কক্সবাজার–টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ
কক্সবাজার–টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক, যা বঙ্গোপসাগর এর পাশ দিয়ে কক্সবাজারের কলাতলী সৈকত থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত।[১] এটি বর্তমানে পৃথিবীর দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ সড়ক।[২] ২০১৭ সালের ৬ মে এটি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন।।[৩]
জেলা সড়ক ১০৯৮ | ||||
---|---|---|---|---|
কক্সবাজার–টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ | ||||
পথের তথ্য | ||||
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রক্ষণাবেক্ষণকৃত | ||||
দৈর্ঘ্য | ৮০ কিমি (৫০ মা) | |||
প্রধান সংযোগস্থল | ||||
উত্তর প্রান্ত: | কলাতলী মোড়, কক্সবাজার | |||
দক্ষিণ প্রান্ত: | শাপলা চত্বর, টেকনাফ | |||
অবস্থান | ||||
প্রধান শহর | কক্সবাজার, টেকনাফ | |||
মহাসড়ক ব্যবস্থা | ||||
|
পটভূমি
সম্পাদনাকক্সবাজার–টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক (৮০কিমি দৈর্ঘ্য) নির্মাণ প্রকল্পটি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও সামরিক কৌশলগত উন্নয়ন এবং পর্যটন শিল্পের দ্রুত বিকাশের উদ্দেশ্যে গৃহিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবকাঠামো প্রকল্প। বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে নির্মিত এ সড়কটিকে বিশ্বের বৃহত্তম মেরিন ড্রাইভ সড়ক হিসেবে অবহিত করা হয়ে থাকে এবং কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। এ সৈকত কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত, যদিও একটি ক্রমশ: দক্ষিণ দিকে সরু হয়ে টেকনাফ গিয়ে শেষ হয়েছে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত একদিকে সাগর এবং অপর দিকে স্থলভাগে নিরবচ্ছিন্ন পাহাড় শ্রেণির সমন্বয়ে অসাধারণ সুন্দর এ ভূ-প্রকৃতির মাঝে আছে কম-বেশি ২শ মিটার প্রশস্ত সমতল করিডোর। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার হয়ে টেকনাফ পর্যন্ত বিদ্যমান জাতীয় মহাসড়ক N1 উক্ত পাহাড় শ্রেণির পূর্বে অবস্থিত এবং বঙ্গোপসাগরের তীর থেকে এর দূরত্ব কোথাও ৭কিমি, আবার কোথাও ১০কিমি। জাতীয় এ মহাসড়ক N1 এর এ অংশ থেকে সমুদ্র তীরের নয়নাভিরাম নৈসর্গিক দৃশ্য অবলোকনে প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে এর মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে আছে উপরোক্ত পাহাড় শ্রেণি। এমতাবস্থায়, কক্সবাজার তথা সারা দেশের পর্যটন শিল্পের দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গোপসাগরের সৈকত ঘেঁষে কক্সবাজার–টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কটি নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। সড়কটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সামরিক ও অর্থনৈতিক কৌশলগত ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়াও সড়কটি উক্ত উপকূলের জনগণক সাগরের জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা, লবণাক্ততার প্রভাব হ্রাস, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং বঙ্গোপসাগরের মৎস্য আহরণ ও মৎস্য শিল্পের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। উপরোক্ত বিষয়সমূহ বিবেচনা করতঃ উক্ত মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।[৪]
এই সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয় ১৯৮৯ সালে। ১৯৯৩ সালে তৎকালীন সরকার ৪৮ কি.মি. দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ প্রকল্প গ্রহণ করেন।[৫] তবে ২ কি.মি. সড়ক নির্মাণের পর এর কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং সড়কটি সাগরের প্রবল স্রোতে বিলীন হয়ে যায়। পরবর্তিতে ১৯৯৫ সালে এর নির্মাণ কাজ পুনরায় শুরু হয়। তখন এর নির্মাণ কাজের দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে।[৬] মাঝে কয়েক বছর কাজ বন্ধ থেকে পুনরায় ২০০৮ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়।[৭]
