রাধারাণী দেবী (৩০ নভেম্বর ১৯০৩  — ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯) বিশ শতকের অন্যতম বাঙালি কবি। ভাষার মাধুর্যে, ভাবের স্নিগ্ধতায় আর ছন্দের সাবলীল দক্ষতায় 'অপরাজিতা দেবী' ছদ্মনামে সাহিত্য জগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী মহিলা কবি।[][]

রাধারাণী দেবী
জন্ম(১৯০৩-১১-৩০)৩০ নভেম্বর ১৯০৩
মৃত্যু৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯(1989-09-09) (বয়স ৮৫)
কলকাতা, ভারত
জাতীয়তাভারতীয়
নাগরিকত্বভারতীয় ভারত
পরিচিতির কারণকবি
দাম্পত্য সঙ্গীসত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (মৃ. ১৯১৬)
নরেন্দ্র দেব (বি. ১৯৩১)
সন্তাননবনীতা দেবসেন
পিতা-মাতাআশুতোষ ঘোষ (পিতা)
নারায়নী দেবী (মাতা)
পুরস্কারভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক (১৯৫৬)
লীলা পুরস্কার
রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৮৬)

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন

সম্পাদনা

রাধারাণী দেবীর জন্ম বৃটিশ ভারতের কলকাতায় ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর। পিতা আশুতোষ ঘোষ ম্যাজিস্ট্রেট হয়েও ছিলেন শিক্ষানুরাগী, সাহিত্যপ্রিয় ও গভীর রবীন্দ্রভক্ত। তার ও নারায়ণী দেবীর দশম সন্তান ছিলেন রাধারাণী। তার শৈশব কাটে পিতার কর্মক্ষেত্র কোচবিহার জেলার দিনহাটায়। তিনি ছবিরউন্নিসা বালিকা বিদ্যালয় থেকে ছাত্রবৃত্তি ও মাইনর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর স্বশিক্ষায় সংস্কৃত, ইংরাজী ও ফরাসি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। পরিবারে শিক্ষার পরিবেশে তিনি শৈশব আনন্দেই কাটিয়েছেন। বাড়িতে প্রত্যেক সদস্যদের জন্য আসত 'প্রবাসী', 'শিশু', 'মৌচাক', 'সন্দেশ', 'সোপান', 'ভারতবর্ষ' প্রভৃতি নানান পত্র পত্রিকা। তার সেজদার হাতে-লেখা ভাইবোনদের পত্রিকা 'সুপথ'-এ দশ বছর বয়সে লেখা দেন তিনি। তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় 'মানসী ও মর্মবাণী' পত্রিকায়। কিন্তু মাত্র তের বৎসর বয়সেই তার বিবাহ হয়ে যায় ইঞ্জিনিয়ার সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সাথে। কয়েক মাসের মধ্যেই আচমকা 'এশিয়াটিক ফ্লু' তে স্বামীর মৃত্যু হলে তিনি স্বেচ্ছায় কঠিন বৈধব্য পালন করেন।

সাহিত্যজীবন

সম্পাদনা

সাহিত্যক্ষেত্রে কবিতা দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করতে লাগলেন রাধারাণী দত্ত নামে 'ভারতবর্ষ', 'উত্তরা','কল্লোল', 'ভারতী' প্রভৃতি পত্রিকায়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম গল্প ‘বিমাতা’ প্রকাশিত হয় ‘মাসিক বসুমতী’তে। প্রথম প্রবন্ধ ‘পুরুষ’ প্রকাশিত হয় ‘কল্লোল’-এ। এর পাঁচ বছর পরে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ -  ‘লীলাকমল’। [] এরপর 'সিঁথিমোর' ও 'বনবিহগী' কাব্যগ্রন্থ। 'বনবিহগী' র চিত্রাঙ্কন করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথনন্দলাল বসু আর প্রুফ সংশোধন করেছিলেন রাজশেখর বসু। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে তার ও নরেন্দ্র দেবের যুগ্ম সম্পাদনায় বাংলা কাব্য সংকলন 'কাব্যদীপালি' প্রকাশিত হয়। একবার এক সান্ধ্য আড্ডায় রাধারাণীর রচনার পরিপেক্ষিতে প্রমথ চৌধুরী মন্তব্য করেন -

" ‘...আজ পর্যন্ত কোনও মেয়ের লেখায় তার স্বকীয়তার ছাপ ফুটে উঠলো না।’

