মদনটাক
মদনটাক (বৈজ্ঞানিক নাম: Leptoptilos javanicus), মদনটেঁক বা ছোট মদনটাক সিকোনিডাই পরিবারভূক্ত লেপ্টোপ্টাইলোস (Leptoptilos) গণের এক বৃহদাকৃতির জলচর পাখি। এ গণের অন্যান্য প্রজাতির ন্যায় এরও নগ্ন ঘাড় এবং মাথা রয়েছে। জলাভূমিতে বিচরণরত অন্যান্য জলচর পাখির সাথে এর বেশ মিল রয়েছে। সাধারণতঃ এটি একাকী চলাফেরা করতে ভালবাসে। দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে এদের দেখা মেলে।
মদনটাক Leptoptilos javanicus | |
---|---|
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস | |
জগৎ: | প্রাণীজগৎ |
পর্ব: | কর্ডাটা |
শ্রেণী: | পক্ষী |
বর্গ: | Ciconiiformes |
পরিবার: | সাইকোনিডি |
গণ: | লেপ্টোপ্টাইলোস |
প্রজাতি: | L. javanicus |
দ্বিপদী নাম | |
Leptoptilos javanicus হর্সফিল্ড, ১৮২১ |
বিবরণ
সম্পাদনাবৃহদাকৃতির মদনটাকের সম্মুখাংশে নগ্ন বা টেকো মাথা এবং ঘাড় ছাড়াও বড় ধরনের অনুজ্জ্বল হলদে চঞ্চু রয়েছে। গড়পড়তা এদের দৈর্ঘ্য ৮৭-৯৩ সেন্টিমিটার (৩৪-৩৭ ইঞ্চি) হয়ে থাকে। ওজন চার থেকে ৫.৭১ কিলোগ্রাম (৮.৮ থেকে ১২.৬ পাউন্ড) এবং পায়ের উচ্চতা ১১০-১২০ সেন্টিমিটার (৪৩-৪৭ ইঞ্চি)।[২][৩][৪] এ গোত্রের সন্দেহজনক প্রজাতি হিসেবে রয়েছে হাড়গিলা। কিন্তু এদের চেয়ে সাধারণতঃ মদনটাক আকারে ছোট হয়ে থাকে এবং সরলাকৃতির চঞ্চু রয়েছে। চঞ্চু লম্বায় ২৫.৮-৩০.৮ সেন্টিমিটার (১০.২-১২.১ ইঞ্চি)। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠের দিক উজ্জ্বল কালো। দেহতল সাদা। ডানার গোড়ায় কালো তিলা থাকে। এছাড়া ডানার মধ্যপালক-ঢাকনি, কাঁধ-ঢাকনি ও ডানার বর্ণ কালো। ডানা-ঢাকনি ও ডানার ভেতরের বড় পালক-ঢাকনির পাড় সরু সাদা। টাক মাথার চাঁদি ও ঘাড়ে হলদে-ধূসর রঙের বিক্ষিপ্ত চুলের মত পালক থাকে। পালকহীন মুখের চামড়া ও ঘাড় লালচে। গলা হলদে বা লালচে। চোখ সাদা কিংবা স্লেট-ধূসর। পা লম্বা। পায়ের পাতা, নখর ও পা সবজে-ধূসর থেকে স্লেট কালো। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথা ও ঘাড়ে বিক্ষিপ্ত ঘন পালক থাকে। পিঠ অনুজ্জ্বল কালো।[৫]
আবাসস্থল
সম্পাদনামদনটাক বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ছোট মদনটাক প্রায়শই বড় নদী এবং হ্রদগুলির ভেতরে ভাল জঙ্গলযুক্ত অঞ্চলে, কৃষি এলাকায় মিঠা পানির জলাভূমিতে এবং কর্দমাক্ত সমতলভূমি এবং বাদাবনসহ উপকূলীয় জলাভূমিতে পাওয়া যায়।[৬] এটা ভারত,[৭] নেপাল,[৮] শ্রীলঙ্কা,[৯] বাংলাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, লাওস[১০], ইন্দোনেশিয়া এবং কম্বোডিয়ায় এদের প্রধান আবাসস্থল। সিঙ্গাপুর থেকে এরা আঞ্চলিকভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। চীনেও সম্ভবত এরা বিলুপ্ত।[১] ভারতের আসাম, পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহার প্রদেশে এদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান। এছাড়াও ভুটানের দক্ষিণাংশেও এদেরকে মাঝে মাঝে দেখা যায়।[১১] কিন্তু ভারতের দক্ষিণাংশে এদের সংখ্যা খুবই বিরল।[১২][১৩] শ্রীলঙ্কায়, তারা মূলত সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে নিম্নভূমি অঞ্চলে পাওয়া যায়, যদিও তারা বনজ জলাভূমি এবং ফসলের খেতগুলিও ব্যবহার করে।[৯] নেপালে, পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলিতে জরিপগুলি থেকে উপলব্ধ হয়েছে যে তারা অগ্রাধিকারমূলকভাবে ছোট জলাভূমি সহ বনের অংশগুলি ব্যবহার করে, মূলত ফসলের ক্ষেতগুলি এড়িয়ে যায়। তবে অন্যান্য গবেষণায়, বিপরীত তথ্য দেখা গেছে - নেপালের নিম্নভূমি অপেক্ষা ফসলের জমিতে ছোট মদনটাকের প্রজনন ঘনত্ব এবং প্রজনন সাফল্য অনেক বেশি।.[১৪][১৫][১৬]
বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ১৯২৯ সালে বেকার সিলেটে মদনটাকের একটি কলোনি দেখেছিলেন। এরপরে ১৯৯৯ সালে পাখি গবেষক পল থমসন ২৫টির মতো পাখি দেখেছেন সুন্দরবনে। তবে বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ রেজা খানের মতে, তিনি ২০০৪ সালে পঞ্চগড়ের একটি গ্রামের শিমুলগাছে এক জোড়া মদনটাককে বাসা করতে দেখেছিলেন। মাঝেমধ্যে দু-একটি পাখি দেখা গেছে চলনবিল, পাবনা, টেকনাফ, হাকালুকি হাওর, সোনাদিয়া দ্বীপ ও সুন্দরবনের কচিখালিতে।[১৭]
বাংলাদেশে মদনটাকের আবাস
সম্পাদনাএ পাখি সাধারণত বড় কোনো বিলের কাছে, নদীর মোহনার কাছাকাছি নিরাপদ স্থানে বাস করে। তবে এই পাখি সারা বিশ্বে বিপন্ন ও বিরল হিসেবে পরিচিত মদনটাককে স্থানীয়ভাবে অনেকে হারগিলাও বলে থাকে। ২০১১ সালে ঠাকুরগাঁয়ের হরিপুরের সিংহারী গ্রামে অনুপ সাদির তথ্য মতে সৌরভ মাহমুদ ও সায়েম ইউ চৌধুরী ২৪টি মদনটাকের সন্ধান পেয়েছিলেন। ঐ গ্রামে একটি শিমুলগাছে ২০০৭ সাল থেকে বাসা বেঁধে ছানা তুলতো এই পাখি। আইনুল হক ও তার বড় ভাই শামসুল হকের রক্ষণাবেক্ষণে ও গ্রামের মানুষের সহযোগিতায় এই পাখির সংখ্যা বাড়তে থাকে। তবে বর্তমানে এই পাখির সংখ্যা কম ও অনিয়মিত।[১৭]
জীববৈচিত্র্য
সম্পাদনামদনটাক প্রধানত জলচর পাখি হিসেবে পরিচিত। মাছ, ব্যাঙ, সরীসৃপ এবং অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণী ভক্ষণ করে থাকে। কদাচিৎ এরা গলিত পচা মাংস খেয়ে থাকে। এছাড়াও এরা ছোট ছোট পাখি এবং ইঁদুরজাতীয় প্রাণীও প্রজনন মৌসুমের খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। প্রজনন মৌসুম ব্যতীত একাকী নিভৃতচারী পাখি হিসেবে এরা পরিচিত।[২] ভারতের দক্ষিণাংশে ফেব্রুয়ারি থেকে মে এবং উত্তর-পূর্বাংশে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এরা বাসা বাঁধে।[১৮] বড় বড় ডালপালা দিয়ে উঁচু বৃক্ষের শাখায় এরা ডিম পাড়ে। বাসার ব্যাসার্ধ এক মিটারের চেয়েও অধিক এবং এক মিটার পর্যন্ত বাসার গভীরতা।[২] স্ত্রীজাতীয় মদনটাক তিন থেকে চারটি পর্যন্ত ডিম পাড়ে।[১৮][১৯] এরা তেমন আওয়াজ করে না কিন্তু বাসায় এরা ঠোঁটের সাহায্যে কিছু আওয়াজ করে।[২০]
চিত্রশালা
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ BirdLife International (২০১২)। "Leptoptilos javanicus"। বিপদগ্রস্ত প্রজাতির আইইউসিএন লাল তালিকা। সংস্করণ 2012.1। প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুলাই ২০১২।
- ↑ ক খ গ Ali, S & SD Ripley (1978). Handbook of the Birds of India and Pakistan. Volume 1 (2 ed.). New Delhi: Oxford University Press. pp. 107–109.
- ↑ Elliot, A. (1994). "Order Ciconiiformes. Family Ciconiidae (Storks)". In del Hoyo, J., A. Elliot & J. Sargatal. Handbook of the Birds of the World. Volume 1. Ostrich to Ducks. Barcelona, Spain: Lynx Edicions. pp. 436–465.
