ভানুয়াতুর ইতিহাস
ভানুয়াতুর ইতিহাসের শুরুটা অনেকটাই অস্পষ্ট। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো পরীক্ষা করে ধারণা করা হয়, অস্ট্রোনেশীয় ভাষাভাষীরা প্রায় ৩,৩০০ বছর আগে ভানুয়াতু দ্বীপে আগমন করে। দ্বীপে কুমোরের ব্যবহার্য জিনিস পাওয়া গেছে, যা ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বের বলে শনাক্ত করা হয়েছে। [১] ভানুয়াতুর প্রাক- ইউরোপীয় যুগের ইতিহাস সম্পর্কে কিংবদন্তি ও মৌখিক ইতিহাস থেকে সামান্যই জানা যায়। রয় মাতা ছিলেন প্রাক-ইউরোপীয় যুগের একজন উল্লেখযোগ্য রাজা , যিনি একাধিক গোত্রকে ঐক্যবদ্ধ করায় সাফল্য প্রদর্শন করেন।
ইউরোপীয় যোগাযোগ
সম্পাদনা১৬০৬ সালে পর্তুগিজ অভিযাত্রী পেদ্রো ফার্নান্দেজ ডি কুয়েরোস প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে ভানুয়াতুতে পৌঁছান। তিনি একে " লা অস্ট্রিলিয়া দেল এসপিরিতু সান্তু", বা "পবিত্র আত্মার দক্ষিণ ভূমি" নামকরণ করেন। তাঁর ধারণা ছিল, তিনি অস্ট্রেলিয়ায় এসে পৌঁছেছেন। দ্বীপটির উত্তরাংশে স্পেনীয়রা ক্ষণস্থায়ী বসতি স্থাপন করে। "এসপিরিতু সান্তু" নামটি এখনো রয়ে গেছে। [২]
১৭৬৮ সালের পূর্বে ইউরোপীয়রা আর এ দ্বীপে পা রাখেনি। ঐ বছর লুই আঁতোয়ান দি বুগেনভিল এ দ্বীপটি পরিদর্শন করেন এবং এর নাম দেন "দ্য গ্রেট সাইক্লাদেস"। ১৭৭৪ সালে ক্যাপ্টেন কুক এর নাম দেন "দ্য গ্রেট হেবরিদেস"।
১৮২৫ সালে এরোমাঙ্গো দ্বীপে পিটার ডিলন চন্দনকাঠ আবিষ্কার করেন। তারপর এ দ্বীপে ইউরোপীয়দের যাতায়াত ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। ১৮৬০ সালে অস্ট্রেলিয়া, ফিজি, নিউ ক্যালিডোনিয়া সহ বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা "ব্ল্যাকবার্ডিং" নামক দাসত্ব প্রথার সূচনা করেন।
ভানুয়াতুর প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের প্রায় অর্ধেককে ধরে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে দাস হিসেবে খাটানো হয়। [২] ধারণা করা হয়, ভানুয়াতুর বর্তমান জনসংখ্যা এর প্রাক-ইউরোপীয় যুগের জনসংখ্যার চেয়ে অনেক কম। [৩]
এ সময়েই রোমান ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টান্ট মিশনারিরা এ দ্বীপে এসে পৌঁছান। ১৮৪৮ সালে আনেইটাম দ্বীপে স্কট-কানাডীয় মিশনারি জন গেড্ডি এসে পৌঁছান। গেড্ডি তার সমগ্র জীবন ভানুয়াতুর স্থানীয় বাসিন্দাদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করায় অতিবাহিত করেন। জন গিবসন প্যাটন গেড্ডির মতই ভানুয়াতুর প্রতি আরেকজন নিবেদিতপ্রাণ ধর্মযাজক ছিলেন।
তুলা আবাদের জন্য অনেক অভিবাসীই ভূমি অনুসন্ধান করতে থাকে। অনুসন্ধান করতে করতেই তারা ভানুয়াতু দ্বীপে এসে পৌঁছায়। তুলার দামের পতন ঘটলে তারা কফি,কোকো, কলা প্রভৃতি চাষে আগ্রহী হয়। অস্ট্রেলিয়ার ব্রিটিশ প্রজারা এই ফসল আবাদকারীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু ১৮৮২ সালে নিউ ক্যালিডোনিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠার ফলে ফ্রেঞ্চদের ব্যবসায়িক অবস্থান শক্তিশালী হতে শুরু করে। [৪]