এই অভিযোগের প্রতিবাদে তিনি 'অপরাজিতা দেবী' ছদ্মনামে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ছায়াপাতে শুরু করেন রচনা। তার কবিতার মধ্যে অন্তঃপুরের অন্তরঙ্গ জগৎ আত্মপ্রকাশ করেছে বিশ্বস্ততার সাথে। যেমন মাধুর্য ও কৌতুক, তেমনই প্রতিবাদ আর বিদ্রোহে সাহিত্যজগৎে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, যা কিনা সেসময় যেকোনো মহিলা কবির কলমে প্রায় অসম্ভব ছিল। ১৯৩০-৩৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তার প্রকাশিত ভালোবাসার কাব্যগ্রন্থ গুলি হল - 

  • 'বুকের বীণা' (১৯৩০)
  • 'আঙিনার ফুল' (১৯৩৪)
  • 'পুরবাসিনী' (১৯৩৫)
  • 'বিচিত্ররূপিনী' 

তবে যখনই তিনি বুঝেছেন সাহিত্য অন্য খাতে বইতে শুরু করেছে এবং তার এ লেখা নতুনকালের জন্য নয় - সেই মুহূর্তে তিনি 'অপরাজিতা' র কলম থামিয়ে দিয়েছেন। অপরাজিতা দেবী রবীন্দ্রনাথকে পদ্যে চিঠি দিতেন, উত্তরও পেতেন পদ্যে। 'প্রহসিনী' গ্রন্থে সেসব কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্রনাথের অন্তঃপুর' হল তার এক উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ।১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ৩১ শে মে নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে বিবাহ হয়। তৎকালীন নাগরিক-বুদ্ধিজীবী সমাজে দেবদম্পতির বিশেষ সমাদর ছিল। তাঁদের কন্যা হলেন সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন। তাঁদের কলকাতার  হিন্দুস্থান পার্কের বাড়ি 'ভালো-বাসা'-য় নানা মনীষীর সমাগম ঘটেছে একসময়। কথাশিল্পীশরৎচন্দ্রের সঙ্গে রাধারাণীর খুবই ঘনিষ্ঠ 'বড়দা' সম্পর্ক ছিল। তাঁদের 'ভালো-বাসা'য় তিনি প্রায় নিত্য আসতেন।শরৎচন্দ্রের অসমাপ্ত উপন্যাস 'শেষের পরিচয়' তিনিই সমাপ্ত করেন। ভালো বক্তাও ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে বড়দা'র জন্মশতবর্ষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যে 'শরৎচন্দ্র বক্তৃতামালা' দিয়েছিলেন তারই গ্রন্থরূপ তার একমাত্র প্রবন্ধ গ্রন্থ 'শরৎচন্দ্র: মানুষ ও শিল্প'। এই গ্রন্থটিতে শরৎপ্রতিভা বিশ্লেষণে তার গভীর অভিজ্ঞতা ও অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় মেলে। রাধারাণী ছোটদের জন্য লিখেছেন 'নীতি ও গল্প' এবং 'গল্পের আলপনা'। স্বামীর সম্পাদনায় ছোটদের জন্য মাসিক পত্রিকা 'পাঠশালা' প্রকাশে সহায়তা ছাড়াও যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন বাংলা গ্রন্থের সংকলন 'কথাশিল্প'। বিবাহের মন্ত্রগুপ্তির স্বচ্ছন্দ অনুবাদ করা তার বইটি হল 'মিলনের মন্ত্রমালা'। এছাড়া বারোয়ারি উপন্যাসও লিখেছেন।

সম্মাননা

সম্পাদনা

১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক ও লীলা পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে 'অপরাজিতা রচনাবলী'র জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত করে।

মৃত্যু

সম্পাদনা

রাধারাণী দেবী ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ৩০ শে নভেম্বর কলকাতায় নিজ বাসভবন 'ভালো-বাসা'য় প্রয়াত হন। 

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি   ২০১৯, পৃষ্ঠা ৩৪৯,৩৫০ আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬
  2. শিশিরকুমার দাশ সংকলিত ও সম্পাদিত, সংসদ বাংলা সাহিত্যসঙ্গী, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট  ২০১৯, পৃষ্ঠা ১৯১ আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-০০৭-৯ {{আইএসবিএন}} এ প্যারামিটার ত্রুটি: চেকসাম
  3. ""অপরাজিতা রাধারাণী""। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-২৯