মনজুর আলম বেগ
মনজুর আলম বেগ (১ অক্টোবর ১৯৩১ - ২৬ জুলাই ১৯৯৮) হলেন বাংলাদেশে আলোকচিত্র আন্দোলনের পথিকৃৎ, যিনি এম এ বেগ বা বেগ স্যার এবং আলোকচিত্রাচার্য হিসাবেই বেশি পরিচিত। জাতীয় পর্যায়ে অনন্য অবদানের জন্য ২০০৭ সালে তাকে একুশে পদক প্রদান করা হয়।
মনজুর আলম বেগ | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ২৬ জুলাই ১৯৯৮ | (বয়স ৬৭)
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
পেশা | আলোকচিত্রশিল্পী |
পরিচিতির কারণ | বাংলাদেশে চারুকলা আলোকচিত্র আন্দোলন |
বাংলাদেশের প্রথম ফটোগ্রাফি শিক্ষা কেন্দ্র বেগ আর্ট ইন্সটিটিউট অফ ফটোগ্রাফী (১৯৬০) এবং বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটির (১৯৭৬) প্রতিষ্ঠাতা আলোকচিত্রাচার্য মনজুর আলম বেগ তার ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি এবং ক্লাব গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখেন। যার কারণে চট্টগ্রাম ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, ঢাকা সিনেসিক ক্লাব, ব্রাহ্মনবাড়ীয়া ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, রাজশাহী ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি এবং দিনাজপুর ফটোগ্রাফিক সোসাইটি গঠিত হয়।[১]
জন্ম
সম্পাদনামনজুর আলম বেগ রাজশাহীর নবাবগঞ্জের শ্যামপুর গ্রামে ১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা প্রফেসর হোসামউদ্দিন বেগ । তার মাতার নাম যাহেদা চৌধুরী।
শিক্ষা জীবন
সম্পাদনামনজুর আলম ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৯ সালে এইচ.এস.সি. পাশ করেন ঢাকা বোর্ড থেকে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।
তিনি ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান এয়ার ফোর্স টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে আলোকচিত্র বিষয়ে এবং ১৯৫৭ সালে ইউনেস্কোর অধীনে মাইক্রোফিল্ম বিষয়ে করাচীতে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত বৃত্তি লাভ করে তিনি রিপোগ্রাফী বিষয়ে ইংল্যান্ডে হ্যাটফিল্ড কলেজ অফ টেকনোলজীর ন্যাশনাল রিপোগ্রাফীক সেন্টার ফর ডকুমেন্টেশন-এ প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ঐ সালেই তিনি লন্ডনের কোডাক ফটোগ্রাফীক স্কুলে রঙ্গিন ফটোগ্রাফী বিষয়ক ট্রেনিং লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ইংল্যান্ডে “ ব্রিটিশ ইন্সটিটিউট অফ ইনকরপোরেটেড ফটোগ্রাফারস ” (IIP) থেকে ফটোগ্রাফী ডিপ্লোমা করেন। ১৯৭৬ সালে ইংল্যান্ডের ইন্সটিটিউট অফ রিপোগ্রাফিক টেকনোলজীতে AMIRT পেশাদারী যোগ্যতার জন্য দরখাস্ত করেন কিন্তু তাকে একধাপ উপরে MIRT যোগ্যতাটি দেয়া হয়। ১৯৭৬ সালেই তিনি ইউনেস্কোর বৃত্তি লাভ করে বাংলাদেশ সরকার থেকে থাইল্যান্ডে ফেডারেশন অফ ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্টেশন এর ৪র্থ কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৮০-৮১ সালে ভারত সরকার এবং ইউনেস্কোর যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত “TRAINING COURSE FOR INFORMATION CENTRE MANAGERS” শির্ষক প্রশিক্ষণে নিউদিল্লীতে অংশগ্রহণ করেন।
পেশা জীবন
সম্পাদনা১৯৪৯-৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি ফটোগ্রাফী বিষয়ে পাকিস্তান এয়ারফোর্সে চাকুরি করেন। তিনি সেখানে স্থির, মুভী এবং এরিয়াল ফটোগ্রাফী বিষয়ে এয়ার ফোর্সের করাচি, লাহোর, পেশোয়ার, কোয়েটা ইত্যাদি বিভিন্ন স্টেশনে কাজ করেন। ১৯৫৫-৫৭ সালে তিনি ঢাকা এবং ময়মনসিংহে ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সারভিস (USIS) অফিসে মোশন পিকচার্স সেকশনে চাকুরি করেন। ১৯৫৭-৬০ সাল পর্যন্ত তিনি চাকুরি করেন করাচিতে CSIR এর অধীনে প্যান্সডকে। ১৯৬৩ সালে ঢাকায় যখন সায়েন্স ল্যাবরেটরীতে প্যান্সডকের শাখা অফিস খোলা হয় তখন সিনিয়ার রিপোগ্রাফিক অফিসার পদে যোগ দেন এবং ১৯৮৮ সালে তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের অধীনে ব্যান্সডক থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