ফ্রান্সভিল
সম্পাদনা১৮৭৮ সালে ইফাতে দ্বীপে ফ্রান্সভিল স্থানীয় প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭৮ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিউ হেব্রিদেসকে নিরপেক্ষ এলাকা ঘোষণা করে। [৫] কিন্তু দ্রুতই তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। ফ্রেঞ্চ আইন অনুসারে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতি বিবাহকে বৈধতা দান করবে। কিন্তু ফ্রেঞ্চ কর্তৃপক্ষ নিউ ক্যালিডোনিয়ায় অবস্থান করায় ভানুয়াতুর ফ্রেঞ্চদের অসুবিধার সৃষ্টি হয়। আবার, ব্রিটিশ যাজকদের সদর দপ্তর ফিজিতে অবস্থিত হওয়ায় ব্রিটিশদের বিবাহ নিবন্ধনেও জটিলতার সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় ১৮৮৯ সালের ৯ অক্টোবর ফ্রান্সভিল নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করে। এর প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন ফার্দিনান্দ শেভিল্যান্ড। ফ্রান্সভিল বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র যা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ভোটাধিকার প্রদান করে। তবে ভোট দিতে পারলেও কৃষ্ণাঙ্গরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারত না। আর ডি পোল্ক আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী ফ্রান্সভিলের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন।
কন্ডোমিনিয়াম
সম্পাদনাফ্রেঞ্চ ও ব্রিটিশদের স্বার্থের সংঘাত দেখা দিলে উভয় শক্তিই দ্বীপটি সম্পূর্ণভাবে দখল করার চেষ্টা করে। অবশেষে ১৮৮৭ সালে তারা একটি সম্মেলনেরর মাধ্যমে যৌথ নৌ কমিশন গঠন করে। নৌ কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চ নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষা করা, তবে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হতে বিরত থাকা। [৬]
তবে ১৯০৬ সাল থেকে দেশগুলো একত্রে ভানুয়াতু শাসনের উদ্যোগ নেয়। এই শাসনব্যবস্থার নাম ছিল "কন্ডোমিনিয়াম"। শুধু বিচারিক আদালত ছাড়া কন্ডোমিনিয়াম ব্যবস্থায় সরকারি যাবতীয় প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চদের মধ্যে দুই ভাগে স্বতন্ত্র ভাবে পরিচালিত হয়। ১৯১৪ সালে অ্যাংলো-ফ্রেঞ্চ চুক্তির আওতায় কন্ডোমিনিয়াম কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। ১৯২২ সালে চুক্তিটি আনুষ্ঠানিক অনুমোদন লাভ করে।[৩]
