রমজানে রোজা

আরবী রমজান মাসে মুসলমানদের পালিত রোজা

মুসলিমদের প্রতিদিন ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত (অথবা কিছু পণ্ডিতদের মতে ভোর থেকে রাত অবধি) সমগ্র রমজানে রোজা (আরবি: صوم সাওম; ফারসি: روزہ রোজেহ্) বা উপবাস পালন করার বাধ্যবাধকতা দেয়া হয়েছে। মুসলমানদের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের দ্বিতীয় বছরে শাবান মাস মাসে রমজান মাসের রোজা পালনকে আবশ্যিক (ওয়াজিব) করা হয়। রোজা রাখার জন্য যৌনতা, খাদ্য ও পানীয় এবং ধূমপান থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। রমজান মাসের রোজা রাখা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি[] আল্লাহ তা'আলা বলেন - হে ঈমানদারগণ তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যে রূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর যেন তোমরা অর্জন করতে পারো

ইতিহাস

সম্পাদনা

স্থানীয় ঐতিহ্য অনুসারে, নবি মুহাম্মাদ একটি নির্দিষ্ট তারিখে দিনের শেষে একটি প্রথা হিসাবে তাঁর রোজা ভঙ্গ করতেন। ৭ম শতাব্দী থেকে সাওমকে মুসলমানরা প্রতিদিনের খাবার পরিহার করে প্রার্থনার রীতি হিসেবে ব্যাপকভাবে পালন করে আসছে।

কুরআনে

সম্পাদনা

রমজান মাসে রোজা পালনের জন্য কুরআনের পরপর দুটি আয়াতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে:

“হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের উপর রোজা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যে রকম তোমাদের পূর্বপুরুষদের উপর করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা সংযম করতে [শিখতে] পারো।”

—সূরা বাকারা ২:১৮৩[]

“[রোজা] নির্দিষ্ট কিছু দিনের জন্য; কিন্তু তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ থাকে বা সফরে থাকে, তাহলে পরে একই সংখ্যক দিনে [পূরণ করবে]। আর যাঁরা [অতিশয় কষ্টের সাথে] এটি (রোজা) রাখতে পারে, তাঁদের কর্তব্য এর পরিবর্তে তাঁরা একই সংখ্যক দিন একজন গরিব মানুষকে খাওয়াবে। আর যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অতিরিক্ত সৎকাজ করে, সেটা তাঁর জন্যই কল্যাণ হবে। রোজা রাখাটাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণকর, যদি তোমরা বুঝতে।”

—সূরা বাকারা ২:১৮৪[]

রমজান মাস চলাকালীন নিষেধাজ্ঞাসমূহ

সম্পাদনা
 
তাইওয়ানের তাইপেই গ্র্যান্ড মসজিদে রোজা ভাঙ্গা বা ইফতার করা

ভোর (ফজর) থেকে সূর্যাস্ত (মাগরিব) পর্যন্ত খাবার গ্রহণ, পান করা এবং যৌনসঙ্গম করার অনুমতি নেই। রোজা রাখাকে প্রগাঢ় ব্যক্তিগত ইবাদতের একটি পন্থা বলে গণ্য করা হয় যেখানে মুসলিমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য প্রার্থনা করে।

রমজান চলাকালীন মুসলমানরা সহিংসতা, রাগ, ঈর্ষা, লোভ, লালসা, ব্যঙ্গাত্মক প্রতিকৃতি, গালগল্প করা ইত্যাদি হতে বিরত থেকে ইসলামের শিক্ষা অনুসরণের প্রতি আরও বেশি প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার আশাবাদ ব্যাক্ত করা হয়েছে এবং পরস্পরের সহিত স্বাভাবিকের চেয়ে উত্তমরূপে পেশ হতে বলা হয়েছে। সমস্ত অশ্লীল এবং ধর্মবিরুদ্ধ উত্তেজনা এড়িয়ে চলতে হবে কেননা চিন্তা এবং কর্ম ঊভয়ের বিশুদ্ধতা জরুরি।

