লেভ শরনি
লেভ শরনি (রুশ: Лев Чёрный, আ-ধ্ব-ব: [ˈlʲɛf ˈtɕɵrnɨj] (; মৃত্যুঃ ২১ সেপ্টেম্বর ১৯২১) একজন রাশিয়ান। তিনি ছিলেন ব্যক্তিতান্ত্রিক নৈরাজ্যবাদী মতবাদে বিশ্বাসী। সেইসাথে ছিলেন একজন কবি এবং তৃতীয় )রুশ বিপ্লবের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ত্ব।[১] ১৯১৭ সালে শরনি রুশ সাম্রাজ্যের কারাগার থেকে মুক্তি পান এবং ধীরে ধীরে তৎকালীন রাশিয়া জুড়ে চলা অরাজকতার একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ত্বে পরিনত হন। বিভিন্ন প্রকাশনার মাধ্যমে তিনি নব্য বলশেভিক সরকারের চরম বিরোধিতা আরম্ভ করেন এবং বিভিন্ন গোপন প্রতিরোধ বাহিনী সংগঠিত করা শুরু করেন। রাশিয়ান নিরাপত্তা সংস্থা শেকা কর্তৃক গ্রেফতার হন এবং ১৯২১ সালে কোনো বিচার ছাড়াই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
লেভ শরনি Лев Чёрный | |
---|---|
জন্ম | পাভেল দিমিত্রিয়েভিচ তুর্খানিকভ |
মৃত্যু | সেপ্টেম্বর ২১, ১৯২১ |
জাতীয়তা | রুশ |
পেশা | কবি, রাজনৈতিক কর্মী |
পরিচিতির কারণ | বিপ্লবী নৈরাজ্যবাদ |
প্রারম্ভিক জীবন, দর্শন ও কারাবরণ
সম্পাদনাশরনি’র আসল নাম পাভেল দিমিত্রিয়েভিচ তুর্খানিকভ। বাবা ছিলেন একজন সেনাবাহিনীর কর্নেল।[২] শরনি ছিলেন একজন আদর্শচ্যুত বুদ্ধিজীবী। নৈরাজ্যবাদী বিশেষজ্ঞ পল এভ্রিচ তাকে ভলিন এর সাথে তুলনা করেছেন। শরনি বুর্জোয়া রুশ সমাজ সম্পর্কে নিটশের পূনর্মূল্যায়ন মতবাদের সমর্থক ছিলেন। আর তাই নৈরাজ্যবাদী সমাজতান্ত্রিক পিটার ক্রপটকিন এর দলে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ শরনির মতে এটা ছিলো ব্যক্তিগত স্বাধীনতার জন্যে হুমকি স্বরূপ।[২][৩][৪] ১৯০৭ সালে প্রকাশিত অ্যাসোসিয়েশনাল অ্যানার্কিজম নামক বইতে শরনি তার এ ‘স্বাধীন ব্যক্তির মুক্ত সংঘ’ মতবাদের কথা তুলে ধরেন।[৪] এভ্রিচ এবং এলান এন্টলিফ সহ আরো বেশ কিছু মনীষীর মতে সমাজ সম্পর্কে শরনির এসব চিন্তা ভাবনা আরো দুজন ব্যক্তিতান্ত্রিক নৈরাজ্যবাদী ম্যাক্স স্টার্নার আর বেঞ্জামিন টাকারের চিন্তাধারা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলো।[৫] বইটা প্রকাশের পরে পরেই শরনি তার অন্যান্য বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জন্য রাশিয়ান জার সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হন এবং সাইবেরিয়ার কারাগারে প্রেরিত হন।
মস্কোয় প্রত্যাবর্তন এবং বলশেভিকদের বিরোধিতা
সম্পাদনা১৯১৭ সালে সাইবেরিয়া থেকে ফেরার পরপরেই শরনি মস্কোর কর্মীদের মাঝে বক্তা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তখন তিনিই ছিলেন রাশিয়ায় ব্যক্তিতান্ত্রিক নৈরাজ্যবাদের প্রধান ব্যক্তি[২] আর সামগ্রিক অয়াজকতার অন্যতম মন্ত্রণাদাতা।[৬] ১৯১৭ সালের মার্চে জার দ্বিতীয় নিকোলাস এর পতনের পর মস্কো ফেডারেশন অফ অ্যানার্কিস্ট গ্রুপস প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি ছিলেন এর সাধারণ সম্পাদক এবং প্রধান তাত্ত্বিক। শুরুর দিকে এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিলো মস্কোর দরিদ্র শ্রেণীর কাছে তাদের মতবাদ প্রচার করা।[২][৫]
বলশেভিক নেতা লেভ কামিনেভ ছাড়াও আরো কয়েকজনের সাথে শরনির ব্যক্তিগত পরিচয় ছিলো। কিন্তু তিনি ১৯১৮ সালের ৫ মার্চ এক শোভাযাত্রার সময় প্রকাশ্যে নবগঠিত রুশ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের নিন্দাবাদ শুরু করেন। তিনি বলেন নৈরাজ্যবাদীদের জন্যে এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রও পূর্বতন বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠীর মতোই শত্রু ছাড়া কিছু নয় এবং শপথ নেন যে তিনি রাষ্ট্রযন্ত্র বিকল করে দেবেন।[২][৬] এরপরেই তিনি নৈরাজ্যবাদীদের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘আনার্কিয়া’তে সরকারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ নীতির কঠোর সমালোচনা শুরু করেন। সেখানে তিনি প্রস্তাব দেন ক্ষমতাকে আরো বেশি বিকেন্দ্রীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু করতে এবং দাবী করেন যে দেশের সকল শাসন কাঠামোর বিলোপ ঘটাতে হবে।