তবে যথাযথ সমন্বয়হীনতার অভাবে একে অনেকেই প্যান্ডেমোনিয়াম (বিশৃঙ্খলা) নামে অভিহিত করেন। তুলা ব্যবসায়ীরা ভানুয়াতুর নিরীহ মানুষদের কঠোরভাবে নিষ্পেষণ করত এবং তাদের জুয়ার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। জোসেলিন হারেউড ও মিশেল বেনেট "ভানুয়াতু"(১৯২০) গ্রন্থে এর মর্মন্তুদ বিবরণ প্রদান করেছেন। বন্দুকযুদ্ধ, জনসমক্ষে "শিরশ্ছেদ"সহ অনেক প্রকার কুপ্রথা তখনকার ভানুয়াতুতে প্রচলিত ছিল।
১৯২১ সালে ফ্রেঞ্চরা টোনকিন উপসাগর থেকে আনামিজ শ্রমিকদের ভানুয়াতু এসে কাজ করার অনুমতি দেয়। ১৯৪৭ সালে আনামিজ শ্রমিকদের মধ্যে অস্থিতিশীল সম্পর্কের সূত্রপাত হলে তাদের বদলে জাভানিজদের নিয়োগ দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলে। তবে ১৯৫০ সালে ফ্রেঞ্চরা পুনরায় আনামিজদের আগমন এবং অধিকৃত ভূখণ্ডে বসবাসের অনুমতি দেয়, কেননা বন্য জীবনযাপনকারী স্থানীয়দের প্রতি তারা ভরসা করতে পারছিল না। [৭]
১৯৪০ সালের দিকে ভানুয়াতুর স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান সেনাবাহিনীতে "ভানুয়াতু লেবার কর্পস" নামে আমেরিকান ব্যাটালিয়নের শ্রম দপ্তরে নতুন বিভাগ খোলা হয়। ১০,০০০ নি-ভানুয়াতু (ভানুয়াতুর স্থানীয় বাসিন্দা) সেখানে অংশগ্রহণ করে। এর পরে স্বাধীনতাবাদী জন ফ্রাম আন্দোলন সূচিত হয়।
উপনিবেশবাদের অবসান
সম্পাদনানি-ভানুয়াতু প্রথা অনুযায়ী জমির বর্তমান ভোগদখলকারীদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পরবর্তী প্রজন্মে সম্পত্তির স্থানান্তর ঘটে। নারকেল উৎপাদনের জন্য ইউরোপীয় ভূমির অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। তারা আরো ভূমি পরিষ্কার করতে শুরু করলে জিমি স্টিভেনস এর নেতৃত্বে সান্তো ও মাকুলায় বিক্ষোভ হয়, যা নাগরিয়েমেল আন্দোলন নামে পরিচিত।
নিউ হেবরিদেসকে ষাটের দশকে ব্রিটিশরা স্বাধীনতা দিতে চাইলে ফ্রেঞ্চরা এর বিরোধিতা করে। তাদের আশঙ্কা ছিল খনিজসমৃদ্ধ নিউ ক্যালিডোনিয়া অঞ্চলেও স্বাধীনতাকামী আবেগ তীব্র হয়ে ওঠবে। [৮]
১৯৭০ সালে নিউ হেব্রিদেস ন্যাশনাল পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়, ১৯৭৪ সালে যার পুনঃনামকরণ হয় "ভানুয়াকু পার্টি। দলটি স্বাধীনতার জন্য ব্যাপক আন্দোলন করে। ১৯৭৫ সালে একটি প্রতিনিধি পরিষদ গঠিত হয়,কিন্তু এর সদস্যরা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে শরীক হলে ১৯৭৭ সালে এটি ভেঙে দেওয়া হয়। ১৯৭৯ সালে বিদেশি ব্যবসায়ী ও ভূমিমালিকদের কাছ থেকে সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় এবং পূর্ণ স্বাধীনতার তারিখ নির্ধারিত হয়। সার্বিক ঘটনাপ্রবাহে ফ্রান্স খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছিল।
নারকেল যুদ্ধ
সম্পাদনা১৯৮০ সালে নাগারিমেল আন্দোলনের নেতা জিমি স্টিভেনস উপনিবেশবাদীদের ভানুয়াতুকে স্বাধীনতা দানের লক্ষ্যের প্রতিবাদ জানিয়ে একটি অভ্যুত্থান পরিচালনা করেন। [৯] এটি ১২ মাস ধরে স্থায়ী ছিল। বিদ্রোহীরা সান পেকুয়া বিমানবন্দর অবরোধ, দুইটি সেতু ধ্বংসসহ নানা রকম সহিংস কার্যক্রম পরিচালনা করে। এসপিরিতু সান্তু দখল করে তারা ভেনেরামা নামক নতুন রাষ্ট্র গড়ে তুলে। এটিই হলো "নারকেল যুদ্ধ"।[১০] ফ্রেঞ্চ ভূমিমালিক ও আমেরিকান ফিনিক্স ফাউন্ডেশন জিমি স্টিভেনসকে সহযোগিতা করে।