ব্যতিক্রমসমূহ

সম্পাদনা

রমজানের সময় উপবাস পালন করা কতিপয় ধরনের লোকের জন্য অত্যাবশ্যক নয় যাদের উপোস থাকা অত্যধিক সমস্যাযুক্ত, তাদের মধ্যে যারা চিকিৎসাধীন[] এবং বৃদ্ধ।

নাবালক শিশুদের জন্য রোজা থাকা অবশ্যক নয়,[] যদিও তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ রাখতে চায় এবং কিছু ছোট শিশুরা নিজেদেরকে রোজার জন্য প্রশিক্ষিত করতে অর্ধদিবস উপোস থাকে। যদি বয়ঃসন্ধিকাল বিলম্বিত হয়, তবে একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর পুরুষ এবং মহিলার জন্য রোজা রাখা ফরজ হয়ে যায়। বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস এবং স্তন্যদানকারী বা গর্ভবতীদের প্রতি সাধারণত রোজা পালন অত্যাবশ্যক নয়। হাদিস অনুযায়ী, ঋতুমতী নারীর জন্য রোজা রাখা নিষিদ্ধ।

অন্যান্য ব্যক্তি যাদের পক্ষে সাধারণত রোজা না রাখার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয় তাকরা হলেন যুদ্ধে অংশ নেওয়া এবং ভ্রমণকারীরা যারা গৃহ থেকে পাঁচ দিনেরও কম সময় কাটাতে চান। যদি রোজা ভাঙ্গার পরিস্থিতি সাময়িক হয় তবে সে ব্যক্তিকে রমজান মাস শেষ হওয়ার পর এবং পরবর্তী রমজান মাস আসার আগেই ছুটে যাওয়া রোজাসমূহ পূরণ করতে হবে। উক্ত শর্ত বা অবস্থাসমূহ দীর্ঘকালীন সময়ের জন্য স্থায়ী বা চলমান হলে, সেই ব্যক্তি প্রত্যেক ছুটে যাওয়া রোজার জন্য একজন অভাবী ব্যক্তিকে সমসংখ্যক দিন খাওয়ানোর মাধ্যমে এর ক্ষতিপূরণ দিতে পারে।

যদি কোনো ব্যক্তি উক্ত শর্তসমূহের কোনোটারই আওতাধীন না হয় এবং ভুলক্রমে রোজা ভঙ্গ করে, তখনও রোজাটি বৈধ বলে গণ্য হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা ভঙ্গ করলে সে রোজা ভেঙ্গে যায় এবং সে ব্যক্তিকে পরবর্তীতে রোজা রেখে তা পুষিয়ে দিতে হবে। []

২০১৩ সালে সোমালিয়ায় পোলিওমিলাইটিস প্রাদুর্ভাব চলাকালীন, সহায়তা কর্মীদের কিছু দলকে মৌখিক পোলিও টিকার দেওয়ার জন্য অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল।[]

রোজা ভাঙ্গা

সম্পাদনা
 
রমজানে মুসলমানরা ঐতিহ্যগতভাবে খেজুর দিয়ে রোজা ভঙ্গ করে (কুয়েত সিটির এই খেজুর বিক্রেতার মতো), যেহেতু এটা হযরত মুহাম্মদ (স.) এর সুন্নাহ ছিল।

অনেক মসজিদ তাঁদের সমাজের অন্তর্ভুক্ত মানুষদের জন্য সারাদিনের উপবাস শেষে সূর্যাস্তের পর ইফতারে খাবার সরবরাহ করে। মুসলিম স্যুপ রান্নাঘরে এ জাতীয় খাবার গ্রহণ করাও সাধারণ। মুহাম্মাদের (স.) রীতি অনুসরণ করে খেজুর (যখন সম্ভব হয়) বা পানি দিয়ে রোজা ভাঙ্গা হয়।

