শেকলের যুদ্ধ
শেকলের যুদ্ধ[৪] রাশিদুন খিলাফত ও সাসানীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে সংঘটিত প্রথম যুদ্ধ। রিদ্দার যুদ্ধের পর কাজিমায় (বর্তমান কুয়েতে অবস্থিত) এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
শেকলের যুদ্ধ | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
মূল যুদ্ধ: মুসলিমদের পারস্য বিজয় | |||||||
বর্তমান কুয়েত ও ইরাকে কাজিমা, উবালা ও হুফাইরের অবস্থান | |||||||
| |||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||
রাশিদুন খিলাফত |
সাসানীয় সাম্রাজ্য খ্রিষ্টান আরব মিত্রবাহিনী | ||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
খালিদ বিন ওয়ালিদ আল-কাকা ইবনে আমর আত-তামিমি আদি ইবনে হাতিম |
হরমুজদ †[৩] কুবাদ আনোশাগান | ||||||
শক্তি | |||||||
১৮,০০০ | ৮০,০০০(প্রাথমিক সূত্র) ১৭,০০০ (আধুনিক সূত্র) | ||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||
স্বল্প | অসংখ্য |
পটভূমি
সম্পাদনামুসান্না ইবনে হারিসা শাইবানি ছিলেন পুর বারবের গোত্রপ্রধান। তার এলাকা পারস্য সীমান্তের কাছে ছিল। রিদ্দার যুদ্ধের পর মুসান্না পারস্যদেশীয় শহরে অভিযান চালান। এসকল অভিযান সফল হয় এবং প্রচুর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ অর্জিত হয়। তিনি নিজের সাফল্য নিয়ে আবু বকরকে অবহিত করেন এবং আবু বকর তাকে তার লোকেদের নেতা নিযুক্ত করেন। এরপর মুসান্না ইরাকের অভ্যন্তরে অভিযান চালান। তার হালকা অশ্বারোহি বাহিনীর দ্রুতগামীতা ব্যবহার করে তিনি মরুভূমির নিকটবর্তী শহরে হামলা করে পুনরায় মরুভূমিতে ফিরে আসতে পারতেন। ফলে সাসানীয় বাহিনী তাকে ধরতে সক্ষম হত না। পরবর্তীতে আবু বকর ইরাক জয়ের সিদ্ধান্ত নেন। আবু বকর তার সেরা সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদকে এ জন্য দায়িত্ব প্রদান করেন। ইয়ামামার যুদ্ধে মুসাইলিমাকে পরাজিত করার পর আবু বকর তাকে পারস্যে অভিযানের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি আবু বকর উত্তরপূর্ব আরবের গোত্রীয় নেতা মুসান্না ইবনে হারিসা, মাজহুর বিন আদি, হারমালা ও সুলমাকে খালিদের নেতৃত্বে কাজের নির্দেশ দেন। ৬৩৩ সালের মার্চের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে খালিদ ইমামা থেকে ১০,০০০ সৈনিকের বাহিনী নিয়ে অভিযানে বের হন। এর পূর্বে তিনি পারস্যের সীমান্তবর্তী দাস্ত মাইসানের গভর্নর হরমুজদকে চিঠি লিখে জানান:
“ | ইসলাম গ্রহণ করুন ও নিরপাওদ থাকুন। অথবা জিজিয়া দিতে রাজি হোন এবং আপনি ও আপনার জনগণ আমাদের নিরাপত্তায় থাকবেন, নতুবা ফলাফলের জন্য আপনি শুধু আপনাকে দায়ী করবেন, কারণ আমি এমন লোকদের নিয়ে এসেছি যারা মৃত্যুকে এতটাই আকাঙ্ক্ষা করে যতটা আপনি জীবনকে আকাঙ্ক্ষা করেন।[৫] | ” |
গোত্রনেতারা ও তাদের প্রত্যেকের ২,০০০ যোদ্ধা খালিদের দলে যোগ দেয়। ফলে খালিদ ১৮,০০০ সৈনিক নিয়ে পারস্য সাম্রাজ্যে প্রবেশ করেন।[৫] পারসিকেরা সম্রাটকে এই অভিযান নিয়ে অবহিত করে এবং যুদ্ধের জন্য সেনা সমাবেশ শুরু করে। তাদের দলে খ্রিষ্টান আরব সৈনিকরাও যোগ দিয়েছিল।
খালিদের কৌশল