[৬] ১৯১৮ সালের বসন্তে মস্কো ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত নৈরাজ্যবাদী দলগুলো মুক্ত মতপ্রকাশ ও আন্দোলনকারীদের উপর সরকারের দমনমূলক কর্মকাণ্ডের জবাবে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলে। এদেরকে বলা হতো ‘ব্ল্যাক গার্ড’। পরবর্তীতে এটা থেকেই নৈরাজ্যবাদীদের সেনাবাহিনী ‘ব্ল্যাক আর্মি’র উদ্ভব হয় যা রুশ গৃহযুদ্ধে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ১১ এপ্রিল রাতে সোভিয়েত গোয়েন্দা পুলিশ শেকা নৈরাজ্যবাদীদের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে মস্কো ফেডারেশনের দখলে থাকা একটা ভবনে তল্লাশী চালায়।[৫] কিন্তু সেখানে তারা ব্ল্যাক গার্ড কর্তৃক সশস্ত্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। ছোটখাটো একটা যুদ্ধের পর প্রায় চল্লিশজন নৈরাজ্যবাদী হতাহত হয় এবং প্রায় পাচ শতাধিক গ্রেফতার হয়।
গ্রেফতার এবং মৃত্যুদণ্ড
সম্পাদনা১৯১৮ সালে একটা গোপন দল গঠনে সহায়তা করার পর সেই বছরই শরনি আন্ডারগ্রাউন্ড অ্যানার্কিস্ট নামের আরেকটা দলে যোগ দেন।[৭] সংগঠনটার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কাজিমির কোভালেভিচ আর পিওতর সবালেভ। তারা দুটো উস্কানিমূলক প্রচারপত্র বের করে যাতে বলা হয় এই সমাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র পৃথিবীর ইতিহাসের সবচে জঘন্য জুলুমবাজি। ১৯১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আন্ডারগ্রাউন্ড অ্যানার্কিস্ট কয়েকজন বামপন্থী সমাজবিপ্লবীকে সাথে নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি, মস্কো শাখার সদর দপ্তরে বোমা হামলা করে। তখন সেখানে পার্টির পূর্ণাঙ্গ সভা চলছিলো। বারোজন সমাজতন্ত্রী নিহত হয় এবং প্রায় পঞ্চান্নজন আহত হয়। এর মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট বলশেভিক বুদ্ধিজীবী এবং প্রাভদা পত্রিকার সম্পাদক নিকোলাই বুখারিন।[৭] শরনি এবং ফান্যা ব্যারন নামের দুজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়।[৮] ১৯২১ সালের আগস্ট মাসে মস্কোর দৈনিক ইজভেস্টিয়াতে এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে প্রকাশিত হয় যে শরনিসহ আরো দশজন নৈরাজ্যবাদী সন্ত্রাসীকে কোনো শুনানি বা বিচার ছাড়াই গুলি করে মারা হয়েছে। যাই হোক, নৈরাজ্যবাদী বিশেষজ্ঞ পল এভ্রিচ এর মতে শরনিকে ঐ বছরের আগস্টে না বরং সেপ্টেম্বরে মারা হয়। যদিও শরনি সশরীরে কমিউনিস্ট পার্টির সদর দপ্তরের বোমাবাজিতে অংশ নেননি, কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ড অ্যানার্কিস্ট এর সাথে সম্পৃক্ততা থাকায় সহজেই তাকে ফাসিয়ে দেওয়া হয়। কমিউনিস্টরা শেষকৃত্যের জন্যে তার মরদেহ পরিবারের কাছে ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে গুজব ছড়ায় যে অতিরিক্ত অত্যাচারের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে।
গ্রন্থ তালিকা
সম্পাদনা- Novoe napravlenie v anarkhizme: assotsiatsionnyi anarkhizm. 2nd edn, New York, 1923.
- O klassakh. Moscow, 1924.
পাদটীকা
সম্পাদনা- ↑ Phillips, Terry (Fall ১৯৮৪)। "Lev Chernyi"। The Match! (79)। ২০০৮-০২-১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৩-১০।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ Avrich 2006, পৃ. 180
- ↑ Avrich 2006, পৃ. 254
- ↑ ক খ Chernyi, Lev (১৯২৩) [1907]। Novoe Napravlenie v Anarkhizme: Asosiatsionnii Anarkhism (Moscow; 2nd সংস্করণ)। New York।
- ↑ ক খ গ Antliff, Allan (২০০৭)। "Anarchy, Power, and Poststructuralism" (পিডিএফ)। SubStance। 36 (113): 56–66। ডিওআই:10.1353/sub.2007.0026। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৩-১০।
- ↑ ক খ গ Cooke, Catherine (১৯৯৯)। "Alexei Gan and the Moscow Anarchists"। Leach, Neil। Architecture and Revolution। New York: Routledge। পৃষ্ঠা 25–37। আইএসবিএন 0-415-13914-7।
- ↑ ক খ Avrich 2006, পৃ. 188
- ↑ Polenberg, Richard (১৯৯৯)। Fighting Faiths: the Abrams Case, the Supreme Court and Free Speech। Ithaca: Cornell University Press। পৃষ্ঠা 350। আইএসবিএন 0-8014-8618-1।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- Avrich, Paul (২০০৬)। The Russian Anarchists। Stirling: AK Press। আইএসবিএন 1-904859-48-8।