শিক্ষকতা
সম্পাদনা১৯৬০ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত বেগার্ট ইন্সটিটিউট অফ ফটোগ্রাফীতে তিনি ফটোগ্রাফী বিষয়ে ৩৮ বছর শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৬১-৬৩ সাল পর্যন্ত তিনি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অডিও ভিজুয়াল সেন্টারে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন । ১৯৭৫-১৯৭৭ সালে তিনি খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে।
উপদেষ্ঠা
সম্পাদনাতিনি বারডেমে ফটোগ্রাফী বিষয়ের উপদেষ্ঠা হিসেবে তিন বছর কাজ করেছেন । তিনি বাংলা একাডেমী, জাতীয় প্রেস ইন্সটিটিউট, এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তে রিসোর্স পারসোনাল হিসেবে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে তিনি ফটোগ্রাফী উপদেষ্টা প্যানেলের সভাপতি ছিলেন বেশ কয়েক বছর।
বিচারক
সম্পাদনাতিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় বিচারকের দ্বায়িত্ব পালন করেন। এরমধ্যে রয়েছে শিল্পকলা, ইউনেস্কো, ইউনিসেফ, পর্যটন এবং বিভিন্ন সোসাইটি আয়োজিত জাতীয় প্রতিযোগিতাসমূহ। সার্ক দেশ সমূহের মধ্যে আয়োজিত প্রদর্শনিগুলোতেও তিনি বিচারকের দ্বায়িত্ব পালন করেন। তারসাথে অন্যান্য যারা বিচারকের ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, শিল্পী কামরুল হাসান, শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার, চিত্র পরিচালক আলমগীর কবির প্রমুখ।
প্রাপ্ত পুরস্কার
সম্পাদনাপ্রতিযোগিতার নাম | স্থান | সাল | পুরস্কার |
---|---|---|---|
সেন্ট ফটো কনটেস্ট | আংকারা | ১৯৬৮ | ব্রঞ্জ |
ইউনেস্কো | জাপান | ১৯৭৬ | সনদ |
ইউনেস্কো | জাপান | ১৯৭৭ | রোটারী |
হন-ডিপ্লোমা | রাশিয়া | ১৯৭৭ | সনদ |
কমনওয়েলথ | কানাডা | ১৯৭৭ | দুটি সম্মান |
ফটোকিনা | জার্মানি | ১৯৭৮ | প্রথম |
ইউনেস্কো | জাপান | ১৯৭৮ | ফুজি |
পেন্টাকস | ইংল্যান্ড | ১৯৮৬ | প্রথম |
ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড আই | আমেরিকা | ১৯৮৬ | প্রথম |
ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড আই | আমেরিকা | ১৯৮৭ | প্রথম |
প্রকাশনা
সম্পাদনা১৯৫৭ সালে তার ফটোগ্রাফী বিষয়ে প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় “দিগন্ত” পত্রিকায়, করাচিতে। “আলোকচিত্রে আরবের দান” ছাপা হয় দৈনিক ইত্তেফাকে ৭০ দশকে। কোলকাতা থেকে “ফটোগ্রাফী চর্চা” এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত মাসিক “ফটোগ্রাফী” পত্রিকায় প্রায় প্রতিটি সংখ্যায় তার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে।
ফটোগ্রাফী বিষয়ক বই
সম্পাদনা- REPORT ON REPROGRAPHY ১৯৬৮ সালে লন্ডন থেকে এবং
- আধুনিক ফটোগ্রাফী, ১৯৭৪ সালে ভারত থেকে প্রকাশিত হয় । এ ছাড়াও
- ফটোগ্রাফী ফরমূলা, ১৯৭৪
- ফটোগ্রাফী ডাইজেস্ট, ১৯৮১
- রঙ্গিন প্রিন্ট করা, ১৯৮১
- মাইক্রোফিল্ম কি ও কেন? ১৯৯০
- RURAL BANGLADESH ,১৯৯৩
- আলোকচিত্র সাদাকালো ও রঙ্গিন, ১৯৯৩ ও
- ডার্করূম সলিউশন, ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয় ।
অন্যান্য বই
সম্পাদনা- বিশ্ব-ভাষা, ১৯৮৩ সালে এবং মআবের কবিতা, ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়।
সম্পাদনা
সম্পাদনাতিনি বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটির BPS NEWSLETTER এর সম্পাদনা ও প্রকাশনা শুরু করেন ১৯৭৮ সালে। এবং দেশের প্রথম ও একমাত্র ফটোগ্রাফী বিষয়ক “মাসিক ফটোগ্রাফী” পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন ১৯৯১ সাল থেকে। দৈনিক বাংলায় তিনি “কোন ছবি কেন ভাল” বিষয়ে নিয়মিত সমালোচনা লিখেছেন ১৯৯২ সালে।