বিধিনিষেধ

সম্পাদনা

ভাষাতাত্ত্বিকভাবে, আরবি ভাষায় সাওম শব্দের অর্থ যেকোনো সময় কোনো কর্ম বা বক্তব্য থেকে নিঃশর্ত 'সংযম' (ইমসাক)। পবিত্র আইন অনুযায়ী, রোজা রাখা একটি বিধান যা বুঝায়:

  1. দেহগহ্বরের মধ্যে কোনো কিছু প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকা;
  2. যৌন ক্রিয়াকলাপে জড়ানো থেকে বিরত থাকা;
  3. পরনিন্দার মতো অনৈতিক কাজ থেকে বিরত থাকা;
  4. সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকা ;
  5. উপবাস বা রোজার নিয়তের সহিত থাকা;
  6. উপবাসের জন্য অনুমোদিত ব্যক্তিদের নৈকট্য থেকে বিরত থাকা।

'দেহগহ্বরের মধ্যে কোনো কিছু প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকা' মানে খাবার, পানীয় বা ঔষধ দেবে প্রবেশ করাকে বোঝায়, এটি শরীরের গহ্বরে প্রবেশ করবে কিনা তা নির্বিশেষে এটি কোনো সাধারণ বস্তুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এসব জিনিসের যেকোনোটিরই দেহে প্রবেশ হওয়া বলতে সেটা গলা, অন্ত্র, পাকস্থলী বা নাসিকা গহ্বর দিয়ে মস্তিষ্কে, গোপনাঙ্গ বা কাঁটা ঘা ইত্যাদি দিয়ে প্রবেশ হওয়াকে বোঝায়। সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে বা দুর্ঘটনাক্রমে যাই হোক না কেন, তবে এর বহির্ভূত বিষয় হলো ভুলক্রমে আহার করা বা যৌন ক্রিয়াকলাপে জড়িত হওয়া। 'যৌন ক্রিয়াকলাপে জড়ানো থেকে বিরত থাকা'র ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ যৌনমিলন এবং শৃঙ্গার জনিত বীর্যপাতও অন্তর্ভুক্ত। 'সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকা' দ্বারা এটা বোঝানো হচ্ছে যে, প্রকৃত অর্থেই ফজর থেকে মাগরিবের পর্যন্ত সময় ধরে উপবাস পালন করা। 'উপবাস বা রোজার নিয়তের সহিত থাকা' মানে একজন ব্যক্তির এজন্য রোজা বা উপবাসের নিয়ত বা মনস্থির করা যে, সে ব্যক্তি আসলেই ইবাদত পালনের উদ্দেশ্যে রোজা রাখছে কিনা। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ রোজা রাখার উদ্দেশ্য ছাড়াই শুধু পানাহার বা যৌন ক্রিয়াকলাপে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকে, তবে সেই রোজা আদায় হবে না এবং তা গণনাও করা হবে না। 'উপবাসের জন্য অনুমোদিত ব্যক্তিদের নৈকট্য থেকে বিরত থাকা' দ্বারা বোঝায় যে কোনো ব্যক্তিকে এমন অবস্থা থেকে দূরে থাকতে হবে যা কারও রোজা হালকা করে দেয়, যেমন: মাসিক বা যোনিস্রাব (প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ) ইত্যাদি।[] স্ত্রী বা অন্য কারও সাথে যৌন মিলন ছাড়াও রোজা রাখা অবস্থায় হস্তমৈথুন করাও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এরূপ কাজ করলে তা অপরিবর্তনীয়ভাবে রোজা ভঙ্গ করবে এবং যে ব্যক্তি এই কাজ করেছে তাকে আল্লাহর নিকট অনুতপ্ত হতে হবে ও পরবর্তী সময়ে এই রোজাটি পূরণ করতে হবে।[]

রমজান ইফতার দোয়া

সম্পাদনা

ইফতার দোয়া পড়ার মাধ্যমে রমজানের রোজা ভাঙা হয়:

