মথুরমোহন বিশ্বাস
মথুরমোহন বিশ্বাস বা মথুরানাথ বিশ্বাস (১৮১৭ — ১৬ জুলাই, ১৮৭১) ছিলেন সেজোবাবু নামে পরিচিত রাণী রাসমণির তৃতীয় ও কনিষ্ঠ জামাতা এবং শ্রীরামকৃষ্ণের পরমভক্ত, শিষ্য, সেবক ও রসদদার। [১]
মথুরমোহন বিশ্বাস | |
---|---|
জন্ম | ১৮১৭ বিথারী গ্রাম, ২৪ পরগনা জেলা বৃটিশ ভারত |
মৃত্যু | ১৬ জুলাই ১৮৭১ |
দাম্পত্য সঙ্গী | করুণাময়ী বিশ্বাস (মৃ.১৮৩১) জগদম্বা বিশ্বাস |
সন্তান | ভূপাল (মাতা করুণাময়ী), দ্বারিক, ত্রৈলোক্যনাথ, ঠাকুরদাস (মাতা জগদম্বা) |
পিতা-মাতা | জয়নারায়ণ বিশ্বাস (পিতা) |
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন
সম্পাদনামথুরমোহনের জন্ম ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার স্বরূপনগরের বিথারী গ্রামের এক ধনী পরিবারে। পিতা জয়নারায়ণ বিশ্বাসের পাঁচ পুত্রের সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন মথুরমোহন। তাদের পূর্বপুরুষের আদি ভিটা ছিল অধুনা বাংলাদেশের সাতক্ষীরার সোনাবেড়ে গ্রামে।[২] তার পড়াশোনা কলকাতার তৎকালীন হিন্দু কলেজে।[৩]
মথুরমোহন ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে রাণী রাসমণির তৃতীয়া কন্যা করুণাময়ীকে বিবাহ করেন। তিনি রাণীর সেজো জামাতা হওয়ার জন্য ‘সেজোবাবু’ নামে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে করুণাময়ীর মৃত্যুর পর রাণী রাসমণি ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা জগদম্বার সহিত পুনরায় মথুরমোহনের বিবাহ দেন এবং জমিদারির বৈষয়িক কাজকর্ম দেখাশোনার জন্য নিজের গৃহেই রেখে দেন। তার বিরুদ্ধে তহবিল তছরুপের অভিযোগে রাণী একবার মামলা করছিলেন। শেষে অবশ্য রাণীমা পুত্র স্নেহে এবং জমিদারির প্রয়োজনে সে মামলা প্রত্যাহার করে নেন এবং মথুরমোহনও পরবর্তীতে অতি বিশ্বস্ততার সাথে সমস্ত কাজ করতেন।
কর্মজীবন
সম্পাদনা১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে মে দক্ষিণেশ্বের রাণী রাসমণি ভবতারিণীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করার পর মথুরমোহনই ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও নিজের দূরদৃষ্টি,বাস্তবতাবোধ ও গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনিই শ্রীঠাকুরকে দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণীর পূজক পদে নির্বাচন করেন, শ্রীঠাকুরের সমস্ত রকমের আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা প্রদান করেন। সেই সাথে দীর্ঘ ১৮ বৎসর তিনি ঠাকুরের অসাধারণ সেবা করেছিলেন। রাণী রাসমণির সম্মতিতে তিনি ঠাকুরের অন্নবস্ত্র, বাসস্থান, সুরক্ষা, তীর্থে দর্শন ইত্যাদির ব্যবস্থা করতেন। ঠাকুরের উপর ছিল তার অচল বিশ্বাস ও ভক্তি। তিনি নানারকম যুক্তি, পরীক্ষা দ্বারা ঠাকুরের অবতারত্ব সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হন, অবশেষে ঠাকুরের ন্যায় প্রকৃত কাম-কাঞ্চনত্যাগী সন্ন্যাসীর পায়ে আত্মনিবেদন করেন। একদা দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের দেহে একসঙ্গে শিব ও কালীমূর্তি দর্শন করেন। তিনি ঠাকুরকে জীবন সর্বস্ব রূপে গ্রহণ করেছিলেন ও সকল বিষয়েই তাঁর উপর নির্ভর করতেন। মথুর একবার বলেছিলেন—
"আমার স্ত্রী, সন্তান, সম্পত্তি এবং পদমর্যাদা সবকিছুই অবাস্তব।একমাত্র শ্রীরামকৃষ্ণই বাস্তব।"
[৪] অন্যদিকে ঠাকুরের পক্ষে দক্ষিণেশ্বরে — সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে সর্বরকমের সাধনায় সিদ্ধিলাভের পথে মথুরের ঐকান্তিক সেবা অপরিহার্য ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণও একবার সাধনকালে শ্রীজগদম্বার নিকট প্রার্থনা করেছিলেন—মা,আমাকে শুকনো সাধু করিস নি,রসেবসে রাখিস।[২] ঠাকুরের সাধনকালে সাধনার যাবতীয় সেবার ভার তিনি গ্রহণ করায় ঠাকুরও মথুরমোহনকে জগদম্বার লীলায় প্রধান রসদদার হিসাবে জানতেন।
মথুরানাথ বিশ্বাস সম্পর্কে স্বামী গম্ভীরানন্দ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ "শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্তমালিকা" গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন —
" মথুর বাবু ধনী অথচ উচ্চ প্রকৃতি সম্পন্ন, বিষয়ী হইলেও ভক্ত, হঠকারী হইয়াও বুদ্ধিমান, ক্রোধপরায়ণ হইলেও ধৈর্যশীল এবং ধীর প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি ইংরেজিবিদ্যাভিজ্ঞ ও তার্কিক, কিন্তু কেহ কোন কথা বুঝাইয়া দিতে পারিলে, উহা বুঝিয়াও বুঝিবে না — এমন স্বভাব সম্পন্ন ছিলেন না। তিনি ঈশ্বর বিশ্বাসী ও পরমভক্ত ছিলেন।
মৃত্যু
সম্পাদনা১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুলাই (১লা শ্রাবণ, ১২৭৮ বঙ্গাব্দ) বিকাল পাঁচটায় কলকাতার কালীঘাটে ৫৪ বৎসর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। [২] মথুরের মৃত্যুকালীন সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণ বেশ কয়েক ঘন্টা সমাধিস্থ ছিলেন, মথুরকে লক্ষ্যে পৌঁছানোর কামনায়। আশ্চর্যের বিষয়, মৃত্যুর পর পরই ঠাকুরের সমাধিভঙ্গ হয় আর মন্তব্য করলেন—
"শ্রীশ্রীজগদম্বার সখীগণ মথুরকে সাদরে দিব্যরথে উঠালেন — তার তেজ শ্রীশ্রীদেবীলোকে গেল।"
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতে উল্লিখিত ব্যক্তিবৃন্দের পরিচয়"। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-০৭।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ দ্বিতীয় খণ্ড, স্বামী গম্ভীরানন্দ (১৯৫২)। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্তমালিকা। কলকাতা: উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা। পৃষ্ঠা ১৩৪–১৫৪।
- ↑ Ghosh, Pranab Ranjan (১৯৬৮)। Ūnabiṃśa śatābdite Bāṅālīra manana o sāhitya: Rājā Rāmamohana Rāẏa theke Śrīrāmakr̥shna Paramahaṃsadeba। Lekhāpaṛā।
- ↑ "অন্তরঙ্গ: মথুরবাবু (ইংরাজীতে)"। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-০৭।