্ণ বধিরত্ব[]
একটি প্রতীকী সাদা রঙের কান, যাকে ঘিরে দুইটি সাদা দণ্ড, পেছনে নীল পটভূমি
বধিরতা ও শ্রবণশক্তি হানির আন্তর্জাতিক প্রতীক
বিশেষত্বকর্ণ-নাসা-স্বরযন্ত্রবিজ্ঞান, শ্রুতিবিজ্ঞান
লক্ষণশোনার ক্ষমতা (শ্রবণশক্তি) হ্রাস
জটিলতাসামাজিক বিচ্ছিন্নকরণ,[] চিত্তভ্রংশ
প্রকারভেদসংবাহী, বেদন-স্নায়বিক, মিশ্র শ্রবণশক্তি হানি, কেন্দ্রীয় শ্রুতিবিকার[]
কারণবংশগতি, জরাগ্রস্ততা, অপধ্বনির সংস্পর্শ, কিছু জীবাণু সংক্রমণ, জন্মকালীন জটিলতা, কানে আঘাত, কিছু ঔষধ ও বিষাক্ত পদার্থ[]
রোগনির্ণয়ের পদ্ধতিশ্রবণশক্তি পরীক্ষা
প্রতিরোধটিকাদান, গর্ভাবস্থাকালীন সঠিক যত্ন, উচ্চ অপধ্বনি এড়িয়ে চেলা, কিছু ঔষধ এড়িয়ে চলা[]
চিকিৎসাশ্রবণ সহায়ক যন্ত্র, ইশারা ভাষা, কর্ণকম্বু প্রোথ, উপাখ্যা[]
সংঘটনের হার১৮৮ কোটি / ১৮.৫% (২০১৫)[]

শ্রবণশক্তি হানি বেশ কিছুসংখ্যক কারণে হতে পারে, যাদের মধ্যে আছে: বংশগতি, জরাগ্রস্ততা (বুড়িয়ে যাওয়া), অপধ্বনির সংস্পর্শ, কিছু রোগজীবাণুর সংক্রমণ, জন্মকালীন জটিলতা, কানে আঘাত, এবং কিছু ঔষধ ও বিষাক্ত পদার্থ সেবন।[] শ্রবণশক্তির একটি সাধারণ কারণ হল দীর্ঘমেয়াদী কর্ণ সংক্রমণ[] গর্ভাবস্থায় কিছু জীবাণু সংক্রমণ, যেমন সাইটোমেগালোভাইরাস, সিফিলিসরুবেলা, ইত্যাদি শিশুর মধ্যে শ্রবণশক্তি হানির কারণ হতে পারে।[][১০] যখন শ্রবণশক্তি পরীক্ষাতে কোনও ব্যক্তি অন্তত একটি কানে ২৫ ডেসিবেল মাত্রার ধ্বনি শুনতে অক্ষম প্রমাণিত হন, তখন তার শ্রবণশক্তি হানি নির্ণীত হয়।[] সমস্ত নবজাতকের জন্য দুর্বল শ্রবণশক্তির পরীক্ষার সুপারিশ করা হয়।[] শ্রবণশক্তি হানির মাত্রাকে মৃদু (২৫ থেকে ৪০ ডেসিবেল), মধ্যম (৪১ থেকে ৫৫ ডেসিবেল) এবং মধ্যম-গুরুতর (৫৬ থেকে ৭০ ডেসিবেল), গুরুতর (৭১ থেকে ৯০ ডেসিবেল) ও অতিগুরুতর (৯০ ডেসিবেলের বেশি) - এইরূপে শ্রেণীবিভক্ত করা হয়।[] মূলত তিন প্রকারের শ্রবণশক্তি হানি হয়ে থাকে: সংবাহী, বেদন-স্নায়বিক ও মিশ্র শ্রবণশক্তি হানি[]

