ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো

রফিক আজাদের কবিতা

ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো রফিক আজাদ রচিত একটি বাংলা কবিতা। এটি তার কাব্যগ্রন্থ সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে-এ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ নিয়ে কথা বলা হয়েছে, যা বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতির কারণ ছিল। কবিতাটি প্রকাশের পর গুঞ্জন উঠেছিল যে এটি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে উদ্দেশ্য করা লেখা হয়েছে। এটিতে ৩৩টি ছন্দোবদ্ধ পঙক্তি রয়েছে।

ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো
রফিক আজাদ দ্বারা রচিত
রচনা১৯৭৪
প্রথম প্রকাশ১৯৭৪
দেশবাংলাদেশ
ভাষাবাংলা
উৎসসীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে
উপজীব্যচুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ
ধরনগদ্য কবিতা
বিন্যাসঅ-পোশাকি
ছন্দঅক্ষরবৃত্তঅমিত্রাক্ষর ছন্দ
প্রকাশকপ্রিয়মুখ
প্রকাশের মাধ্যমছাপা কাগজ
পঙক্তি৩৩

কবিতাটির জন্য এর কাব্যগ্রন্থকে তৎকালীন সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তখন কবিতাটির কারণে কিছু লোক রফিক আজাদের শত্রু হয়ে যায় এবং তাকে আত্মগোপনে চলে যেতে হয়। কবির পরিবার আইনি কার্যক্রমের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে কবির শ্যালক জাতীয় রক্ষীবাহিনীর উপপরিচালক আনোয়ার উল আলম তাকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে গেলে তার প্রতি প্রধানমন্ত্রী কোন মন্তব্য না করলেও বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখার নিকট কবিকে লিখিত জবাবদিহি জমা দিতে হয়েছিল।

পটভূমি

সম্পাদনা

ব্যাপক দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার তিন বছর পর ১৯৭৪ সালে একটি দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় যার ফলে দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়।[] সেই সময় দৈনিক ইত্তেফাক-এর এক সাংবাদিক আফতাব আহমেদ[] জাল পরিহিত এক ব্যক্তির ছবি তুলে ১১ সেপ্টেম্বরে প্রকাশ করেন।[] এছাড়া তিনি অন্য একজনের বমি খাওয়ার ছবি তুলেও পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। সেই ছবিগুলো দেখে কবি রফিক আজাদ রেগে গিয়ে কবিতাটি লেখেন।[][] কবিতাটি প্রকাশিত হয় তার সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে কাব্যগ্রন্থে। কবিতাটির জন্য তৎকালীন সরকার বইটি নিষিদ্ধ করে।[] কবিতাটি কিছু লোককে তার শত্রু বানিয়ে দেয়।[] এটি প্রকাশিত হওয়ার পর রফিক আজাদ আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন।[] সেই সময় গুজব রটেছিল যে কবিতাটি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছে। ফলে আইনি পদক্ষেপের ভয়ে কবির পরিবার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তাই রফিক আজাদের শ্যালক জাতীয় রক্ষীবাহিনীর উপপরিচালক আনোয়ার উল আলম তাকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যায়।[] শেখ মুজিবুর রহমান রফিক আজাদের প্রতি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও তাকে কবিতাটি লেখার কারণ লিখিত আকারে পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শকের নিকট বিশেষ শাখার দপ্তরে জবাবদিহি হিসেবে জমা দিতে হয়।[]

উপজীব্য

সম্পাদনা

কবিতাটির মূল বিষয়বস্তু ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ। সে সময় খাবারের অভাব জনমনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, তা কবি তার কবিতায় তুলে ধরেন।[] কলাম লেখক আকতার হোসেন মনে করেন যে কবি কবিতায় দুর্ভিক্ষের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে দায়ী করে তাকে "হারামজাদা" বলে অভিহিত করেছেন।[] তবে অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর দের মতে কবিতাটিতে মুজিবকে নয় বরং তৎকালীন সরকারের বিরোধী শক্তিকে দায়ী করা হয়েছে।[]

বিশ্লেষণ

সম্পাদনা

গদ্য কবিতা হিসেবে এখানে অক্ষরবৃত্তফাঁকা পদ্য ছন্দ এখানে ব্যবহার করা হয়েছে।[১০] এটি একটি অ-পোশাকি কবিতা।[১১]