প্রকল্পের উদ্দেশ্য
সম্পাদনা- আঞ্চলিক মহাসড়ক: বঙ্গোপসাগরের সৈকতের পাশ দিয়ে কক্সবাজারের সাথে উখিয়া ও টেকনাফকে সংযুক্ত করে আঞ্চলিক মহাসড়কের স্টান্ডার্ডে সড়ক নির্মাণ করা।
- পর্যটন: এ এলাকায় পর্যটন বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা্ বিশ্বের দীর্ঘতম ও নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক সৈকতে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে সুবিধা প্রদান করা।
- বিকল্প সড়ক পথ: বিদ্যমান কক্সবাজার-টেকনাফ জাতীয় মহাসড়কের বিকল্প সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া।
- প্রাকৃতিক সম্পদ: বনজ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ সহজতর করা।
- মৎস্য শিল্প: এ অঞ্চলে মৎস্য শিল্পের উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করা।
- মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক: মিয়ানমারের সাথে সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা।
- লবণাক্ততা: প্রকল্প এলাকার জনগণ এবং চাষযোগ্য জমি জলোচ্ছ্বাসের ক্ষয়ক্ষতি এবং লবণাক্ততা থেকৈ রক্ষা করা।[১]
নির্মাণ
সম্পাদনাবাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীনে এটির নির্মাণ কাজ পরিচালনা করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর ১৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন এর নির্মাণ কাজে নিয়োজিত ছিল। তিনটি ধাপে মেরিন ড্রাইভটি নির্মাণ করা হয়েছে। প্রথম ধাপে কক্সবাজার শহরের কলাতলী থেকে ইনানী পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার, দ্বিতীয় ধাপে শিলখালী থেকে টেকনাফ সদর পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার ও শেষ ধাপে শিলখালী থেকে টেকনাফের সাবরাং পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার সড়ক তৈরি করা হয়। এতে মোট খরচ হয় প্রায় ৪৫৬ কোটি টাকা।[৮][৯] এর নির্মাণ কাজ ২০১৮ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এক বছর আগেই তা শেষ হয়ে যায়।[৬] এটির নির্মাণ কাজ চলাকালীন ২০১০ সালের ১৪ জুন পাহাড় ধসে নির্মাণ কাজে নিয়োজিত ছয় সেনা সদস্যের মৃত্যু হয়।[৭]
প্রকল্পের সুফল
সম্পাদনাআইএমইডি পরিচালিত ২০১৯ সালের এক সমীক্ষা জরিপে জানা যায়-এ সড়ক নির্মাণের ফলে প্রকল্পের এলাকার জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার তুলনামূলকভাবে উন্নত হয়েছে। যেমন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে ও পরে প্রকল্প এলাকায় ১০,০০০ টাকা বা তদূর্ধ্ব আয়কারী পরিবারের সংখ্যা ২১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি ওই অঞ্চলের মানুষের পেশায় ইতিবাচক পরিবর্তন এসছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে এ অঞ্চলের বসবাসরত মানুষের মধ্যে ব্যবসায়ী ছিলেন ১৭ শতাংশ, যা বর্তমানে ২১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে পূর্বে ১৭ শতাংশ বেকার থাকলেও তা হ্রাস পেয়ে বর্তমানে ১৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আইএমইডির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে-প্রকল্প এলাকায় জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মতে-এ প্রকল্পের কারণে পর্যটন ও নির্মাণ সেক্টরে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
পাশাপাশি সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় ৮০ কিমি সড়ক নির্মাণের ফলে বিশ্বের দীর্ঘতম ও নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মণ্ডিত সমুদ্রসৈকতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। ইতোমধ্যে কক্সবাজারে দেশি বিদেশি পর্যটক সংখ্যা আগের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া আইএমইডি পরিচালাতি জরিপে উঠে এসেছে-স্থানীয়ভাবে কৃষকদের জন্য তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করেছে মেরিন ড্রাইভ। প্রকল্প এলাকায় বসবাসরত কৃষকদের ওপর পরিচালিত জরিপে এও জানা যায়-৯৫ শতাংশ কৃষক মনে করেন আগে তুলনায় কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি, ৬৫ শতাংশ জরিপে অংশগ্রহণকারী মনে করেন-প্রকল্প এলাকায় মহিলাদের আয় উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