১৯৮০ সালের ৮ জুন নিউ হেব্রিদেস সরকার ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে সৈন্য প্রেরণ করার অনুরোধ করে। ব্রিটিশরা সৈন্য পাঠাতে চাইলে ফ্রেঞ্চরা তাতে মানা করে; আবার তারা নিজেরাও স্টিভেনসকে আটকানোর পদক্ষেপ নেয়নি। এহেন পরিস্থিতিতে সরকার পাপুয়া নিউগিনির সরকারের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সৈন্য পাঠানোর অনুরোধ করে।
অতঃপর পাপুয়া নিউগিনির সেনাবাহিনী এসপিরিতু সান্তুতে এসে পৌঁছালে যুদ্ধ খুব দ্রুত শেষ হয়। স্টিভেনসের সমর্থকদের কাছে তীর,ধনুক, ইট,পাথর ছাড়া কিছুই ছিল না। ১৯৮০ এর আগস্টে স্টিভেনসের ছেলেকে বহনকারী একটি গাড়ির উপর পাপুয়ান সৈন্যরা গুলিবর্ষণ করলে তিনি ঘটনাস্থলে মারা যান। এর পরেই স্টিভেনস আত্মসমর্পণ করেন।[১১]
১৯৯১ সালে স্টিভেনস ১৪ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তখনই এ ঘটনার সাথে ফ্রেঞ্চ ও ফিনিক্স ফাউন্ডেশনের সংশ্লিষ্টতা জনসমক্ষে আসে।[১২]
স্বাধীন ভানুয়াতু
সম্পাদনা৩০ জুলাই ১৯৮০ সালে ভানুয়াতু স্বাধীন হয়।
শুধুমাত্র ভূমির তত্ত্বাবধায়ক এবং সরকারই ভূমির মালিক হতে পারেন;বিদেশিরা শুধু ভূমি ৭৫ বছরের জন্য ইজারা নিতে পারবেন।
ভানুয়াতু মোটামুটি স্থিতিশীল একটি রাষ্ট্র। ১৯৯৬ সালে ভানুয়াতু মোবাইল ফোর্স নামক একটি আধাসামরিক বাহিনী বেতন নিয়ে বিবাদের ফলে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। ম্যাক্সিম কার্লোট কোলম্যানের সরকারে দুর্নীতির প্রচুর অভিযোগ পাওয়া যায়। ১৯৯৭ থেকে ২০১৬ সাল অবধি অনেকগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ http://www.britannica.com/eb/article-53977
- ↑ ক খ https://archive.org/details/vanuatunewcaledo00joce
- ↑ ক খ https://2009-2017.state.gov/r/pa/ei/bgn/2815.htm
- ↑ https://books.google.com/books?id=wjuxcXTEJ_sC&pg=PA26
- ↑ https://books.google.com/books?id=OMxQwXQghgkC&pg=PA721
- ↑ https://books.google.com/books?id=nhNmCiYYxucC&pg=PA423
- ↑ http://www.persee.fr/doc/geo_0003-4010_1950_num_59_317_13156Les[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ https://archive.org/details/historyofpacific00fisc
- ↑ https://www.nytimes.com/1999/02/23/world/walter-lini-57-clergyman-who-led-nation-of-vanuatu.html
- ↑ http://select.nytimes.com/gst/abstract.html?res=F00B10F8395F12728DDDAE0894DE405B8084F1D3
- ↑ http://select.nytimes.com/gst/abstract.html?res=F30F14FA3B5C12728DDDA00894DE405B8084F1D3
- ↑ https://www.nytimes.com/1982/09/14/world/south-pacific-rebel-seized.html