বৈশ্বিকভাবে প্রায় অর্ধেকসংখ্যক শ্রবণশক্তি হানির ঘটনা জনস্বাস্থ্য প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব।[] এই প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা মধ্যে আছে টিকাদান, গর্ভাবস্থাকালীন সঠিক যত্ন, উচ্চ অপধ্বনি এড়িয়ে চলা ও কিছু বিশেষ ঔষধ পরিহার।[] বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশমতে তরুণ-তরুণীদের উচ্চধ্বনির সংস্পর্শে আসা সীমিত করা উচিত এবং ব্যক্তিগত ধ্বনিবাদক যন্ত্র ব্যবহারের পরিমাণ দৈনিক ১ ঘণ্টার সীমাবদ্ধ রাখা উচিত, যাতে অপধ্বনির সাথে সংস্পর্শে আসা সীমিত করা যায়।[১১] শিশুদের ক্ষেত্রে অবিলম্ব শনাক্তকরণ ও সহায়তা প্রদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।[] বহু ব্যক্তির জন্য শ্রবণ সহায়ক যন্ত্র, ইশারা ভাষা, কর্ণকম্বু প্রোথউপাখ্যার ব্যবহার উপকারী হতে পারে।[] কেউ কেউ ঠোঁটের ভাষা পড়ার দক্ষতা অর্জন করাকে উপকারী মনে করেন।[] তবে বিশ্বের বহু অঞ্চলেই শ্রবণসহায়ক যন্ত্র সুলভ নয়।[]

২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় ১১০ কোটি ব্যক্তি কমবেশি মাত্রায় শ্রবণশক্তি হানির শিকার।[১২] শ্রবণশক্তি হানি প্রায় ৪৬ কোটি ৬০ লক্ষ ব্যক্তির (বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ৫%) জন্য পূর্ণ প্রতিবন্ধিতার সৃষ্টি করে এবং আরও প্রায় ১২ কোটি ৪০ লক্ষ ব্যক্তির জন্য মৃদু থেকে গুরুতর প্রতিবন্ধিতার কারণ।[][১৩][১৪] শেষোক্ত মৃদু থেকে গুরুতর শ্রবণশক্তি হানির শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ১০ কোটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে বাস করে।[১৩] প্রায় ৬ কোটি ৫০ লক্ষ ব্যক্তি জন্ম থেকেই শ্রবণশক্তি হানির শিকার।[১৫] যারা ইশারা ভাষায় কথা বলেন এবং যারা বধির সংস্কৃতির সদস্য, তারা নিজেদেরকে অক্ষমতার শিকার না ভেবে ভিন্ন সক্ষমতাবিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করতে পারে।[১৬] বধির সংস্কৃতির বহু সদস্য বধিরতা থেকে আরোগ্যলাভের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করে।[১৭][১৮][১৯] এই সম্প্রদায়ের কিছু কিছু ব্যক্তি কর্ণকম্বু প্রোথকে উদ্বেগজনক মনে করেন, কেননা এগুলি বধির সংস্কৃতিকে শেষ করে দিতে পারে।[২০] শ্রবণশক্তি হানি পরিভাষাটিকে প্রায়শই নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, কেননা এটিতে কোনও কিছু করার অক্ষমতার উপরে জোর দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও চিকিৎসাবৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপটে এই পরিভাষাটিই এখনও নিয়মিত ব্যবহৃত হয়ে থেকে।[১৬][২১]