অভ্যর্থনা

সম্পাদনা

এই কবিতাটি সিরাজ সিকদারজাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সদস্যদের কাছে জনপ্রিয় ছিল। হুমায়ুন আজাদ রফিক আজাদের কবিতাটিকে "অপভাষায় প্রকাশিত ক্ষোভ" বলেছেন।[] কবিতাটি সম্পর্কে ইমদাদুল হক মিলন বলেন, "রফিক আজাদ একজন জাঁদরেল সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি কাদের সিদ্দিকীর সহকারী ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসারী ছিলেন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে কবিতা লিখে দেশ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন তিনি...."।[১২] কবি অসীম সাহার মতে কবিতাটি তখন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিলো যা শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সরকারের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠে।[১৩] সাহিত্যিক জাকির তালুকদারের মতে শেখ মুজিবুর রহমানের অন্ধ ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও দুর্ভিক্ষের সময় ঘটা নিয়মিত সরকারি অনিয়ম রফিক আজাদকে কবিতাটি লিখতে বাধ্য করেছিল।[১৪] বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাজনীতিবিদ রুমিন ফারহানা মনে করেন যে বর্তমানে এরকম একটি কবিতা লেখার জন্য যে সাহসের প্রয়োজন তা কারও নেই।[১৫] রিজোয়ান কবিরের মতে কবিতায় আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশের মাধ্যমে আজাদ মানুষের মৌলিক চাহিদার স্বাধীনতার দিকটি তুলে ধরার পাশাপাশি রাজনৈতিক স্বাধীনতার সাথে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার গুরুত্বকে মর্যাদা দিয়েছেন।[১৬] অন্তরা বিশ্বাস কবিতাটিকে কাজী নজরুল ইসলাম রচিত বিদ্রোহী কবিতার সাথে তুলনা করে বলেন যে আজাদ মধ্যবিত্তের প্রতীক হলেও কবিতাটিতে ক্ষুধার্তদের চরিত্র ফুটে উঠেছে।[১৭] ফরিদ আহমদ দুলালের মতে আজাদ মূলত স্বাপ্নিক ধারার কবি হলেও এই দ্রোহ ভিত্তিক কবিতাটি লিখে তিনি আলোচিত হয়েছিলেন।[১৮] আহমেদ মুনিরের মতে সাধারণ পর্যায়ের পাঠকদের নিকট রফিক আজাদ এই কবিতাটি লেখার কারণে পরিচিতি লাভ করেন।[১৯] লেখক অলাত এহসান কবিতাটি সম্পর্কে বলেছেন "এমন তীব্র পঙ্ক্তিমালা পৃথিবীর যে কোনো ভাষার কাব্য ইতিহাসে বিরল, যা কবিতার মানচিত্রকে নতুনভাবে চিহ্নিত করে, ভাবতে শেখায়"।[২০] অধ্যাপক ফজলুল হক সৈকতের মতে কবিতাটি স্বাধীন বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের মনের ভাবকে প্রকাশ করেছে যাতে স্বাধীনতার বিপরীতে পার্থিব অভাবকে দাঁড় করানো হয়েছে।[১১]

বিতর্ক

সম্পাদনা

২০২০ সালে নান্দাইল পৌরসভার প্রাক্তন মেয়র এএফএম আজিজুল ইসলাম পিকুল শেখ হাসিনার চতুর্থ মন্ত্রিসভা কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ তথা মুজিববর্ষ পালনের প্রেক্ষাপটে ১৯৭৪ সালে মুজিবের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় দুর্ভিক্ষে মৃত ব্যক্তিদের কথা স্মরণে কবিতাটির কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উল্লেখ করেন এবং মুজিবের মেয়ে ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচারের দায়ে অভিযুক্ত করেন। এর ফলে তার প্রকাশিত মত বিতর্ক সৃষ্টি করে এবং পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।[২১]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. কবি এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে কবিতাটি লেখার প্রেক্ষাপটে ভুল ছিল। ফটোসাংবাদিক পরিচিতি পাওয়ার জন্য এবং ১০০ টাকার বিনিময়ে অন্যজনকে বমি খাওয়ানোর অভিনয়ের ব্যাপারটি কবির অজ্ঞাত ছিল। ফলে তিনি বিষয়টি না জেনেই দৃষ্টিভঙ্গির ভুল থেকেই তিনি কবিতাটি লিখেছেন। কবি প্রশ্ন রাখেন বিএনপি বা তার সমমনা দলগুলো কবির আগের কথাগুলো শুনলেও পরের কথা অর্থাৎ কবির দৃষ্টিভঙ্গীর ভুলের কথা কেন শুনছে না।[]

