ঢাকা মোহসিনীয়া মাদ্রাসা
ঢাকা মোহসিনীয়া মাদ্রাসা বা মুহসিনিয়া মাদ্রাসা বা ঢাকা মাদ্রাসা ঢাকার শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাসে অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।[১][২] এটি ছিল পূর্ববাংলার মুসলমানদের জন্য প্রথম সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৮৭৩ সালে পূর্ব বাংলার মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন ঘটানোর জন্য মাদ্রাসা সংস্কার কমিটি নামক কমিটি মাদ্রাসাটি ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে প্রতিষ্ঠা করেন।[৩] এর সাথে সাথে রাজশাহীতে রাজশাহী মোহসিনীয়া মাদ্রাসা ও চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম মোহসিনীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মাদ্রাসাগুলো হাজী মুহাম্মদ মহসিন ফান্ডের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো বিধায়, এগুলোর নামকরণ করা হয় মোহসিনীয়া মাদ্রাসা।[৪] তবে ঢাকার মাদ্রাসাটি ঢাকা মাদ্রাসা নামেই পরিচিতি লাভ করে।[২]পরবর্তীতে মাদ্রাসাটি বিলুপ্ত হয়ে বর্তমান ঢাকা গভর্নমেন্ট মুসলিম হাই স্কুল, ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা এবং কবি নজরুল সরকারি কলেজে পরিণত হয়।[৫] এই মাদ্রাসার প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দী সোহরাওয়ার্দী।
পরবর্তী |
|
---|---|
সক্রিয় | ১৮৭৪ | –১৯৬৮
অবস্থান | লক্ষ্মীবাজার, ঢাকা , |
ইতিহাস
সম্পাদনা১৭৮০ সালে ব্রিটিশ সরকার কলকাতায় মাদ্রাসা-ই আলিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। এই শিক্ষাধারা পূর্ব বাংলাতেও ছড়িয়ে দিতে ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে সরকারি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন, গোটা পূর্ব বাংলায় এই তিনটিই ছিলো সরকারি মাদ্রাসা। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর জর্জ ক্যাম্পবেলের আমলে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার আদলে, মাদ্রাসা সংস্কার কমিটির প্রচেষ্টায় ঢাকায় একটি আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়।[৬]
১৮৭৩ সালের জুলাই মাসে সরকারি এক সিদ্ধান্তে জানানো হয়, ঢাকা মাদ্রাসার জন্য মহসিন ফান্ড থেকে প্রতি বছরে ১০ হাজার টাকার অনুদান পাওয়া যাবে। দীর্ঘ ৪২ বছর যাবত ১৯১৫ সাল পর্যন্ত মহসিন ফান্ড থেকে এই টাকা পাওয়া যেত। ১৯১৫ সালের ১৬ নভেম্বর তারিখে মাদ্রাসার ব্যয়ভার বাঙলা সরকার বহন করতে শুরু করে।[৭]
১৮৭৪ সালের ১৬ মার্চে মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ঢাকার পাটুয়াটুলীতে একটি বাসা ভাড়া করেন, সেখানেই মাদ্রাসা হোস্টেল, ক্লাসরুম ও নিজের থাকার ব্যবস্থা করে মাদ্রাসার কার্যক্রম শুরু করেন। এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই ছিলো তুলনামূলক দরিদ্র মুসলিম ছাত্রদের, যাদের কলেজে পড়ার আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিলোনা তাদের পড়াশোনার সুযোগ করে দেওয়া। মাদ্রাসার আর্থিক কিছুটা স্বচ্ছলতা আসলে মাদ্রাসাটি রায়সাহেব বাজারে তিনতলা একটি ভবনে ভাড়া বাড়িতে স্থানান্তরিত করেন।
এরপরে নবাব খাজা আবদুল গণি মাদ্রাসার জন্য নিজস্ব জমি ক্রয় করার জন্য ৪৫০০ টাকা ওয়াকফ করেছিলো। এই টাকা দিয়ে বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্কের নিকতে মাদ্রাসার নামে ২.৪০ একর জমি ক্রয় করা হয়। মাওলানা ওবায়দুল্লাহ মুসলিম মোঘল স্থাপত্য অনুযায়ী মাদ্রাসার ভবন নির্মাণ করেন।[৮] এই ভবনের নকশাকার ও নির্মাতা প্রকৌশলী ছিলো যথাক্রমে ইংরেজ মেজর ম্যান প্রকৌশলী বিভিয়ান স্কট। এই ভবন নির্মানের কাজে সহায়তা করেছিলেন স্থানীয় প্রকৌশলী রাখাল চন্দ্র দাস।[৯] ভবনের কাজ শেষ হলে ১৮৮০ সালে মাদ্রাসা তার নিজস্ব জমিতে স্থানান্তরিত হয়।
শিক্ষা ব্যবস্থা
সম্পাদনাঢাকা মাদ্রাসা পুরোপুরিভাবে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার সিলেবাস অনুসরণ করতো।[২] তৎকালীন সময়ে ঢাকা মাদ্রাসায় শুধুমাত্র আরবি ও ইংরেজি বিভাগ চালু ছিল। আরবি বিভাগে ৭টি শ্রেণি ও ইংরেজি বিভাগে ১০টি শ্রেণী ছিলো, ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা এন্ট্রান্স শ্রেণী (বর্তমানে এসএসসি, ১০ম শ্রেনী) পর্যন্ত পড়তে পারতো।
