মালায়াপ্পা স্বামী

বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরের একটি বিগ্রহ

মালায়াপ্পা স্বামী হলেন ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরের বর্তমান ‘উৎসব মূর্তি’। যে সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ও শোভাযাত্রায় মন্দিরের ‘ধ্রুব বেরা’ প্রধান বিগ্রহকে পূজা করা যায় না (বিশেষত যেক্ষেত্রে বিগ্রহকে মন্দিরের বাইরে আনতে হয় বা বেদী থেকে স্থানচ্যূত করতে হয়), সেই সব ক্ষেত্রে মালায়াপ্পা স্বামীর বিগ্রহটি পূজিত হয়। ধ্রুব বেরা ও মালায়াপ্পা স্বামীর বিগ্রহদুটি সমমর্যাদা সহকারে পূজিত হয় এবং ভক্তেরা বিশ্বাস করেন, দুই বিগ্রহের ব্যক্তিত্বের দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই।

মালায়াপ্পা স্বামীর বিগ্রহটি ‘স্বয়ম্ভু’ (নিজে থেকে উদ্ভূত) পর্যায়ভুক্ত। ১৩৩৯ খ্রিষ্টাব্দে এই বিগ্রহটি আবিষ্কৃত হয়। প্রাথমিক নথিপত্রে আছে যে, এই বিগ্রহের প্রকৃত নাম ছিল ‘মালাই কুনিয়া নিনরা পেরুমল’ (সেই পর্বতের ঈশ্বর, যে পর্বত তার সামনে মাথা নত করেছে)।[]

ইতিহাস

সম্পাদনা

প্রথম দিকে তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে ‘উৎসব মূর্তি’ ছিলেন উগ্র শ্রীনিবাস। কথিত আছে, খ্রিস্টীয় ১৪শ শতাব্দীতে একবার শোভাযাত্রার সময় গ্রামে আগুন লাগে এবং অধিকাংশ বাড়ি ভস্মীভূত হয়। একজন ভক্ত সেই সময় দিব্য নির্দেশ পান যাতে পর্বতের গুহায় রক্ষিত একটি নতুন মূর্তি দিয়ে ‘উৎসব মূর্তি’ পরিবর্তন করা হয়।

নির্দেশিত স্থানে বিগ্রহটি পাওয়া যায়। এই স্থানটিতে পর্বত অনেকটাই নিচু। এই কারণে বিগ্রহটির আদি নামকরণ করা হয়েছিল ‘মালাই কুনিয়া নিনরা পেরুমল’। কালে এই নামটি ছোটো হয়ে ‘মালায়াপ্পান’ বা ‘মালায়াপ্পা স্বামী’তে পরিণত হয়। যে স্থানে মালায়াপ্পা স্বামীর বিগ্রহটি পাওয়া গিয়েছিল, সেই স্থানটি এখনও ‘মালায়াপ্পান কোনাই’ (মালায়াপ্পার স্থান) নাম পরিচিত।[]

মালায়াপ্পা স্বামীর বিগ্রহটি ধ্রুব বেরার একটি প্রতিমূর্তি। এই মূর্তিতে বেঙ্কটেশ্বরকে দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখা যায়। তার উপরের দুটি হাতে রয়েছে শঙ্খসুদর্শন চক্র। নিচের দুটি হাত যোগের ভঙ্গিমায় ন্যস্ত। ডান হাতটি রয়েছে ‘বরদা মুদ্রা’ (বরদানকারী) ভঙ্গিতে। বাঁ হাত রয়েছে ‘কাত্যালম্বিত’ (ভূমির সঙ্গে আনুভূমিক তলে জঙ্ঘার উপর ন্যস্ত) ভঙ্গিতে। বিগ্রহটির উচ্চতা ৩ ফুট। এটি ১৪ ইঞ্চি উঁচু একটি বেদীর উপর রাখা থাকে।[]

এই বিগ্রহের সঙ্গে মালায়াপ্পা স্বামীর দুই পত্নী শ্রীদেবী ও ভূদেবীর বিগ্রহও পাওয়া গিয়েছিল। এগুলিকেও ‘স্বয়ম্ভু’ বিগ্রহ মনে করা হয়।

