মুর্তজা বশীর
মুর্তজা বশীর (জন্ম: ১৭ আগস্ট ১৯৩২ - মৃত্যু: ১৫ আগস্ট ২০২০[১]) একজন বাংলাদেশী চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট এবং ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তার পিতা ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি ১৯৪৯ সালে বগুড়া করনেশন ইন্সটিটিউট থেকে মেট্রিক পাশ করেন। ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য হিসেবে তিনি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন। ১৯৪৮ এ, ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে, তিনি বগুড়া শহরে আন্দোলনের জন্য বেশ কয়েকটি মিছিল এবং মিটিং আয়োজনে কাজ করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। তিনি ১৯৫০ সালে ৫ মাস কারাভোগ করেছিলেন এবং পরিশেষে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমতলার মিটিং-এ যোগ দিয়েছিলেন। সেই দিনের পরবর্তী কালে, ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে ঢাকা জাদুঘরে প্রদর্শনী মুলতবি রাখতে ঢাকা জাদুঘরে যান। তিনি ফেব্রুয়ারি ২২ তারিখের গায়েবানা জানাজাতেও যোগদান করেছিলেন এবং পুলিশ আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করলে তারা পলাতক থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি আন্দোলনের জন্য অনেক কার্টুন এবং ফেস্টুন এঁকেছেন। তার কার্টুনগুলো দেশ ও ভাষার জন্য লড়াই এবং ত্যাগের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।[২] চিত্রশিল্পীর পাশাপাশি তিনি ছিলেন প্রথম জীবনে রাজনৈতিক কর্মী, পরবর্তীতে ভাষা-আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী, কবি, ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, চিত্রনাট্যকার, সহকারী চিত্রপরিচালক, প্রবন্ধকার, গবেষক ও শিক্ষক।[৩]
মুর্তজা বশীর | |
---|---|
জন্ম | ১৭ আগস্ট ১৯৩২ |
মৃত্যু | ১৫ আগস্ট ২০২০[১] ঢাকা, বাংলাদেশ | (বয়স ৮৭)
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
নাগরিকত্ব | বাংলাদেশ |
পরিচিতির কারণ | চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট, ভাষা আন্দোলন কর্মী |
পিতা-মাতা |
|
পুরস্কার | একুশে পদক (১৯৮০) স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৯) |
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
সম্পাদনা১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকায় এক মুসলিম পরিবারে মুর্তজা বশীরের জন্ম। তার বাবা উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং মা মরগুবা খাতুন।
১৯৪৯ সালে ঢাকা গভর্নমেন্ট ইনষ্টিটিউট অব আর্টস (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট)-এ দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে মুর্তজা বশীর চারুকলা শিক্ষা শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে পাঁচ বছর মেয়াদী শিল্প শিক্ষা শেষ করে প্রথম বিভাগে পাশ করেন।
কর্মজীবন
সম্পাদনাআর্ট স্কুল থেকে পাশ করার পর ১৯৫৫ সালে বছর খানেক নবাবপুর সরকারি স্কুলে ড্রয়িং শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এরপর ১৯৫৬ সালে মুর্তজা বশীর উচ্চতর শিক্ষার জন্য বাবার অর্থে ইতালির ফ্লোরেন্সে যান। আকাদেমিয়া দ্য বেল্লি আর্টিতে এক বছর চিত্রকলা এবং আরেক বছর ফ্রেসকো নিয়ে পড়াশোনা করেন। ফ্লোরেন্সে রেনেসাঁর ঐতিহ্য তাকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করে। এ সময় অধ্যাপক কাপুকিনি ছিলেন তার শিক্ষক। তার কাজে ফিগারের সরলীকরণ ও ন্যূনতম রঙ ব্যবহারের শৈলী তাকে আকৃষ্ট করেছিল। ফ্লোরেন্সে তিনি পথে প্রান্তরে দেখা সাধারণ মানুষের ছবি এঁকেছেন। অ্যাকর্ডিয়ান বাদক, জিপসির খেলা দেখানো, মা ও মেয়ের বাজার করে ফেরার দৃশ্য এঁকেছেন তিনি।
