মানব পাচার
মানব পাচার জোরপূর্বক শ্রম, যৌন দাসত্ব অথবা পাচারকৃত মানুষদেরকে ব্যবসায়িক যৌনশোষণমূলক কাজে নিয়োজিত করার জন্য সংঘটিত অবৈধ মানব বাণিজ্যকে বোঝায়। এ বিষয়টি জোরপূর্বক বিবাহের মাধ্যমে পত্নী জোগাড়,[১][১][১] অঙ্গহানি বা টিস্যু/কলাহানি[১][১] বা ভ্রূণকোষ ধ্বংস[১] করাকেও পরিবেষ্টন করতে পারে। মানব পাচার একটি দেশের অভ্যন্তরে বা এক দেশ থেকে অন্য দেশে সংঘটিত হয়। মানব পাচার বল প্রয়োগের মাধ্যমে সংঘটিত একটি অপরাধ যা মানুষের মুক্ত চলাচলের অধিকারকে হরণ করে। [১] মানব পাচার মূলত নারী এবং শিশু পাচারকেই ইঙ্গিত করে থাকে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংঘটন (আইএলও)-র মতে, শুধুমাত্র বলপূর্বক শ্রম দ্বারাই ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরে ১৫০বিলিয়ন মার্কিন ডলার লাভ করা হয়েছে।[১] ২০১২ সালে আইএলও অনুমান করেছে যে প্রায় ২কোটি ১০লক্ষ মানুষ বর্তমান যুগে দাসত্বের শিকার। তাদের মধ্যে ১কোটি ৪২লক্ষ (৬৮%) জন শ্রম-শোষিত, ৪৫লক্ষ (২২%) জন যৌনভাবে শোষিত এবং ২২লক্ষ (১০%) জন রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া বলপূর্বক শ্রম দ্বারা শোষিত।[১]
আন্তর্জাতিক শ্রম সংঘটনের মতে শিশু শ্রমিক, সংখ্যালঘু এবং বেআইনি অভিবাসীরা প্রচন্ডভাবে শোষিত হওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে। পরিসংখ্যান মতে, পৃথিবীর ২১কোটি ৫০লক্ষ যুব শ্রমিকদের অর্ধেককে জোরপূর্বক যৌন কর্ম এবং বলপূর্বক ভিক্ষাবৃত্তিসহ ক্ষতিকর ক্ষেত্রগুলোতে দেখতে পাওয়া যায়। [১] লেদার ট্যানিং, পাথর খননসহ ইত্যাদি সর্বোচ্চ শোষণমূলক এবং বিপজ্জনক ক্ষেত্রগুলোতেই বেশিরভাগ জাতিগত সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষেরা কাজ করে বলে অনুমিত হয়েছে। [১]
বহুজাতিক অপরাধ সংঘটনগুলোর সংঘটিত অপরাধকর্মগুলোর মধ্যে মানবপাচারকে অন্যতম দ্রুত অপরাধকর্ম হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। [১]
আন্তর্জাতিক কনভেনশন মতে, মানবপাচার হচ্ছে মানুষের অধিকারের লঙ্ঘন। সেই সাথে এটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের একটি নির্দেশনার বিষয়বস্তু। [১]
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্যবিভাগের মতে, মানবপাচার এবং জোরপূর্বক শ্রম থেকে সুরক্ষা দেবার ক্ষেত্রে বেলারুশ, ইরান, রাশিয়া, তুর্কি হচ্ছে জঘন্যতম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম।[১]
সংজ্ঞা
সম্পাদনাজাতিসংঘ মানব পাচারকে তাদের প্রোটোকলে স্বীকৃতি দিয়েছে। একে প্রতিহত, দমন, শাস্তির আওতায় আনার জন্য, বিশেষতঃ নারী ও শিশুদের বিষয়ে, (যা পালেরমো পাচার প্রোটোকল নামে খ্যাত)। ২৫ডিসেম্বর ২০০৩ সালে জাতিসংঘ বহুজাতীয় সংঘবদ্ধ অপরাধসমূহের বিরুদ্ধে গঠন করা কনভেনশন কার্যকর করে।
পালেরমো পাচার প্রোটোকল এই কনভেনশনের তিনটি সম্পূরক অংশের মধ্যে একটি ।[১] উক্ত প্রোটোকলটি হচ্ছে গত অর্ধশত বছরের মধ্যে প্রথমবারের মত আইনগতভাবে বাধ্য এবং একমাত্র সম্মতসিদ্ধ চুক্তি যা মানব পাচারের সংজ্ঞা দেয়। মানব পাচার সম্পর্কিত অপরাধের বিচার এবং অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সহজতর করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য। পাচারের শিকার ব্যক্তিদেরকে মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণায় দেয়া অধিকার অনুসারে সুরক্ষা প্রদান ও সহায়তা করাও এর একটি উদ্দেশ্য।
নভেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত পাচার প্রোটোকলটিতে স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা ১৭৩।[১]
প্রোটোকলের মতে মানব পাচার হচ্ছে-