কক্সবাজার-টেকনাফের বিদ্যমান জাতীয় মহাসড়ক এবং মেরিন ড্রাইভ সড়কের মধ্যবর্তী এলাকায় বনজসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ সহজতর হয়েছে। মেরিন ড্রাইভ সড়কটি বিদ্যমান কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের বিকল্প সড়ক হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও বড় বাস-ট্রাকসহ ভারী যানবাহন চলাচল করছে না, তবুও জনসাধারণসহ পর্যটকরা আগের তুলনায় ১.০০ ঘণ্টা থেকে ১.৩০ ঘণ্টা মধ্যে যাতায়াত সুবিধা পাচ্ছে। এ মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণের ফলে বিদ্যমান হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনা দ্রুত পরিবহন ও নতুন হ্যাচারি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সারা দেশের মৎস্যশিল্প উন্নয়ন সহজতর হয়েছে। শুধু চিংড়ি রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রায় ৬০০০ কোটি টাকা আয় করে। ফলে চিংড়িসহ অন্যান্য মৎস্য সম্পদ রপ্তানির করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে এ প্রকল্প।
কক্সবাজার-টেকনাফের বিদ্যমান সড়ক ও সমুদ্রসৈকতের পাশ দিয়ে মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণের ফলে মধ্যবর্তী এলাকার জনগণ এবং চাষযোগ্য জমি জলোচ্ছ্বাসের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে। প্রকল্পের পরিকল্পিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কক্সবাজার–টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণ ২য় পর্যায় (ইনানী থেকে শিলখালী পর্যন্ত) নির্মাণ করায় এলাকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ফলে প্রকল্প এলাকার জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। পাশাপাশি, এ সড়ক নির্মাণ করায় কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যোগাযোগ সহজতর হয়েছে। তা ছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে সড়কটির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।[১০]
চিত্রশালা
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "মেরিন ড্রাইভ সড়ক উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী"। দৈনিক ইত্তেফাক। ৬ মে ২০১৭।
- ↑ "কক্সবাজারে বিশ্বের দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ সড়কের উদ্বোধন"। কালের কণ্ঠ। ৬ মে ২০১৭।
- ↑ "দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ কি বাংলাদেশের কক্সবাজারে বিদেশি পর্যটক আনতে পারবে?"। বিবিসি বাংলা। ৬ মে ২০১৭।
- ↑ প্রকৌশলী মোঃ নজরুল ইসলাম (মে ২০১৯)। কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন। হাউস-‘এস্টুয়ারী’ নাং-৯০৬/১, পূর্ব, শেওলাপাড়া মিরপুর, ঢাকা-১২১৬: পিডিপিএস ইঞ্জিরিয়ারিং কনসালট্যান্টস লিঃ। পৃষ্ঠা পাতা–১। line feed character in
|শিরোনাম=
at position 58 (সাহায্য) - ↑ BanglaNews24.com। "প্রস্তুত মেরিন ড্রাইভ সড়ক, আসছেন প্রধানমন্ত্রী"।
- ↑ ক খ BanglaNews24.com। "প্রস্তুত মেরিন ড্রাইভ সড়ক, আসছেন প্রধানমন্ত্রী"।
- ↑ ক খ "মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণে জীবন দিয়েছেন ছয় সেনা"। ঢাকা টাইমস। ৬ মে ২০১৭।
- ↑ "কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সংরক্ষিত পর্যটন এলাকা হবে"। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০১-০৭।
- ↑ "World's longest Marine Drive opens in Bangladesh - Dhaka Tribune"। ৬ মে ২০১৭।
- ↑ শামস, আরেফিন (০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২)। "মেরিন ড্রাইভ : অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত"। Jugantor (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ 2022-03-18। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য)