- ↑ Hancock & Kushan, Storks, Ibises and Spoonbills of the World. Princeton University Press (1992), আইএসবিএন ৯৭৮-০-১২-৩২২৭৩০-০
- ↑ জিয়া উদ্দিন আহমেদ (সম্পা.) (২০০৯)। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ: পাখি, খণ্ড: ২৬। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৩০৬–৭। আইএসবিএন 9843000002860
|আইএসবিএন=
এর মান পরীক্ষা করুন: invalid prefix (সাহায্য)। - ↑ Subaraj, R.; Lok, A. F. S. L. (২০০৯)। "Status of the Lesser Adjutant (Leptoptilos javanicus) in Singapore"। Nature in Singapore। 2: 107–113।
- ↑ "Biswanath youths join hands to protect bortukulas"। The Assam Tribune। 84 (263): 8। ২০২২-০৯-২৮।
- ↑ Baral HS (২০০৫)। "Surveys for Lesser Adjutant Leptoptilos javanicus in and around Koshi Tappu Wildlife Reserve, Nepal" (পিডিএফ)। Forktail। 21: 190–193। ১১ অক্টোবর ২০০৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ অক্টোবর ২০১২।
- ↑ ক খ de Silva, Thilina, N.; Fernando, Sumundu; de Silva, Haritha, B.; Tennakoon, Parami (২০১৫)। "Lesser Adjutant Leptoptilos javanicus Horsfield, 1821 (Ciconiiformes: Ciconiidae) in the dry lowlands of Sri Lanka: distribution, ecology, and threats"। Journal of Threatened Taxa। 7 (14): 8089–8095। আইএসএসএন 0974-7893। ডিওআই:10.11609/jott.2425.7.14.8089-8095 ।
- ↑ Subaraj R and A. F. S. L. Lok (২০০৯)। "Status of the Lesser Adjutant Stork (Leptoptilos javanicus)" (পিডিএফ)। Nature in Singapore। 2: 107–113। ১৫ জুলাই ২০১২ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ অক্টোবর ২০১২।
- ↑ Choudhury, A. (২০০৫)। "First record of Lesser Adjutant Leptoptilos javanicus for Bhutan" (পিডিএফ)। Forktail। 21: 164–165। ১১ অক্টোবর ২০০৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ অক্টোবর ২০১২।
- ↑ Andheria, A. P. (২০০১)। J. Bombay Nat. Hist. Soc.। 98 (3): 443–445।
|শিরোনাম=
অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য) - ↑ Andheria, A. (২০০৩)। "First sighting of lesser adjutant-stork Leptoptilos javanicus from Sanjay Gandhi National Park, Mumbai"। J. Bombay Nat. Hist. Soc.। 100 (1): 111।
- ↑ Sundar, K.S.G.; Maharjan, Bijay; Koju, Roshila; Kittur, Swati; Gosai, Kamal Raj (২০১৬)। "Factors Affecting Provisioning Times of Two Stork Species in Lowland Nepal"। Waterbirds। 39 (4): 365–374। ডিওআই:10.1675/063.039.0406 ।
- ↑ Sundar, K.S. Gopi; Koju, Roshila; Maharjan, Bijay; Marcot, Bruce G.; Kittur, Swati; Gosai, Kamal Raj (২০১৯)। "First assessment of factors affecting the breeding success of two stork species in lowland Nepal using Bayesian Network models]"। Wildfowl। 69: 45–69।
- ↑ Katuwal, Hem B.; Sundar, K. S. Gopi; Zhang, Mingxia; Rimal, Bhagawat; Baral, Hem S.; Sharma, Hari P.; Ghimire, Prashant; Hughes, Alice C.; Quan, Rui-Chang (২০২২)। "Factors affecting the breeding ecology of the globally threatened Lesser Adjutant (Leptoptilos javanicus) in agricultural landscapes of Nepal"। Avian Conservation and Ecology। 17 (2): 15। ডিওআই:10.5751/ACE-02235-170215 ।
- ↑ ক খ মাহমুদ, সৌরভ; চৌধুরী, সায়েম ইউ (২০১১-১০-০১)। "বেঁচে থাক মদনটাক"। দৈনিক প্রথম আলো। ঢাকা। ২০১৯-০৯-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-২৫।
- ↑ ক খ Baker, ECS (১৯২৯)। Fauna of British India. Birds. Volume 6 (2 সংস্করণ)। London: Taylor and Francis। পৃষ্ঠা 329–330।
- ↑ Maust, M., Clum, N. and Sheppard, C. (২০০৭)। "Ontogeny of chick behavior: a tool for monitoring the growth and development of lesser adjutant storks"। Zoo Biol.। 26 (6): 533–538। ডিওআই:10.1002/zoo.20156। পিএমআইডি 19360599।
- ↑ Rasmussen PC & JC Anderton (2005). Birds of South Asia. The Ripley Guide. Volume 2. Washington DC and Barcelona: Smithsonian Institution and Lynx Edicions. p. 64.
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- Photographs and videos ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১২ আগস্ট ২০১২ তারিখে