ভাবিনী মাহাতো
ভাবিনী মাহাতো(ইংরেজি: Bhabini Mahato, ( ১৯১৫? - ২৪ জুন ২০১৪) ছিলেন একজন বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী ও পৃথিবীতে ঘটা দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন তথা বাংলা ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী নেত্রী লাবণ্য প্রভা ঘোষের অন্যতম সহযোগী। [১]
ভাবিনী মাহাতো | |
---|---|
জন্ম | ১৯১৫ মানবাজার পুরুলিয়া, পশ্চিমবঙ্গ |
মৃত্যু | ২৪ জুন ২০১৪ |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
নাগরিকত্ব | ভারতীয় |
পরিচিতির কারণ | ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন, বাংলা ভাষা আন্দোলন (মানভূম) |
প্রথম জীবন
সম্পাদনাভাবিনী মাহাতোর জন্ম ব্রিটিশ ভারতের মানভূমের সামান্য এক চাষীর পরিবারে। লেখাপড়া কিছুই শেখেন নি। মাত্র নয় বৎসর বয়সেই তার বিবাহ হয়ে যায়। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় স্বাধীনতা সংগ্রামী অতুলচন্দ্র ঘোষ ও তার পত্নী লাবণ্য প্রভা ঘোষ স্থাপন করেছেন এক জনকল্যাণকারী সংস্থা "শিল্পাশ্রম"। এখানে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বিপ্লবীদের আনাগোনা ছিল। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে এখানে সভা করে গেছেন গান্ধিজী,সুভাষচন্দ্র বসু, সরোজিনী নাইডু প্রমুখেরা। সুভাষ বসুকে দেখে,গান্ধীজিকে দেখে এবং তাঁদের বক্তৃতা শুনে তের-চোদ্দ বৎসরের কিশোরী ভাবিনী মাহাতো হয়ে ওঠেন দেশপ্রেমিক। চার আনা দিয়ে কংগ্রেসের সদস্য হয়ে যান আর বাপুই হয়ে যান তার জীবনের আদর্শ। তখন চাষির মেয়ের কাছে সংসার নয়,দেশ হয়ে উঠেছে প্রধান।
স্বাধীনতা আন্দোলনে ভূমিকা
সম্পাদনাভাবিনী বিবাহের পর স্বামীগৃহে থাকেন নি, কংগ্রেসের সদস্য হওয়ার পর এবং স্বামীর মৃত্যুর পর ব্যক্তিগত জীবনের লড়াই শেষ করে দেশের ও দশের জন্য আসল লড়াইয়ে চলে আসেন "পুরুলিয়া জননী" নামে খ্যাত লাবণ্য প্রভা ঘোষের 'শিল্পাশ্রমে'। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ বিরোধী সমাবেশে স্লোগান দিয়ে গ্রেফতার হয়ে হাজারিবাগ জেলে ছয় মাস হাজতবাস করেছেন লাবণ্য প্রভা দেবীর সঙ্গে। আর ওই সময়েই তার কাছ থেকে বর্ণপরিচয় থেকে চিঠি লেখা পর্যন্ত আয়ত্ত করে নেন। এরপর নানা আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে তার নিজের গ্রামের "মাঝিহিড়া জাতীয় বিদ্যালয়" বাজেয়াপ্ত করে ব্রিটিশ বাহিনী। সেই বিদ্যালয়ের দখল নিতে গিয়ে বাঙালি সমিতির সদস্যদের সাথে গ্রেফতার হন তিনিও। জেল হয় নয় মাসের। এরপর ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে পূঞ্চা থানার এক গ্রামে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে চার মাসের কারাবাস ভোগ করেন। এভাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন স্বাধীনতা লাভের সময় পর্যন্ত।
বাংলা ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা
সম্পাদনাপ্রকৃতপক্ষে মানভূমের বাঙালিদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের সময়েই। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষার উপর হিন্দির আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার প্রতিবাদে মানভূম অঞ্চলে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে সেই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। বাংলাভাষী ও হিন্দিভাষীদের মধ্যে বিরোধ চরমে ওঠে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ৩০ ও ৩১মে পুরুলিয়ার শিল্পাশ্রমে। ১৩ জুন 'লোকসেবক সঙ্ঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন অতুলচন্দ্র ঘোষ, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত, সত্যকিঙ্কর মাহাতো, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, ভজহরি মাহাতো, জগবন্ধু ঘোষ, ভীমচন্দ্র মাহাতো, অরুণচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। এঁরা সকলেই গাঁধীজির আদর্শ মেনে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এবার তারাই গান্ধীজির কথা - ‘ভাষাগুলির পূর্ণ উৎকর্ষ লাভ করতে হলে ভাষা অনুসারে প্রদেশগুলির পূর্ণ ব্যবস্থা করা প্রয়োজন’ - অনুসরণ করে মাতৃভাষা রক্ষাই প্রথম ও প্রধান কর্তব্য স্থির করেন এবং শুরু করেন ভাষা সত্যাগ্রহ তথা টুসু সত্যাগ্রহ। পদযাত্রায় ও লঙমার্চে টুসু গানে প্রতিবাদের ভাষায় অংশ নিতেন ভাবিনীও। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে বিহার সরকার আন্দোলন দমনে নিরাপত্তা আইনের অজুহাতে ভাষা সত্যাগ্রহীদের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করলে ২২ জানুয়ারি লাবণ্যপ্রভা দেবী ও ভজহরি মাহাতো এবং ২৫ জানুয়ারি সমরেন্দ্রনাথ ওঝা, কুশধ্বজ মাহাতো, কালীরাম মাহাতো ও ভাবিনী স্বেচ্ছায় কারাববরণ করেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে প্রতিবাদী 'টুসু গান ও দেশাত্মবোধক 'বাংলার মাটি বাংলার জল'গানকে পাশে নিয়ে লোক সেবক সংঘের কর্মীদের সাথে ভাবিনীও পাকবিড়রা গ্রাম থেকে বাঁকুড়া,বেলিয়াতোড়,সোনামুখী, পাত্রসায়র, খন্ডঘোষ, বর্ধমান, পান্ডুয়া, মগরা,চুঁচুড়া, চন্দননগর,শ্রীরামপুর, হাওড়া হয়ে কলকাতা শহরের দিকে মহিলা সদস্য হিসাবে শান্তিপূর্ণ দীর্ঘপদযাত্রায় অংশ নিয়ে গ্রেফতার হন। [২] এই আন্দোলনে লাবণ্য প্রভা ঘোষের সাথে তিনি শিরোনামে আসেন। ফলস্বরূপ, বাঙালি অধ্যুষিত মানভূমের কিছু অংশ অধুনা পুরুলিয়া নামের জেলা হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয় ১লা নভেম্বর।
জীবনাবসান
সম্পাদনাস্বাধীনতা সেনানী ও সমাজসেবী ভাবিনী মাহাতো ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুন, মঙ্গলবার মানবাজারের মাঝিহিডা গ্রামে নিজের বাড়ীতে ৯৯ বৎসর বয়সে পরলোক গমন করেন। [১]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ "টুকরো খবর (২৭ জুন ২০১৪)"। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১০-৩০।
- ↑ "বড় ভূমিকা ছিল টুসু সত্যাগ্রহের"। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১০-৩১।