আল্লাহুম্মা ইন্নি লাকা সুমতু ওয়া বিকা আমানতু [ওয়া ‘আলাইকা তাওয়াক্কালতু]ওয়া ‘আলা রিযকিকা আফতারতু[]
অর্থ: "হে আল্লাহ, আমি তোমার জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমার প্রতি বিশ্বাস এনেছি এবং তোমার [প্রদত্ত] খাদ্য দিয়েই রোজা ভঙ্গ করছি।"

সম্প্রদায়গত পার্থক্য

সম্পাদনা

অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুন্নি এবং শিয়া সম্প্রদায় একইভাবে রমজান পালন করে তবে কিছু পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত, সুন্নিগণ সূর্যাস্তের সময় তাঁদের রোজা বা উপবাস ভাঙে, যখন একেবারই সূর্য আর দেখা যায় না, তবে আকাশে তখনও আলো থাকে। তবে শিয়া সম্প্রদায় রোজা উপবাস ভাঙ্গার জন্য সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। শিয়া মুসলিমগণ একটি অতিরিক্ত ছুটি পালন করে যা সুন্নি সম্প্রদায় করে না।[]

সুফী মুসলিমরা কীভাবে রমজান পালন করে এবং রমজান তাদের কাছে কী অর্থ বহন করে সে ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। রোজা রাখার সময় তাঁরা একই নিয়ম অনুসরণ করে তবে মধ্যরাতে অতিরিক্ত নামাজ পড়ে। তারা যে প্রার্থনা করে তাদের নাম জিকির, যেখানে তাঁরা ৯৯ বার আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তাঁরা এরূপ করে, কারণ এর মাধ্যমে তাঁরা সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাঁদের ভালবাসা প্রদর্শন করে এবং সৃষ্টিকর্তার সাথে ব্যক্তিগত নৈকট্য লাভ করতে চায়।[১০]

ঈদ উল-ফিতর

সম্পাদনা

দীর্ঘ একমাস রোজা পালনের পর শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে মুসলিমদের ঈদ উল-ফিতর (আরবি: عيد الفطر ) পালন করা রমজান মাসের রোজা শেষ হওয়াকে চিহ্নিত করে।

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. বুখারি, "৮", সহীহ বুখারী:

    আবদুল্লাহ ইবনে উমর ইবনুল খাত্তাব কর্তৃক বর্ণিত, "আমি আল্লাহর রাসুলকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে শুনেছি, ‘ইসলাম ধর্ম পাঁচ [স্তম্ভ] এর উপর প্রতিষ্ঠিত। এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল; সালাত কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, হজ্ব করা এবং রমজানের রোজা রাখা।’"

  2. [কুরআন ২:১৮৩]
  3. [কুরআন ২:১৮৪]
  4. "The insider's guide to Ramadan" (ইংরেজি ভাষায়)। CNN International। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৬। সংগ্রহের তারিখ ১৫ আগস্ট ২০১০ 
  5. "Polio Eradication Suffers A Setback As Somali Outbreak Worsens"Npr.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ১৮ আগস্ট ২০১৭ 
  6. Administrator, Central-Mosque। "Fiqh of Ramadhan & Fasting - Ramadhan - Fiqh"central-mosque.com (ইংরেজি ভাষায়)। ১৩ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ আগস্ট ২০১৭ 
  7. Ramadan rules, islamicvibe। "Ramadan in 2020 – Fasting Rules & Everything Else You Need to Know"islamicvibe.com (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২০-০৯-২৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৫-১০ 
  8. "Archived copy"। ২০২০-০৬-১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-০১ 
  9. Hays, Jeffrey। "RAMADAN: MEANINGS, TIMING AND EXPECTATIONS | Facts and Details"factsanddetails.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১২-১০ 
  10. REPORTER, Manya A. Brachear, TRIBUNE। "Taking the extra step at Ramadan"chicagotribune.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১২-১০ 

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা