মহাকাশ বিমান বা স্পেসপ্লেন (ইংরেজি: spaceplane) একধরনের যান যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বিমানের মতো উড়তে বা গ্লাইড করতে পারে এবং মহাকাশে মহাকাশযানের মতো আচরণ করতে পারে।[] এর জন্য মহাকাশ বিমানকে বিমান ও মহাকাশযান উভয়ের বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। কক্ষীয় মহাকাশ বিমান অনেকটা সাধারণ মহাকাশযানের মতো এবং উপকক্ষীয় মহাকাশ বিমান অনেকটা উড়োজাহাজের মতো আচরণ করে। আজ পর্যন্ত সমস্ত মহাকাশ বিমান আকাশারোহণ ও ঊর্ধ্বগমনের জন্য রকেট ইঞ্জিন ব্যবহার করে, কিন্তু অবতরণের সময় তারা ক্ষমতাহীন গ্লাইডারের মতো আচরণ করে।

২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, চার ধরনের মহাকাশ বিমান কক্ষপথে উৎক্ষিপ্ত হয়েছে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুনরায় প্রবেশ করেছে এবং ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করেছে: যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস শাটল, সোভিয়েত ইউনিয়নের বুরান, যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং এক্স-৩৭[]চীনের পুনঃব্যবহারযোগ্য পরীক্ষামূলক মহাকাশযানড্রিম চেসার যুক্তরাষ্ট্রের এক বেসরকারি মহাকাশ বিমান, যা এখন উন্নয়নের অধীন।

অন্তত দুটি উপকক্ষীয় রকেটচালিত বিমান অপর বাহক বিমানের মাধ্যমে অনুভূমিকভাবে উৎক্ষিপ্ত হয়ে কার্মান রেখাকে (১০০ কিমি) অতিক্রম করেছে: নর্থ আমেরিকান এক্স-১৫স্পেসশিপওয়ান। ২০১৮ সালে স্পেসশিপটু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংজ্ঞা অনুযায়ী ৮০ কিমি উচ্চতা অতিক্রম করে মহাকাশে পৌঁছে গিয়েছিল।

কক্ষীয় মহাকাশ বিমান

সম্পাদনা

স্পেস শাটল

সম্পাদনা
 
Discovery lifts off at the start of STS-120.

স্পেস শাটল ১৯৮১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত জাতীয় মহাকাশ ও মহাকাশ প্রশাসন (নাসা) স্পেস শাটল কর্মসূচির অংশ হিসাবে একটি আংশিক পুনঃব্যবহারযোগ্য পৃথিবীর নিন্ম কক্ষপথীয় মহাকাশযান ব্যবস্থার দ্বারা পরিচালিত হয়। কর্মসূচির দাপ্তরিক নাম “স্পেস ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম” (এসটিএস), যা ১৯৬৯ সালে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য মহাকাশযানের একটি ব্যবস্থার পরিকল্পনা থেকে নেওয়া হয়, যেখানে এটিই কেবলমাত্র উন্নয়নের জন্য অর্থায়িত আইটেম ছিল।[] চারটি পরীক্ষামূলক কক্ষপথীয় উড়ানের প্রথমটি ১৯৮১ সালে হয়, যার ফলে ১৯৮২ সালে পরিচালনাগত বা কর্মক্ষম উড়ান শুরু হয়। ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার (কেএসসি) থেকে স্পেস শাটল উৎক্ষেপিত হত। ১৯৮১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত মোট ১৩৫ টি অভিযানে পাঁচটি সম্পূর্ণ স্পেস শাটল কক্ষপথীয় যান নির্মিত হয় ও উড্ডয়ন করে। পরিচালনাগত অভিযানসমূহ অসংখ্য উপগ্রহ, আন্তগ্র্রহ প্রোব ও হাবল স্পেস টেলিস্কোপের (এইচএসটি) উৎক্ষেপণ, কক্ষপথে বিজ্ঞান পরীক্ষা পরিচালনা, রাশিয়ার সাথে শাটল-মীর কর্মসূচি পরিচালনা এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (আইএসএস) নির্মাণ ও পরিষেবা প্রদান করে। স্পেস শাটল বহরের মোট অভিযান সময় ১,৩৩২ দিন, ১৯ ঘণ্টা, ২১ মিনিট ও ২৩ সেকেন্ড।[]