সম্পাদনাসাসানীয় সেনাবাহিনী ছিল তৎকালীন অন্যতম শক্তিশালী ও অস্ত্রসমৃদ্ধ সেনাবাহিনী। তবে দ্রুতগামীর বিষয়ে তাদের দুর্বলতা ছিল। পারসিকদের ভারি অস্ত্রে সজ্জিত হওয়ায় তারা দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরতে পারত না। অন্যদিকে খালিদের বাহিনীর দ্রুতগামীতা ছিল পারসিকদের চেয়ে বেশি। তারা উটে করে অগ্রসর হয় এবং অশ্বারোহী আক্রমণের জন্য ঘোড়া প্রস্তুত রাখে। খালিদ এই দ্রুততাকে পারসিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে উদ্যোগী হন। এলাকার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য খালিদকে তার কৌশল বাস্তবায়নে সহায়তা করেছিল। উবালা যাওয়ার দুইটি রাস্তা ছিল। এর একটি কাজিমা ও অন্যটি হুফাইর হয়ে যেত। তাই খালিদ ইয়ামামা থেকে হরমুজদকে চিঠি লেখেন যাতে হরমুজদ্দের ধারণা হয় যে খালিদ ইয়ামামা থেকে সরাসরি কাজিমার পথ ধরে উবালা আসবেন।
যুদ্ধ
সম্পাদনাখালিদ কাজিমার পথ ধরে আসবেন ধারণা করে হরমুজদ উবালা থেকে কাজিমার দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু কাজিমায় তারা মুসলিমদের কোনো চিহ্ন খুজে পায়নি। শীঘ্রই গোয়েন্দাদের খবর দেয় যে খালিদ হুফাইরের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। উবালা থেকে হুফাইরের দূরত্ব ছিল ২১ মাইল। ফলে হরমুজদের শিবির অরক্ষিত অবস্থায় ছিল। এছাড়া এটি সাসানীয় সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল। অবস্থা বিবেচনা করে হরমুজদ ৫০ মাইল দূরে হুফাইরের দিকে অগ্রসর হন। হরমুজদের পদক্ষেপ নিয়ে গোয়েন্দাদের খবর না পাওয়া পর্যন্ত খালিদ হুফাইরে অবস্থান করছিলেন। এরপর তিনি মরুভূমির মধ্য দিয়ে কাজিমা আসেন। হরমুজদ হুফাইরে এসে খালিদের কাজিমা যাত্রার কথা জানতে পারেন। কাজিমার পথ মুসলিমদের হস্তগত না হওয়ার জন্য পুনরায় সাসানীয় বাহিনী কাজিমের উদ্দেশ্যে বের হয়।
হরমুজদ তার বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে সমবেত করেন। পার্শ্বভাগের নেতৃত্বে ছিলেন কুবাজ ও আনোশাগান। সৈনিকরা যাতে পরাজয়ের মুহূর্তে পালিয়ে না যায় সেজন্য তারা নিজেদেরকে শেকল দিয়ে বেঁধে ফেলে। শেকল দ্বারা আবদ্ধ হওয়ার ফলে প্রতিপক্ষের অশ্বারোহী হামলা প্রতিহত করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কারণ এর ফলে অশ্বারোহীরা হামলা চালিয়ে বেশিদূর প্রবেশ করতে সক্ষম ছিল না। তবে শেকলের কারণে সৈনিকরা প্রয়োজনে পিছু হটতে পারেনি। শেকলের ব্যবহারের ফলে এই যুদ্ধের এরূপ নাম হয়েছে।[৬] হরমুদ কাজিমার পশ্চিম প্রান্তের সম্মুখে তার সেনাদের সমবেত করেছিলেন। খালিদ পেছনে মরুভূমি রেখে অবস্থান নেন যাতে পরাজয় ঘটলে পিছু হটার পথ পাওয়া যায়। ক্লান্ত অবস্থায় পারসিক সেনারা দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়নি। মুসলিমরা সফলভাবে তাদের উপর হামলা চালায়। পরাজয় আসন্ন অবস্থায় পারসিকদের পার্শ্বভাগের সেনাপতি কুবাজ ও আনোশাগান সৈনিকদের পিছু হটার নির্দেশ দেন। নিজেদের শেকল দ্বারা আবদ্ধ না করা সৈনিকরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু আবদ্ধদের অনেকে নিহত হয়।
পরবর্তী অবস্থা
সম্পাদনাশেকলের যুদ্ধের পর খালিদ পারসিক বাহিনীকে আরো কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত করে আল-হিরা জয় করেন। পারস্যে প্রথম মুসলিম বিজয়টি চার মাসের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছিল। পরবর্তীতে আবু বকর খালিদকে সিরিয়া জয়ের নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Parvaneh Pourshariati, The Decline and Fall of the Sasanian Empire, (I.B. Tauris, 2011), 193.
- ↑ "Chapter 19: The Battle of Chains"।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ Parvaneh Pourshariati, The Decline and Fall of the Sasanian Empire, 193.
- ↑ Parvaneh Pourshariati, The Decline and Fall of the Sasanian Empire, 192.
- ↑ ক খ Tabari: Vol. 2, p. 554.
- ↑ Tabari: Vol. 3, p. 206.