১৮৭৪ সালে মাদ্রাসার শুরুর দিকে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসংখ্যা ছিলো ১৬৯ জন। ১৮৮৩ সালে মাদ্রাসার মোট শিক্ষার্থী ছিলো ৩৩৮ জন, এরমধ্যে ইংরেজি বিভাগের ছিলো ২০২ জন।[১০] ইংরেজি বিভাগে আরবি, উর্দু, ফারসি, বাংলা ও বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও কালচার পড়ানো হতো। ১৯৪৭ সালে মাদ্রাসা বিভাগে ৪টি শ্রেণি ও কলেজর আলিম বিভাগে একটি শ্রেণি ছিল। ১৯৫৭ সালে মাদ্রাসায় মানবিক বিভাগ চালু করা হয়।
১৯৫৮ সালে জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সুপারিশে ১৯৬২ সালে এই মাদ্রাসাকে তুলে দিয়ে মাদ্রাসার ক্লাসগুলোকে মাধ্যমিক ক্লাসে পরিণত করা হয় এবং ঢাকা মাদ্রাসা পরিচিতি লাভ করে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের স্কুল বিভাগ হিসাবে। ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের স্কুল বিভাগটি ছিলো বর্তমান ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা।
এ্যাংলো-পারসিয়ান বিভাগ
সম্পাদনা১৮৭৫ সালে ঢাকা মাদ্রাসা ভাষায় দক্ষ করে তোলার জন্য কলকাতা মাদ্রাসার এংলো-পার্সিয়ান বিভাগের আদলে অ্যাংলো-পার্সিয়ান বিভাগ খোলা হয়। ঢাকায় কিছুদিনের মধ্যেই বিভাগটি তুলনামূলকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ১৮৮১ সালে ঢাকা মাদ্রাসার এই বিভাগ থেকে সর্বপ্রথম তিনজন ছাত্র ইংরেজির এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং উত্তীর্ণ হয়।
১৯১৫ সালে আবু নসর ওহীদ প্রবর্তিত নিউ স্কিম শিক্ষা পদ্ধতির চালু হলে ঢাকা মোহসিনীয়া মাদ্রাসা একটি হাই মাদ্রাসায় উন্নীত হয়। এবং পরের বছর ১৯১৬ সালেই অ্যাংলো-পার্সিয়ান বিভাগ আলাদা হয়ে ঢাকা গভর্নমেন্ট মুসলিম হাই স্কুল নামে একটি স্কুলের রূপ ধারণ করে। ১৯১৯ সালে এই বিভাগে স্পেশাল ইসলামি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয় ১৯২১ সালে বহু আন্দোলনের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ছাত্র যোগান দেওয়ার জন্য ঢাকা সরকারি মুসলিম হাই স্কুলকে একটি ইন্টারমিডিয়েট কলেজে রূপান্তর করা হয়, নাম দেওয়া হয় ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ।
এরপর ১৯৬৮ সালে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে স্কুল আলাদা করা হয়, কলেজের নাম দেওয়া হয় সরকারি ইসলামিয়া কলেজ এবং স্কুলের নাম দেওয়া হয় ইসলামিয়া সরকারি হাই স্কুল। বর্তমানে স্কুলটি ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা নামে কবি নজরুল সরকারি কলেজের অভ্যন্তরে একটি ভবনে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। এবং এই এ্যাংলো-পারসিয়ান বিভাগ থেকে উৎপন্ন কলেজ ১৯৭২ সালে আবার বার নাম পরিবর্তন করে কবি নজরুল সরকারি কলেজ নামে নামান্তর হয়।
উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি
সম্পাদনাউল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থী
সম্পাদনাউল্লেখযোগ্য শিক্ষক
সম্পাদনাআরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ প্রতিবেদক, নিজস্ব। "ঢাকা মাদ্রাসাই আজকের কবি নজরুল কলেজ"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২০।
- ↑ ক খ গ "ঢাকা মাদ্রাসা - বাংলাপিডিয়া"। bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২০।
- ↑ "লক্ষ্মীবাজার"। সমকাল। ২০২২-০৫-২৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২০।
- ↑ "মোহসিনীয়া মাদ্রাসা - বাংলাপিডিয়া"। bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২০।
- ↑ "Welcome to Kabi Nazrul Govt. College"। web.archive.org। ২০১৩-০৮-০৭। Archived from the original on ২০১৩-০৮-০৭। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২০।
- ↑ নূরে আলম, মুহাম্মদ। "ঢাকার অন্যতম প্রাচীন ছাত্রাবাস ডাফরিন হোস্টেল থেকে কবি নজরুল কলেজ"। The Daily Sangram। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৭-০৯।
- ↑ "মোহসীনিয়া মাদ্রাসা যেভাবে হলো কবি নজরুল কলেজ"। newsguardian24.net (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৭-২০।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "Colonial-era structures crumble due to apathy"। theindependentbd.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২০।
- ↑ "কবি নজরুল সরকারি কলেজ পরিচিতি – কবি নজরুল সরকারি কলেজ, ঢাকা"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২০।
- ↑ General Report: Public Instruction in Bengali (1899-1900)। কলকাতা: বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েট প্রেস। ১৯০০। পৃষ্ঠা ১৫১।