উদ্ধৃতি

সম্পাদনা
  1. সাগর, আসিফুর রহমান (১২ মার্চ ২০১৬)। "'ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো'"ঢাকাটাইমস২৪.কম। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ আগস্ট ২০২২ 
  2. "ইতিহাসের অগ্নিসাক্ষী আফতাব আহমদ"দৈনিক ইত্তেফাক। ২৭ ডিসেম্বর ২০১৩। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ ডিসেম্বর ২০১৩ 
  3. "বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদের উদ্যোগে প্রকাশিত বিশেষ বন্যা ত্রাণ ক্রোড়পত্র"। দৈনিক ইত্তেফাক। ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪। পৃষ্ঠা ৭। 
  4. জব্বার আল নাইম (১৪ মার্চ ২০২০)। "রফিক আজাদের সাক্ষাৎকার"বাংলা ট্রিবিউন। ২ আগস্ট ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ আগস্ট ২০২২ 
  5. চৌধুরী, ময়ূর (১০ মার্চ ২০১৭)। "কালের খেয়া: কথা প্রসঙ্গে রফিক আজাদ"সমকাল। ২ আগস্ট ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ আগস্ট ২০২২ 
  6. পারভেজ, আলতাফ (২০১৫)। মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ। ঐতিহ্য। পৃষ্ঠা ৫৭৭। আইএসবিএন 9789847762050 
  7. আহমদ, মহিউদ্দিন (২০২০)। বেলা-অবেলা বাংলাদেশ ১৯৭২-১৯৭৫। বাতিঘর। পৃষ্ঠা ১৪১। আইএসবিএন 9789848034682 
  8. "রফিক আজাদের কবিতার 'হারামজাদা' সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি"চ্যানেলআইঅনলাইন.কমচ্যানেল আই। ১৮ মার্চ ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২ আগস্ট ২০২২ 
  9. শেখর, সৌমিত্র (২৭ মার্চ ২০১৬)। "রফিক আজাদের কবিতা বিষয়ক কথকতা"সাপ্তাহিক একতা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০২৪ 
  10. "রফিক আজাদ এক বিপ্লবী কবি"ইনকিলাব। ১ জানুয়ারি ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ২ আগস্ট ২০২২ 
  11. সৈকত, ফজলুল হক (২০১৮)। "ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ: কবিতায় শৈল্পিক উচ্চারণ"বাংলা সাহিত্যিকীরাজশাহী কলেজ (৫): ১৬৫। আইএসএসএন 2227-1635 
  12. মিলন, ইমদাদুল হক (১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)। "জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি: আমার কবি রফিক আজাদ"বাংলা ট্রিবিউন। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০২৪ 
  13. "'ভাত দে হারামজাদা' এবং কিছু প্রাসঙ্গিক কথা"চ্যানেল আই। ১৪ মার্চ ২০১৬। ১৮ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ আগস্ট ২০২৪ 
  14. তালুকদার, জাকির (২০ জুলাই ২০২১)। "ঝিনুক নীরবে সহো: দ্যুতিমান বিষণ্ণতার আখ্যান"বিডিনিউজ২৪.কম। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০২৪ 
  15. ফারহানা, রুমিন (১ মার্চ ২০২৩)। "মানুষের ভাতের ক্ষুধার কাছে সব ক্ষুধাই তুচ্ছ"মানবজমিন। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০২৪ 
  16. কবির, রিজোয়ান (২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। "কবিতায় একজীবন"কালের কণ্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০২৪ 
  17. বিশ্বাস, অন্তরা (১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২)। "রফিক আজাদের কবিতা: স্বতন্ত্র ও যোজিত স্বর"বাংলা ট্রিবিউন। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০২৪ 
  18. দুলাল, ফরিদ আহমদ (১৫ মার্চ ২০২৪)। "কবি রফিক আজাদ স্বাপ্নিক কিংবদন্তি"আমাদের সময়। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০২৪ 
  19. মুনির, আহমেদ (২০ জানুয়ারি ২০১৭)। "রফিক আজাদের কবিতাবিশ্ব"প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০২৪ 
  20. এহসান, অলাত (১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। "রফিক আজাদ : কবিতার মানচিত্রকর"রাইজিংবিডি.কম। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০২৪ 
  21. "বঙ্গবন্ধু, মুজিববর্ষ ও প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটুক্তি, সাবেক মেয়র আটক"জনকণ্ঠ। ১৯ জানুয়ারি ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০২৪ 

আরো পড়ুন

সম্পাদনা