ইতালিতে দু'বছর কাটিয়ে ১৯৫৮ সালের শেষদিকে তিনি লন্ডন হয়ে দেশে ফেরেন। ফ্লোরেন্স ছেড়ে আসার আগে মুর্তজা বশীরের প্রথম একক প্রদর্শনী হয় ২৯ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল 'লা পার্মানেন্ট' গ্যালারীতে। এতে ফ্লোরেন্সে অবস্থানকালীন আঁকা চৌদ্দটি তৈলচিত্র এতে ছিল। ১৯৫৮ সালে বশীর ইতালীয় চিত্রকর রাপিসার্দি ও ভাস্কর ম্যাডোনিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে 'মুভিমেন্টো প্রিমোরডিও' (আদিমতার আন্দোলন) নামে একটি শিল্পীগোষ্ঠী গড়ে তোলেন এবং ফ্লোরেন্সের অদূরে এম্পোলি শহরে গ্রুপ প্রদর্শনী করেন ১৯৫৮ সালের ১৩ থেকে ২৫ এপ্রিল।
১৯৭৩ সালের আগস্টে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে। চট্টগ্রামে তিনি ১৯৭৬ সালের মার্চের মধ্যে 'এপিটাফ' সিরিজে আরো ২০টি ছবি আকেঁন তিনি। ১৯৯৮ সালে অধ্যাপক হিসাবে অবসর নেন।
লেখক হিসেবে
সম্পাদনাবশীরের লেখা গল্প- উপন্যাস ও অন্যান্য:[৪]
- 'আল্ট্রামেরিন' - উপন্যাস
- 'মিতার সঙ্গে চার সন্ধ্যে' - উপন্যাস
- 'অমিত্রাক্ষর' - উপন্যাস
- 'টাটকা রক্তের ক্ষীণরেখা' - কাব্যগ্রন্থ
- 'গল্প সমগ্র'
- 'মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ' - গবেষণা গ্রন্থ
- 'আমার জীবন ও অন্যান্য' - আত্মজৈবনিক গ্রন্থ
- 'কাচের পাখির গান' - গল্পসংকলন
- ‘ত্রসরেণু’, ‘তোমাকেই শুধু’, ‘এসো ফিরে অনুসূয়া’, ‘সাদায় এলিজি’ - কাব্যগ্রন্থ[৫]
- ১৯৬৩ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘কারোয়াঁ’র কাহিনী ও চিত্রনাট্যকার
- ১৯৬৪ সালে হুমায়ূন কবীর রচিত ‘নদী ও নারী’র চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক ও প্রধান সহকারী পরিচালক
- ১৯৬৫ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘ক্যায়সে কহু’র শিল্প নির্দেশক
পুরস্কার
সম্পাদনা- জাতীয় পুরস্কার (Prix National), চিত্রশিল্প উৎসব, ক্যাগনেস-সুর মের, ফ্রান্স (১৯৭৩)[৬]
- বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী কর্তৃক একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৫)
- শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদ নকশা, জাতীয় বই কেন্দ্র, ঢাকা (১৯৭৬)
- একুশে পদক (১৯৮০)
- সুলতান পদক, নড়াইল (২০০৩)
- হামিদুর রহমান পুরস্কার (২০১৫)[৭]
- স্টার লাইফটাইম পুরস্কার (২০১৬)
- স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৯)[৮]
মৃত্যু
সম্পাদনামুর্তজা বশীর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার এভারকেয়ার (সাবেক অ্যাপোলো) হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।[৯]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ "বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর আর নেই"। দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-১৫।
- ↑ আহমেদ, মানোয়ার. ভাষা আন্দোলনের সচিত্র দলিল, আগামী প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৯০-৯১ আইএসবিএন ৯৮৪-৪০১-১৪৭-৭
- ↑ মুর্তজা বশীর : বিরল প্রতিভা, কালি ও কলম, ২ সেপ্টেম্বর ২০২০
- ↑ মুর্তজা বশীর : পূর্ণাঙ্গ শিল্পীমানুষ, সমকাল, ২১ আগস্ট ২০২০
- ↑ ক খ মুর্তজা বশীর শিল্পীদের জন্য উদাহরণ, বণিক বার্তা, ১৬ আগস্ট ২০২০
- ↑ "Murtaja Baseer" (ইংরেজি ভাষায়)। Bengal Foundation। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-১১-২৯।
- ↑ হামিদুর রাহমান পুরস্কার গ্রহণ করলেন শিল্পী মুর্তজা বশীর, প্রথম আলো, ২৭ আগস্ট ২০১৬
- ↑ "মুর্তজা বশীর, হাসান আজিজুল হক পাচ্ছেন স্বাধীনতা পুরস্কার"। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ১০ মার্চ ২০১৯। ১ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ এপ্রিল ২০১৯।
- ↑ "চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর মারা গেছেন"। বিবিসি বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-১৫।