শ্রীদেবী বিগ্রহ

সম্পাদনা

শ্রীদেবীর বিগ্রহটি সর্বদা মালায়াপ্পা স্বামীর ডান দিকে রাখা থাকে। এই বিগ্রহটির উচ্চতা ২৬ ইঞ্চি। এটি রাখা থাকে একটি ৪ ইঞ্চি উঁচু বেদীর উপর। এই পঞ্চলোহা মূর্তিটির বাঁ হাতটি থেকে ‘কটক মুদ্রা’ ভঙ্গিতে। এই ভঙ্গিটি দেখে মনে হয় যেন শ্রীদেবী অর্ধ্ব-উন্মিলিত হাতে একটি পদ্ম ধরে আছেন। ডান হাতটি ডানদিকে লম্বমান অবস্থায় থাকে। এই হাতের আঙুলগুলি আছে ‘গজকর্ণ’ ভঙ্গিতে।[]

ভূদেবী বিগ্রহ

সম্পাদনা

ভূদেবীর বিগ্রহটি মালায়াপ্পা স্বামীর বাঁদিকে দেখা যায়। এই বিগ্রহটি অনেকটাই শ্রীদেবী বিগ্রহের মতোই দেখতে। যা থেকে বোঝা যায়, বিষ্ণুর পত্নী রূপে শ্রীদেবী ও ভূদেবী সম মর্যাদার অধিকারী।[] দুটি বিগ্রহের পার্থক্য শুধু হাতের ভঙ্গিমায়। ভূদেবীর ডান হাত থাকে ‘কটক হস্ত’ এবং বাঁ হাত থেকে ‘গজকর্ণ’ ভঙ্গিতে।

ক্রমপর্যায়

সম্পাদনা

তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরের বেঙ্কটেশ্বর বিগ্রহগুলির ক্রমপর্যায় নিম্নরূপ: ‘ধ্রু বেরা’, ‘ভোগ শ্রীনিবাস’, ‘মালায়াপ্পা স্বামী’ ও তার পত্নীদ্বয়, ‘উগ্র শ্রীনিবাস’ ও তার পত্নীদ্বয় এবং ‘কোলুভু শ্রীনিবাস’। ধ্রুব বেরার পরেই ‘কৌতুক বেরা’ বা ভোগ শ্রীনিবাসের স্থান এবং কৌতুক বেরার পর স্থান ‘উৎসব বেরা’ বা মালায়াপ্পা স্বামীর। ক্রমপর্যায়ে তার নিচে রয়েছেন যথাক্রমে ‘স্নাপন বেরা’ বা উগ্র শ্রীনিবাস ও ‘বলি বেরা’ বা কোলুভু শ্রীনিবাস’।

দৈনিক পূজা

সম্পাদনা

মালায়াপ্পা স্বামীর মূর্তিটি মন্দিরের ‘উৎসব মূর্তি’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া প্রতিদিন এই বিগ্রহে তার সঙ্গে তার পত্নীদ্বয়ের বিবাহ ও বিবাহোত্তর আচারগুলি পালিত হয়। শ্রীদেবী ও ভূদেবীর সঙ্গে মালায়াপ্পা স্বামীর বিবাহ অনুষ্ঠানটিকে বলা হয় ‘শ্রীবারি কল্যাণোৎসবম্‌’ (প্রভুর বিবাহ উৎসব)। বিবাহ অনুষ্ঠানের পর, মালায়াপ্পা স্বামী ও তার পত্নীদের বিভিন্ন ‘বাহনে’ বসানো হয়। এটি ‘অর্জিত ব্রহ্মোৎসবম্‌’ অনুষ্ঠানের অঙ্গ। মন্দিরের ‘অদ্দল মণ্ডপমে’ (দর্পণ কক্ষ) মালায়াপ্পা স্বামীকে বসিয়ে ‘দোলোৎসব’ অনুষ্ঠান হয়। এই অনুষ্ঠানে বৈদিক স্তোত্র পাঠ করা হয়। এরপর ‘পুরুষ সূক্তম্‌’ ও ‘শ্রীসূক্তম্‌’ পাঠ করতে করতে বিগ্রহে সুগন্ধী ও চন্দন মাখানো হয় এবং তারপর ‘অর্জিত বসন্তোৎসবম্‌’ অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে ‘অভিষেকম্‌’ আয়োজিত হয়। অর্জিত ব্রহ্মোৎসবম্‌ ও বসন্তোৎসবম্‌ হল ব্রহ্মোৎসবম্‌ (৯ দিন) ও বসন্তোৎসবম্‌ (৩ দিন) অনুষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত রূপ।

