শতরঞ্জি
শতরঞ্জি বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী কারুপণ্য। প্রায় ৭০০ বছরের প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে এই কারুপণ্যের। মূলত আসন, শয্যা ও দেয়াল মাদুর হিসেবে শতরঞ্জি ব্যবহৃত হয়। শতরঞ্জিকে রংপুর অঞ্চলের মানুষ বিত্ত ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য করে। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম হস্তশিল্পজাত রপ্তানীপণ্য। বাংলাদেশ বিশ্বের প্রায় ৫০টির অধিক দেশে শতরঞ্জী রপ্তানী করে থাকে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিকট হতে (১৭ জুন, ২০২১) রংপুরের শতরঞ্জি বাংলাদেশের একটি ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।[১]
শতরঞ্জি | |
---|---|
ভৌগোলিক নির্দেশক | |
বর্ণনা | সুতা, পাট, উল জাতীয় ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের তন্তু রং করে তা হতে সুতার বান্ডিল তৈরি করে শতরঞ্জি তাঁতে বা মেঝেতে বিছিয়ে নকশা অনুযায়ী হাতে বোনা হয়। |
ধরন | হস্তশিল্প |
অঞ্চল | রংপুর |
দেশ | বাংলাদেশ |
নথিবদ্ধ | ২০২১ |
উপাদান | সুতা, পাট, উল |
প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইট | পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর |
ইতিহাস
সম্পাদনাশতরঞ্জির ঐতিহাসিক সূত্র প্রায় ৭০০ বছরের পুরোনো। স্থানীয় ভাষ্যমতে, মোঘল আমল থেকেই রংপুরে শতরঞ্জি তৈরি হতো। আবার এখানে যারা শতরঞ্জি তৈরিতে নিয়োজিত তারা শুধু বলতে পারেন তাদের পেশা বংশ পরম্পরায় এসেছে। তাদের পিতা-পিতামহরা একই পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ফলে এটুকু অনুমান করা যায় যে, এ দেশে শতরঞ্জির শেকড় প্রোথিত হয়েছে অনেক আগেই। তবে ১৮৩০ সালে মিস্টার নিসবেত নামক জনৈক ব্রিটিশ কালেক্টর রঙ্গপুর নগরের শহরতলী পীরপুর গ্রামে ( বর্তমান নিসবেতগঞ্জ ) গিয়ে শতরঞ্জী দেখে মুগ্ধ হন। তিনি শতরঞ্জীর প্রচারে ব্যাপক অবদান রাখেন। তাঁর সম্মানে আজো এলাকাটির নাম নিসবেতগঞ্জ।[২] সে সময় শতরঞ্জি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায় এবং বিভিন্ন স্থানে রপ্তানীও হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে সমগ্র ভারত, শ্রীলংকা, মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া সহ নানা দেশে প্রচুর শতরঞ্জি বিক্রি হতো
।[৩] মূলত ভারত বিভাগের পরেই শতরঞ্জি ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। কিছু পূর্বেও বাংলাদেশে এটি বিলুপ্ত প্রায় হয়ে গিয়েছিল। তবে গত কয়েক দশক ধরে রংপুরের কারুপণ্য নামক সংস্থাটি এই শিল্প বৃহৎ আকারে ফিরিয়ে এনেছে এবং এটি বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম একটি রপ্তানীযোগ্য হস্তশিল্পজাত পণ্য।
বুননশৈলী
সম্পাদনাশতরঞ্জির বুননশৈলী সম্পূর্ণ আধুনিকতামুক্ত একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এর মূল উপাদান সুতা। বাঁশ এবং রশি দিয়ে ছোট বড় চরকার মাধ্যমে সুতা দিয়ে টানা প্রস্তত করে প্রতিটি সুতা গণনা করে জ্যামিতিক মাপে হাত দিয়ে গ্রাম্য বুনন শিল্পীরা নিজস্ব মননে নকশা করা শতরঞ্জী তৈরী করেন।[২]
নকশা
সম্পাদনাশতরঞ্জি তৈরিতে সাধারণত দুই ধরনের মোটিফ নকশায় ব্যবহার করা হয়। একটি প্রাচীন বা ঐতিহ্যবাহী নকশা এবং অপরটি আধুনিক নকশা। প্রাচীন নকশাগুলো হলো হাতির পা, জাফরি, ইটকাঠি, নাটাই, রাজা-রানি, দেব-দেবী, প্রজাপতি, ঘুড়ি, নারীর মুখ, রাখাল বালক, কলসী কাঁখে রমণী, বাঘবন্ধি, পালকি, মোড়া ফুল, জামরুল পাতা, রথ পাড়ি, দাবারঘর, লাইট, পৌরাণিক চরিত্র, নবান্ন, পৌষপার্বণ, প্রাকৃতিক দৃশ্য ইত্যাদি।আধুনিক নকশার মধ্যে আছে পুষ্পিতপাতা, পানপাতা, কাবাঘর, মসজিদ-মিনার, মাছ, পাখি, নৌকা, গ্রামের দৃশ্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বুটিদার জরি ও তেরছি নকশা, বিবি রাসেলের উদ্ভাবিত নকশা ইত্যাদি। নকশায় লাল, কালো বা নীল রঙের প্রাধান্য দেয়া হয়। অন্যান্য রঙের সুতাও ব্যবহার করা হয়। শতরঞ্জির নকশা হাতে বুনা হয় যার ফলে দুই পাশ থেকে নকশা দেখতে একই রকম হয় এবং এর কোনো উল্টো-সোজা নেই। [৪]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "জিআই সনদ পেলো আরও ছয় পণ্য, ইত্তেফাক, ১৮ জুন ২০২১"। ১৮ জুন ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুন ২০২১।
- ↑ ক খ বাংলাদেশ লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা, রংপুর। বাংলা একাডেমী। পৃষ্ঠা 122,123। আইএসবিএন 984-07-5118-2।
- ↑ "শতরঞ্জি"। বাংলাপিডিয়া।
- ↑ শতরঞ্জির শহরে, মানব জমিন, ১ মে ২০২২