রাজবন্দীর জবানবন্দী
রাজবন্দীর জবানবন্দী কাজী নজরুল ইসলাম লিখিত একটি প্রবন্ধ। নজরূল সম্পাদিত অর্ধ-সাপ্তাহিক ধূমকেতু ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করে। সেই পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে ও নিষিদ্ধ হয়। নজরুলকে জেলে আটক করে রাখার পর তার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি লিখিতভাবে আদালতে উপস্থাপন করেন চার পৃষ্ঠার বক্তব্য। তাই রাজবন্দীর জবানবন্দী নামে পরিচিত। ১৯২৩ সালের ৭ ই জানুয়ারি কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে বসে তিনি এই চার পৃষ্ঠার জবানবন্দী রচনা করেন।[১] পরে বিভিন্ন পত্র পত্রিকা যেমন, ধুমকেতু, প্রবর্তক, উপাসনা ইত্যাদি তে ১৯২৩ সালেই তা প্রকাশিত হয়।
লেখক | কাজী নজরুল ইসলাম |
---|---|
ভাষা | বাংলা |
ধরন | প্রবন্ধ |
প্রকাশনার তারিখ | ১৯২৩ সাল |
মিডিয়া ধরন | মুদ্রণ |
উদ্ধৃতি
সম্পাদনাএই জবানবন্দীতে নজরুল বলেছেন:[২]
“ | আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।... আমি কবি,আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে...।
‘আমার হাতের বাঁশি কেড়ে নিলেই সে বাঁশির মৃত্যু হবে না।’ কেননা আমি আর এক বাঁশি নিয়ে বা তৈরি করে তাতে সেই সুর ফোটাতে পারি। সুর আমার বাঁশির নয়, সুর আমার মনে এবং বাঁশির সৃষ্টির কৌশলে, অতএব দোষ বাঁশির নয়, সুরেরও নয়, দোষ তার, যিনি আমার কণ্ঠে তার বীণা বাজান, ... সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে। কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়। সত্যদ্রোহী নয়। সে বাণী রাজদ্বারে দণ্ডিত হতে পারে। কিন্তু ধর্মের আলোকে ন্যায়ের দুয়ারে তা নিরপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ, সত্যস্বরূপ। ...তাকে শাস্তি দেয়ার মতো রাজশক্তি বা দ্বিতীয় ভগবান নেই। তাকে বন্দী করার মতো পুলিশ বা কারাগার আজো সৃষ্টি হয়নি। ...বিচারক জানে আমি যা বলছি, যা লিখেছি, তা ভগবানের চোখে অন্যায় নয়, ন্যায়ের এজলাসে মিথ্যা নয়। কিন্তু হয়তো সে শাস্তি দেবে। কেননা সে সত্যের নয়, সে রাজার। সে ন্যায়ের নয়, সে আইনের। সে স্বাধীন নয়, সে রাজভৃত্য। তবু জিজ্ঞাসা করছি, এই বিচারাসন কার? রাজার না ধর্মের? এই যে বিচার, এ বিচারের জবাবদিহি করতে হয় রাজাকে, না তার অন্তরের আসনে প্রতিষ্ঠিত বিবেককে, সত্যকে? ভগবানকে? এ বিচারককে কে পুরস্কৃত করে? রাজা, না ভগবান? না আত্মপ্রসাদ? আজ ভারত পরাধীন। তার অধিবাসীবৃন্দ দাস। এটা নির্জলা সত্য। কিন্তু দাসকে দাস বললে, অন্যায়কে অন্যায় বললে এ রাজত্বে তা হবে রাজদ্রোহ। এত ন্যায়ের শাসন হতে পারে না, এই যে জোর করে সত্যকে মিথ্যা, অন্যায়কে ন্যায়, দিনকে রাত বলানো এটা কি সত্য সহ্য করতে পারে? এ শাসন কি চিরস্থায়ী হতে পারে? এত দিন হয়েছিল, হয়তো সত্য উদাসীন ছিল বলে। কিন্তু আজ সত্য জেগেছে, তা চুষ্মান জাগ্রত-আত্মা মাত্রই বিশেষ রূপে জানতে পেরেছে। এই অন্যায় শাসনকিষ্ট বন্দী সত্যের পীড়িত ক্রন্দন আমার কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল বলেই আমি রাজদ্রোহী? |
” |
মূলভাব
সম্পাদনানজরুল সৃষ্টিকর্তাকে নিজের বিচারক হিসেবে ধরেছেন। জবানবন্দিতে সৃষ্টিকর্তার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভারতের স্বাধীনতার জন্য আকুতি ফুটে উঠেছে।[৩]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ তারিক মনজুর (২২ মে ২০১৫)। "বিদ্রোহের বহুমাত্রা"। দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ১৪ জুলাই ২০১৭।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ হোসাইন, আহমদ (২০১৮-০৮-৩১)। "আদালতে নজরুলের জবানবন্দী"। দৈনিক নয়া দিগন্ত। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-১৪।
- ↑ "প্রদর্শিত হলো কবি নজরুলের 'রাজবন্দীর জবানবন্দী'"। আজকের পত্রিকা। ২০২১-১২-২২। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-১৪।