সন্ধ্যাবেলায় মালায়াপ্পা স্বামী ও তার পত্নীদ্বয়ের বিগ্রহ মন্দিরের বাইরে আনা হয়। এটি ‘সহস্র দীপালংকার সেবা’র অংশ। এই অনুষ্ঠানে বৈদিক স্তোত্র ও আন্নামায়া সংকীর্তন গীত হয়। এরপর মন্দিরের চারপাশের চারটি প্রধান রাস্তায় বিগ্রহগুলি নিয়ে শোভাযাত্রা বের হয় এবং ‘রাত্রিপূজা’র সময় তাঁদের আবার মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়।[]

সাপ্তাহিক সেবা

সম্পাদনা

প্রতি সোমবার উৎসব মূর্তিতে ‘চতুর্দশ কলস বিশেষ পূজা’ আয়োজিত হয়। ‘সহস্র কলসাভিষেকম্‌’ পূজায় ভোগ শ্রীনিবাস, মালায়াপ্পা স্বামী ও বিশ্বকসেন মূর্তিতে ‘অভিষেকম্‌’ করানো হয়।[]

বাৎসরিক সেবা

সম্পাদনা

তেপ্পোৎসবম্‌’ উৎসবের সময় উৎসব মূর্তি ও তার দুই পত্নীর বিগ্রহ স্বামী পুষ্করিণীতে (মন্দির-সংলগ্ন হ্রদ) পূজিত হন। বিগ্রহগুলিকে হ্রদে একটি নৌকায় বসিয়ে ঘোরানো হয় এবং ফাল্গুন পূর্ণিমায় পূজা করা হয়।

প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে (জুলাই) উৎসব মূর্তিকে বিভিন্ন শোভাযাত্রা ও অনুষ্ঠানের ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে ‘অভিদেয়ক অভিষেকম্‌’ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। ৩ দিন ধরে চলা এই অনুষ্ঠানে বিগ্রহগুলিকে ‘বজ্রকবচম্‌’ (হিরে খচিত বর্ম), ‘মুত্যলকবচম্‌’ (মুক্তো খচিত বর্ম), ও ‘স্বর্ণকবচম’ (সোনার বর্ম) পরানো হয়।

মে মাসে আয়োজিত ‘পদ্মাবতী পরিণয়ম্‌’ অনুষ্ঠানটি হল শ্রীনিবাস ও দেবী পদ্মাবতীর বিবাহ অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান নারায়ণগিরির উদ্যানে তিন দিন ধরে চলে। এই অনুষ্ঠানে মালায়াপ্পা স্বামী ‘গজ’ (হাতি), ‘অশ্ব’ (ঘোড়া) ও ‘গগরুড়’ বাহনে আসেন। শ্রীদেবী ও ভূদেবী আসেন পৃথক পালকিতে। ‘কল্যাণোৎসবম্‌’ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর তাদের আবার মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়।

জুলাই মাসে বেঙ্কটেশ্বরের অর্থবর্ষ শুরুর অনুষ্ঠান ‘পুষ্প পাল্লাকি’ উৎসবে উৎসব মূর্তিগুলিকে সুসজ্জিত পালকিতে চাপিয়ে শোভাযাত্রায় বের করা হয়।[]

ব্রহ্মোৎসবম্‌’ উৎসবেও উৎসব মূর্তিগুলিকে বিভিন্ন বাহনে চাপিয়ে শোভাযাত্রায় বের করা হয়।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "Supreme Saviour of Seven Hills"। Omnamovenkatesaya.com। ২০০৬-০১-০১। ২০০৭-০৪-১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৪-২৪ 
  2. The Tirumala TempleTirumala: Tirumala Tirupati Devasthanams। ১৯৮১।  Authors list-এ |প্রথমাংশ1= এর |শেষাংশ1= নেই (সাহায্য)
  3. "Daily Sevas in Tirumala"TTD। ২০০২-১০-০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৪-২২ 
  4. "Periodical Sevas Description at Tirumala Temple"TTD। ২০১২-০৭-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৪-২২ 
  5. "Periodical Sevas Description at Tirumala Temple"TTD। ২০১২-০৭-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৪-২২