সাংগঠনিক তৎপরতা
সম্পাদনাসে সময় বেগার্ট ইন্সটিটিউট অফ ফটোগ্রাফী এবং বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা সহ জনাব বেগ তার ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি এবং ক্লাব গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখেন। যার কারণে চট্টগ্রাম ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, ঢাকা সিনেসিক ক্লাব, ব্রাহ্মনবাড়ীয়া ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, রাজশাহী ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি এবং দিনাজপুর ফটোগ্রাফিক সোসাইটি গঠিত হয় । ঐ সকল ক্লাব গুলোকে এক পতাকার নিচে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে আলোকচিত্রাচার্য মঞ্জুর আলম বেগ বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটিকে ফেডারেশনে উন্নীত করেন। যার ফলশ্রুতিতে বিপিএস আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফিক ফেডারেশনের (FIAP) সদস্যপদ লাভ করে আরো শক্তিশালী হয়।[২]
সম্মাননা
সম্পাদনাফটোগ্রাফী উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষ অবদান রাখার জন্য এম এ বেগকে দুর্লভ সম্মানে ভূষিত করেছে ফটোগ্রাফি বিষয়ক বাংলাদেশের সোসাইটিগুলো, পার্শ্ববর্তী দু’টি দেশ ভারত ও শ্রীলঙ্কা এবং আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফিক ফেডারেশন FIAP থেকে। বাংলাদেশে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি থেকেও তাকে সর্বোচ্চ পেশাদারী যোগ্যতার ফেলোশিপ সনদ (FBPS) প্রদান করা হয় ১৯৮৪ সালে।
- ১৯৮২ সালে ভারতে প্রথম আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফী সন্মেলন হয় কোলকাতায়। এখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এম এ বেগ সহ মোট এগারোজনকে ফটোগ্রাফী বিষয়ক শ্রেষ্ঠ ফেলোশিপ (Hon.FPAD) সম্মানে ভূষিত করা হয়। এ সম্মান দলিল হস্তান্তর করেন বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় ।
- ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি Hon. Fellowship (Hon.FBPS) সম্মানে তাকে ভূষিত করে।
- ১৯৮৩ সালে ওয়ার্ল্ডভিউ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন নামের একটি জাতিসংঘ অনুমোদিত আন্তর্জাতিক সংগঠন জনাব বেগকে আজীবন সদস্যপদ প্রদান করে শ্রীলঙ্কায় অবস্থিত তাদের কেন্দ্রীয় দফতর থেকে।
- ১৯৮৬ সিনেসিক পদক।
- ১৯৮৭ সালে The International Federation of Photographic Art (FIAP) জার্মানিতে অনুষ্ঠিত তাদের ১৯তম কংগ্রেসে জনাব বেগকে ESFIAP (FIAP Excellence for Services Rendered) সম্মানে ভূষিত করে।
- ১৯৯১ সালে নিউ দিল্লীর ইন্ডিয়া-ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফি কাউন্সিল থেকে জনাব বেগকে ASIIPC সম্মানে ভূষিত করা হয়।
- চলচ্চিত্র নির্মাতা মৃণাল সেন ১৯৯৭ সালে কোলকাতা বই মেলাতে দুই বাংলাতে ফটোগ্রাফী উন্নয়ণে বিশেষ অবদান রাখার জন্য জনাব বেগকে ফটোগ্রাফি চর্চা পদক প্রদান করেন ।
- ইন্ডিয়া-ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফি কাউন্সিল ১৯৯৭ সালে বিশ্ব আলোকচিত্র দিবসে জনাব বেগকে FSIPC সম্মান প্রদান করে ।
- বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি ৯ জুলাই, ১৯৯৮ সালে তাকে আলোকচিত্রের সর্বোচ্চ সম্মান 'আলোকচিত্রাচার্য' উপাধিতে ভূষিত করে।
মৃত্যু
সম্পাদনাএই মহান শিল্পী ১৯৯৮ সালের ২৬শে জুলাই মৃত্যু বরন করেন।
আরোও দেখুন
সম্পাদনাবহিঃসংযোগ
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ সেলিম, জাহাঙ্গীর। আলোকচিত্রাচার্য মনজুর আলম বেগ (1 সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: প্যাপিরাস।
- ↑ "মনজুর আলম বেগ ।। এক আলোকবর্তিকার নাম"। ২০১৬-০৮-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ আগস্ট ২০১৬।