ক) [...] শোষণ করার উদ্দেশ্যে ভয় দেখিয়ে বা বল প্রয়োগ করে বা অন্য কোন জোড়পূর্বক উপায়ে অপহরণ, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, ক্ষমতার অপব্যবহার বা দুর্বল অবস্থা কাজে লাগিয়ে অর্থ প্রদান/গ্রহণ করে বা অন্যভাবে লাভ করে কোন মানুষের সম্মতি নিয়ে মানুষ সংগ্রহ, পরিবহন, হস্তান্তর, আশ্রয় প্রদান বা গ্রহণ করা।
খ) মানব পাচার একটি বৈশ্বিক সমস্যা যা পুরুষ, মহিলা এবং শিশু সহ সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করে৷
বৈশ্বিক সমস্যা: একটি সমস্যা যা বিশ্বের অনেক দেশকে প্রভাবিত করে। পুরুষ, মহিলা এবং শিশু: সকল লিঙ্গ ও বয়সের মানুষ মানব পাচারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। শিকার: ব্যক্তি যারা পাচার এবং শোষণের শিকার হয়। অপরাধী: ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যারা মানব পাচারের অপরাধ করে। অরক্ষিত জনসংখ্যা: লোকদের দল যারা পাচারকারীদের দ্বারা লক্ষ্যবস্তু হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যেমন অভিবাসী, উদ্বাস্তু এবং যারা দারিদ্রে বসবাস করে।
গ) মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিরা প্রায়ই দুর্বল ব্যক্তি যারা চাকরি, শিক্ষা বা উন্নত জীবনের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে পাচারে প্রলুব্ধ হয়।
দুর্বল ব্যক্তি: যারা দুর্বলতা বা শোষণের জন্য সংবেদনশীলতার অবস্থানে রয়েছে। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি: প্রতারণামূলক বিবৃতি বা কাউকে প্রতারিত করার প্রস্তাব। কর্মসংস্থান: অর্থপ্রদানের বিনিময়ে কারও জন্য কাজ করার জন্য নিয়োগের কাজ। শিক্ষা: অধ্যয়ন বা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জনের প্রক্রিয়া। উন্নত জীবন: এমন একটি জীবনের প্রতিশ্রুতি যা দারিদ্র্য, বিপদ বা অন্যান্য নেতিবাচক পরিস্থিতি থেকে মুক্ত।
ঘ) মানব পাচার একটি দেশের মধ্যে বা আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে হতে পারে।
একটি দেশের মধ্যে: পাচার যা একটি একক দেশের সীমানার মধ্যে ঘটে। আন্তর্জাতিক সীমানা জুড়ে: পাচার যা জাতীয় সীমানা পেরিয়ে শিকারদের পরিবহনের সাথে জড়িত। ট্রান্সন্যাশনাল পাচার: আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে শিকার পাচারের কাজ। চোরাচালান: লাভের জন্য সীমান্ত পেরিয়ে মানুষের অবৈধ পরিবহন। বর্ডার কন্ট্রোল: জাতীয় সীমানা জুড়ে মানুষ এবং পণ্য চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী আইন ও প্রবিধানের প্রয়োগ।
ঙ) পাচারকারীরা শারীরিক সহিংসতা, হুমকি, ঋণের বন্ধন এবং মানসিক কারসাজি সহ তাদের শিকারকে নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ করার জন্য বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে।
নিয়ন্ত্রণ: অন্য কারো উপর ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব প্রয়োগের কাজ। শোষণ: ব্যক্তিগত লাভের জন্য কারও সুবিধা নেওয়া। শারীরিক সহিংসতা: কাউকে নিয়ন্ত্রণ করতে বলপ্রয়োগ বা শারীরিক ক্ষতি। হুমকি: কাউকে নিয়ন্ত্রণ করতে ভয় দেখানো বা ক্ষতির প্রতিশ্রুতি। ঋণ বন্ধন: এমন একটি ঋণ শোধ করার জন্য কাউকে কাজ করতে বাধ্য করার অভ্যাস যা কখনই পুরোপুরি শোধ করা যায় না।
চ) মানব পাচারের শিকারদের বেশিরভাগই গৃহকর্ম, কৃষি, উত্পাদন এবং নির্মাণ সহ শ্রমে বাধ্য হয়।
শ্রম পাচার: জোরপূর্বক শ্রম বা পরিষেবার মাধ্যমে ব্যক্তিদের শোষণ। গার্হস্থ্য কাজ: পরিচ্ছন্নতা বা শিশু যত্নের মতো গৃহস্থালীতে সম্পাদিত কাজ। কৃষি: কৃষিকাজ এবং আনুষঙ্গিক ক্রিয়াকলাপ, যেমন ফসল কাটা বা পশুপালন।