স্পেস শাটলের উপাদানসমূহের মধ্যে রয়েছে তিনটি ক্লাস্টারযুক্ত রকেটিন আরএস-২৫ প্রধান ইঞ্জিন সহ পরিক্রমাকারী যান (ওভি), পুনরুদ্ধারযোগ্য শক্ত রকেট বুস্টার (এসআরবি) এবং তরল হাইড্রোজেনতরল অক্সিজেন ধারণকারী ব্যয় বহনযোগ্য বহিরাগত ট্যাঙ্ক (ইটি)। স্পেস শাটলটি ইটি থেকে চালিত পরিক্রমাকারী যানের তিনটি প্রধান ইঞ্জিনের সাথে সমান্তরালভাবে দুটি এসআরবি এর সাথে প্রচলিত রকেটের মতো উল্লম্বভাবে উৎক্ষেপিত হয়। যানের কক্ষপথে পৌঁছানোর আগে পরিক্রমাকারী যানের দুটি অরবিটাল ম্যানুভারিং সিস্টেম (ওএমএস) ইঞ্জিন ব্যবহার করে এসআরবি দুটিকে জেটসিসন বা বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং কক্ষপথ সন্নিবেশের ঠিক আগে ইটিকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। অভিযানের সমাপ্তিতে, পরিক্রমাকারী যানটি কক্ষপথচ্যুত হতে ও বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের জন্য তার ওএমএসকে প্রজ্জলন করে। পরিক্রমাকারী যানটি তাপীয় সুরক্ষা ব্যবস্থার টাইলসমূহের সাহায্যে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় সুরক্ষিত থাকে এবং এটি রানওয়ে অবতরণের জন্য একটি স্পেস প্লেন হিসাবে সজ্জিত হয়েছিল, সাধারণত ফ্লোরিডার কেএসসি বা ক্যালিফোর্নিয়ার এডওয়ার্ডস এয়ার ফোর্স বেসে রজার ড্রাই লেকে শাটল অবতরণ সুবিধা উপস্থিত। যদি অ্যাডওয়ার্ডে অবতরণ করে, তবে পরিক্রমাকারী যানটিকে বিশেষত পরিবর্তিত বোয়িং ৭৪৭ শাটল পরিবাহক বিমানের দ্বারা কেএসসি'তে ফিরিয়ে আনা হয়।

প্রথম পরিক্রমাকারী যান, এন্টারপ্রাইজ ১৯৭৬ সালে নির্মিত হয় এবং অ্যাপ্রোচ ও ল্যান্ডিং টেস্টে ব্যবহৃত হয়, তবে তার কক্ষপথে উড্ডয়নের সামর্থ্য ছিল না। প্রাথমিকভাবে চারটি কার্যকর পরিক্রমাকারী যান তৈরি করা হয়। পরিক্রমাকারী যানসমূহ হল কলম্বিয়া, চ্যালেঞ্জার, ডিসকভারিআটলান্টিস। এর মধ্যে ১৯৮৬ সালে চ্যালেঞ্জার২০০৩ সালে কলম্বিয়া নামে দুটি পরিক্রমাকারী যান অভিযানের সময় দুর্ঘটনা ঘটার জন্য ধ্বংস হয় এবং মোট ১৪ জন নভোচারী নিহত হয়। চ্যালেঞ্জারকে প্রতিস্থাপনের জন্য ১৯৯১ সালে পঞ্চম কার্যক্ষম (এবং মোট ছয়টি) পরিক্রমাকারী যান নির্মিত হয়। স্পেস শাটল ২০১১ সালের ২১ জুলাই আটলান্টিসের চূড়ান্ত উড়ানের সমাপ্তির পরে পরিষেবা থেকে অবসর গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্র শেষ শাটল উড়ান থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক নভোচারী কর্মসূচির অংশ হিসাবে স্পেসএক্সের ফ্যালকন ৯ রকেটে ২০২০ সালের মে মাসে ডেমো-২ অভিযানের যাত্রা পর্যন্ত আইএসএস-এ নভোচারীদের পরিবহনের জন্য রুশ সয়ুজ মহাকাশযানের উপর নির্ভর করে।[]

বোয়িং এক্স-৩৭

সম্পাদনা

চীনের পুনঃব্যবহারযোগ্য পরীক্ষামূলক মহাকাশযান

সম্পাদনা

উপকক্ষীয় মহাকাশ বিমান

সম্পাদনা
 
উড্ডয়নের সময় নর্থ আমেরিকান এক্স-১৫

২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, দুটি উপকক্ষীয় রকেটচালিত বিমান কার্মান রেখা (১০০ কিমি) অতিক্রম করে মহাকাশে পৌঁছেছে: নর্থ আমেরিকান এক্স-১৫স্পেসশিপওয়ানস্পেসশিপটু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংজ্ঞা অনুযায়ী ৮০ কিমি উচ্চতা অতিক্রম করে মহাকাশে পৌঁছেছে, যদিও এটি উচ্চতর কার্মান রেখা অতিক্রম করতে পারেনি। এর কোনোটিই কক্ষপথে প্রবেশের যোগ্য নয়, এবং উৎক্ষেপণের আগে এদের বাহক বিমানের মাধ্যমে উচ্চ উচ্চতায় উত্তোলন করা হয়েছিল।