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Elsevier, Dorland's Illustrated Medical Dictionary, Elsevier, ১১ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ২৫ ডিসেম্বর ২০২২. 
  2. ঝাঁপ দিন: "Deafness and hearing loss Fact sheet N°300"। World Health Organization। মার্চ ২০১৫। Archived from the original on ১৬ মে ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ২৩ মে ২০১৫ 
  3. ঝাঁপ দিন: Shearer AE, Hildebrand MS, Smith RJ (২০১৪)। "Deafness and Hereditary Hearing Loss Overview"। Adam MP, Ardinger HH, Pagon RA, Wallace SE, Bean LJ, Stephens K, Amemiya A। GeneReviews [Internet]। Seattle (WA): University of Washington, Seattle। পিএমআইডি 20301607 
  4. । Global Burden of Disease Study 2015 Collaborators। "Global, regional, and national incidence, prevalence, and years lived with disability for 310 diseases and injuries, 1990-2015: a systematic analysis for the Global Burden of Disease Study 2015"Lancet388 (10053): 1545–1602। অক্টোবর ২০১৬। ডিওআই:10.1016/S0140-6736(16)31678-6পিএমআইডি 27733282পিএমসি 5055577  
  5. "Deafness"Encyclopædia Britannica Online। Encyclopædia Britannica Inc.। ২০১১। ২০১২-০৬-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০২-২২ 
  6. ঝাঁপ দিন: "Deafness and hearing loss"World Health Organization (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২০-০৩-০১। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-১৩ 
  7. "Hearing Loss at Birth (Congenital Hearing Loss)"American Speech-Language-Hearing Association (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-১৩ 
  8. ঝাঁপ দিন: Lasak JM, Allen P, McVay T, Lewis D (মার্চ ২০১৪)। "Hearing loss: diagnosis and management"। Primary Care41 (1): 19–31। ডিওআই:10.1016/j.pop.2013.10.003পিএমআইডি 24439878 
  9. Schilder, Anne Gm; Chong, Lee Yee; Ftouh, Saoussen; Burton, Martin J. (২০১৭)। "Bilateral versus unilateral hearing aids for bilateral hearing impairment in adults"The Cochrane Database of Systematic Reviews2017 (12): CD012665। আইএসএসএন 1469-493Xডিওআই:10.1002/14651858.CD012665.pub2পিএমআইডি 29256573পিএমসি 6486194  
  10. Fowler KB (ডিসেম্বর ২০১৩)। "Congenital cytomegalovirus infection: audiologic outcome"Clinical Infectious Diseases। 57 Suppl 4 (suppl_4): S182–4। ডিওআই:10.1093/cid/cit609পিএমআইডি 24257423পিএমসি 3836573  
  11. "1.1 billion people at risk of hearing loss WHO highlights serious threat posed by exposure to recreational noise" (পিডিএফ)who.int। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫। ১ মে ২০১৫ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০১৫ 
  12. । Global Burden of Disease Study 2013 Collaborators। "Global, regional, and national incidence, prevalence, and years lived with disability for 301 acute and chronic diseases and injuries in 188 countries, 1990-2013: a systematic analysis for the Global Burden of Disease Study 2013"Lancet386 (9995): 743–800। আগস্ট ২০১৫। ডিওআই:10.1016/s0140-6736(15)60692-4পিএমআইডি 26063472পিএমসি 4561509  
  13. ঝাঁপ দিন: The global burden of disease: 2004 update (পিডিএফ)। Geneva, Switzerland: World Health Organization। ২০০৮। পৃষ্ঠা 35। আইএসবিএন 9789241563710। ২০১৩-০৬-২৪ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। 
  14. Olusanya BO, Neumann KJ, Saunders JE (মে ২০১৪)। "The global burden of disabling hearing impairment: a call to action"Bulletin of the World Health Organization92 (5): 367–73। ডিওআই:10.2471/blt.13.128728পিএমআইডি 24839326পিএমসি 4007124  
  15. Elzouki, Abdelaziz Y (২০১২)। Textbook of clinical pediatrics (2 সংস্করণ)। Berlin: Springer। পৃষ্ঠা 602। আইএসবিএন 9783642022012। ২০১৫-১২-১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।  অজানা প্যারামিটার |name-list-style= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
  16. ঝাঁপ দিন: "Community and Culture - Frequently Asked Questions"nad.org। National Association of the Deaf। ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জুলাই ২০১৪ 
  17. "Sound and Fury - Cochlear Implants - Essay"www.pbs.orgPBS। ২০১৫-০৭-০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৮-০১ 
  18. "Understanding Deafness: Not Everyone Wants to Be 'Fixed'"www.theatlantic.comThe Atlantic। ২০১৩-০৮-০৯। ২০১৫-০৭-৩০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৮-০১ 
  19. Williams, Sally (২০১২-০৯-১৩)। "Why not all deaf people want to be cured"www.telegraph.co.ukThe Daily Telegraph। ২০১৫-০৯-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৮-০২  অজানা প্যারামিটার |name-list-style= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
  20. Sparrow, Robert (২০০৫)। "Defending Deaf Culture: The Case of Cochlear Implants" (পিডিএফ)The Journal of Political Philosophy13 (2): 135–152। ডিওআই:10.1111/j.1467-9760.2005.00217.x। সংগ্রহের তারিখ ৩০ নভেম্বর ২০১৪  অজানা প্যারামিটার |name-list-style= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
  21. Tidy, Colin (মার্চ ২০১৪)। "Dealing with Hearing-impaired Patients"patient.info (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০২০ 

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা
শ্রেণীবিন্যাস
বহিঃস্থ তথ্যসংস্থান