শংকর গুহনিয়োগী (জন্ম: ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ — ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৯১) ভারতের শ্রমিক নেতা ও শহীদ। তার জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত বাংলার দিনাজপুর জেলায়, প্রকৃত নাম ধীরেশ গুহনিয়োগী। পিতা হেরম্বকুমার গুহনিয়োগী।[]

শংকর গুহনিয়োগী
জন্ম১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩
মৃত্যু২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৯১
আন্দোলনভারতের শ্রমিক আন্দোলন

প্রারম্ভিক জীবন

সম্পাদনা

তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু আসামে। পরে আসানসোল হতে ম্যাট্রিক পাশ করেন ১৯৫৯ সালে। খনি এলাকায় থাকার জন্যে ছোটবেলা থেকেই খনি শ্রমিকদের জীবন, শোষন ও সংগ্রাম তার মনে রেখাপাত করেছিল।[]

বামপন্থী রাজনীতি

সম্পাদনা

ছাত্রাবস্থায় বামপন্থী রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়ে ভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য। পরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) ও নকশালবাড়ী আন্দোলনে প্রভাবিত হয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) এর সদস্য হয়েছিলেন। গণসংগঠনের প্রশ্নে মতপার্থক্যের ফলে বহিষ্কৃত হন দল থেকে।

ভিলাই শ্রমিক আন্দোলন

সম্পাদনা

ভিলাই নগর স্টিল প্ল্যান্টে কাজ করতে করতেই দুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক হন শংকর। শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্যে চাকরি যায় তার। গ্রেপ্তারি এড়াতে ছত্তীসগঢ় চলে যান ও কৃষক শ্রমিকদের ভেতরে থেকে কাজ করতে শুরু করেন। মাছ ধরা, পাথর ভাঙ্গা, চাষাবাদ ইত্যাদি অনেক কিছুই জীবিকা নির্বাহের কারণে তাকে করতে হয়েছে। জগদলপুর থেকে শ্রমিক শোষনের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদী লেখা প্রকাশ হতে থাকে হিন্দি ভাষার 'স্ফুলিঙ্গ' পত্রিকায় ফলে স্থানীয় মাফিয়া ও পুলিশের আক্রমনের সম্মুখীন হতে হয়েছে একাধিকবার। ১৯৭৫ এ জরুরী অবস্থা জারী হলে জংগলে আত্মগোপন করেন। এই সময় প্রথম ছদ্মনাম নেন শংকরলাল ঠাকুর। পরবর্তীতে 'শংকর' নামেই দেশের শ্রমজীবী মানুষের কাছে ব্যাপক পরিচিতি। বিয়ে করেছিলেন আদিবাসী শ্রমিক কন্যা আশা কে।[]

খনিশ্রমিক আন্দোলন

সম্পাদনা

শ্রমিক ইউনিয়নের নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোর বাইরে শংকর গুহনিয়োগী সম্পূর্ণ নিজস্ব ধারায় শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলেন, কোনো সংসদীয় রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়া ব্যতিরেকে। জরুরী অবস্থা শেষ হওয়া অবধি সাড়ে পাঁচ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন এবং মুক্তি পেয়ে অসংগঠিত ঠিকা শ্রমিকদের নিয়ে কাজের নিরাপত্তা ও ন্যায্য মজুরির দাবীতে ব্যাপক আন্দোলনে অংশগ্রহণ। ১৯৭৭ সালে দাল্লি-রাজহারা এলাকায় লোহাখনি শ্রমিকদের নিয়ে তৈরি হয় 'ছত্রিশগড় খনি শ্রমিক সংঘ'। তার কাজের ক্ষেত্র ভিলাই রায়পুর অঞ্চলেও ছড়িয়ে যায়।

সামাজিক আন্দোলন

সম্পাদনা

স্থানীয় শ্রমজীবি মানুষদের সাথে মিশে গিয়ে কাজ করতেন বলে তার জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। নদীবাঁধ বিরোধী আন্দোলন বা জংগলের অধিকার নিয়েও তিনি সংগ্রাম করেছেন। আন্দোলনের ফলে মজুরি বৃদ্ধির হলেও তিনি লক্ষ্য করেন শ্রমিকদের রোজগারের একটা বড় অংশ মদের পেছনে নষ্ট হচ্ছে। মহিলা শ্রমিকদের সহায়তায় মদ্যপান বিরোধী ধারাবাহিক সংগ্রামে তিনি জয়ী হন ও সামাজিক সুফল পাওয়া যায়। তার চিন্তার মূল মন্ত্র ছিল 'সংঘর্ষ অউর নির্মাণ'। তার উদ্যোগে ছত্রিশগড়ে শ্রমিকদের স্বেচ্ছাশ্রম ও চাঁদায় নির্মিত হয় শহীদ হাসপাতাল। এছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ সচেতনতা, ন্যায্য মজুরির দাবীতে তার লড়াই সেখানকার সাধারন মানুষের কাছে প্রবল জনপ্রিয়তা দেয়।[]

মৃত্যু

সম্পাদনা

তার আন্দোলন ও জনসমর্থন স্থানীয় দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও খনি মাফিয়াদের কাছে বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৯১ ভিলাইতে নিজ বাসভবনে ঘুমের মধ্যে তাকে আততায়ীরা হত্যা করে।[]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. পূন্যব্রত গুন ও শংকর সান্যাল সম্পাদিত (২০১৫)। সংঘর্ষ ও নির্মাণ। কলকাতা: অনুষ্টুপ। পৃষ্ঠা ১৯। আইএসবিএন 978-93-82425-37-3 
  2. দ্বিতীয় খন্ড, অঞ্জলি বসু সম্পাদিত (২০০৪)। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। কলকাতা: সাহিত্য সংসদ। পৃষ্ঠা ৩১৬,৩১৭। আইএসবিএন 81-86806-99-7 
  3. বোলান গঙ্গোপাধ্যায়, উত্তর সম্পাদকীয়। "আন্দোলনের অভিনব দৃষ্টি"। এই সময়। সংগ্রহের তারিখ ২৭.১২.২০১৬  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)