বর্তমান উন্নয়ন কর্মসূচি

সম্পাদনা
 
আরএলভি-টিডি, যা ২০২৪ সাল থেকে "পুষ্পক" নামে পরিচিত।

২০১৬-এর হিসাব অনুযায়ী, ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) রিইউজেবল লঞ্চ ভেহিকল (আরএলভি) বলে এক উৎক্ষেপণ যানের উন্নয়ন সম্পন্ন করছে। এটি ভারতের এক টু-স্টেজ-টু-অরবিট পুনঃব্যবহারযোগ্য উৎক্ষেপণ যান নির্মাণের প্রাথমিক ধাপ, যার দ্বিতীয় স্টেজ একটি মহাকাশ বিমান। বিমানটি রকেট ইঞ্জিন ও বায়ুচালিত স্ক্র্যামজেট ইঞ্জিন দ্বারা চালিত হবে। ২০১৬ সালে ইসরো ক্ষুদ্রাকৃতি মহাকাশ বিমান ও একটি কার্যকরী স্ক্র্যামজেট নিয়ে পরীক্ষা সম্পন্ন করেছিল।[]

এপ্রিল ২০২৩-এ ভারত ঐ মহাকাশ বিমানের এক ক্ষুদ্রাকৃতি প্রতিরূপের এক স্বয়ংক্রিয় অবতরণ মিশন সম্পন্ন করেছিল।[] এই আরএলভি প্রতিরূপকে চিনুক হেলিকপ্টার থেকে ৪.৫ কিমি উচ্চতায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল এবং কর্ণাটকের চিত্রদুর্গ এরোনটিকাল টেস্ট রেঞ্জের এক রানওয়েতে এর স্বয়ংক্রিয় গ্লাইডিং সম্পন্ন হয়েছিল।[] ২০২৪ সালের মার্চ মাসে এই মহাকাশ বিমানের নাম "পুষ্পক" রাখা হয়েছিল।[]

অন্যান্য প্রস্তাবিত মহাকাশ বিমান

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Chang, Kenneth (২০ অক্টোবর ২০১৪)। "25 Years Ago, NASA Envisioned Its Own 'Orient Express'"দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। সংগ্রহের তারিখ ২১ অক্টোবর ২০১৪ 
  2. Piesing, Mark (২২ জানুয়ারি ২০২১)। "Spaceplanes: The return of the reusable spacecraft?"বিবিসি। সংগ্রহের তারিখ ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ 
  3. Launius, Roger D. (১৯৬৯)। "Space Task Group Report, 1969"। NASA। ডিসেম্বর ২৪, ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ২২, ২০২০ 
  4. Malik, Tarik (জুলাই ২১, ২০১১)। "NASA's Space Shuttle By the Numbers: 30 Years of a Spaceflight Icon"। Space.com। সংগ্রহের তারিখ জুন ১৮, ২০১৪ 
  5. Smith, Yvette (২০২০-০৬-০১)। "Demo-2: Launching Into History"NASA। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০২-১৮ 
  6. "India's Reusable Launch Vehicle-Technology Demonstrator (RLV-TD), Successfully Flight Tested"। Indian Space Research Organisation। ২৩ মে ২০১৬। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬ 
  7. "Reusable Launch Vehicle Autonomous Landing Mission (RLV LEX)"www.isro.gov.in। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৪-০২ 
  8. "Isro reusable launch vehicle's landing experiment successful; RLV closer to orbital re-entry mission"The Times of India। ২০২৩-০৪-০২। আইএসএসএন 0971-8257। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৪-০২ 
  9. "India's Reusable Launch Vehicle to be called Pushpak, PM reviews progress"India Today (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৩-১৫ 

গ্রন্থপঞ্জি

সম্পাদনা
  • Hacker, Barton C.; Grimwood, James M. (১৯৭৭)। On the Shoulders of Titans: A History of Project Gemini। Washington, D.C.: NASA। ওসিএলসি 3821896। NASA SP-4203। ৭ ডিসেম্বর ২০০৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ মে ২০১৫ 
  • Kuczera, Heribert; Sacher, Peter W. (২০১১)। Reusable Space Transportation Systems। Berlin: Springer। আইএসবিএন 978-3-540-89180-2 

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা