বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা
বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা (বিএসএস) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিপাহী বিদ্রোহীদের একটি গোপন বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক সংগঠন ছিল যেটি ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সক্রিয় ছিল।[১][২] বিএসএস গঠিত হয়েছিল অগ্রগামী সমাজতান্ত্রিক-বিপ্লবী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এবং মেজর এম এ জলিল এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবু তাহেরের নেতৃত্বে।[২] বিএসএস সিপাহী ও জনতার বিপ্লবে মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য সুপরিচিত, যা শেষ পর্যন্ত দেশের রাজনীতিতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের উত্থানে পথ তৈরি করে।
সংক্ষেপে | বিএসএস |
---|---|
গঠিত | ১ জানুয়ারি ১৯৭৩ |
প্রতিষ্ঠাতা | লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবু তাহের মেজর মোহাম্মদ আব্দুল জলিল (বহিষ্কৃত) |
বিলীন হয়েছে | ২৪ নভেম্বর ১৯৭৫ |
ধরন | বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক সিপাহী বিদ্রোহী |
উদ্দেশ্য | সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব |
নেতা | লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবু তাহের |
প্রধান প্রতিষ্ঠান | জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) |
প্রতিষ্ঠা
সম্পাদনা১৯৭৩ সালের ১লা জানুয়ারি হাবিলদার বাড়ির স্টাফ কোয়ার্টারে বিএসএস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।[২] এর প্রাথমিক সদস্যরা ছিল মূলত জুনিয়র ও নন-কমিশনড অফিসারেরা, যাঁরা সাঁজোয়া বাহিনীর অংশ ছিল। তাঁরা কুরআন স্পর্শ করে বিএসএসের প্রতি তাঁদের আনুগত্যের শপথ নেয়।[২] সংগঠনটি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আহসানউল্লাহ হলে গোপন বৈঠক আয়োজন করত।[২] এসকল বৈঠকে জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খান উপস্থিত থাকতেন। আবু তাহেরের ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানের বাড়িতেও বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।[২]
মুক্তিযুদ্ধের সময় সেক্টর ১১-তে দায়িত্ব পালনকারী সৈনিকদের মধ্যে বিএসএস জনপ্রিয় ছিল, কারণ আবু তাহের ছিলেন সেই সেক্টরের একজন সেক্টর কমান্ডার।[২] সংগঠনটি কুমিল্লা সেনানিবাসের সৈনিকদের মাঝেও বেশ জনপ্রিয় ছিল, যেখানে তাহের একবার কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
সিপাহী ও জনতার বিপ্লব
সম্পাদনা১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমতায় আসীন হন। মোশতাকের নতুন সরকারে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডে জড়িত তরুণ সেনা কর্মকর্তারা জেনারেলদের মতো আচরণ শুরু করে এবং সেনাবাহিনীর চেইন অফ কমান্ড ভঙ্গ করে।[৩] এর জবাবে ব্রিগেডিয়ার মো. খালেদ মোশাররফ তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানকে চেইন অফ কমান্ড পুনরুদ্ধার করতে বলেন, যাতে হয় জিয়া অনিচ্ছুক ছিলেন নয়তো কিছু করতে পারেন নি।
৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার মো. খালেদ মোশাররফ, কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দার একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মোশতাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন এবং জিয়াকে গৃহবন্দী করেন। জিয়াকে আটক করার আগে তিনি তাহেরকে ফোন করে কিছু একটা করার আহ্বান জানান।[৩]
বারোটি দাবি
সম্পাদনাজিয়ার অনুরোধে সাড়া দিয়ে তাহেরের নেতৃত্বে বিএসএস ৪ থেকে ৬ নভেম্বরের মধ্যে প্রতি রাতে গোপন বৈঠক করে। সংগঠনটির দুটি লক্ষ্য ছিল, জিয়াকে কারামুক্ত করা এবং বারোটি দাবির তালিকা বাস্তবায়ন করা। বারোটি দাবি ছিল বামপন্থী প্রকৃতির, যেমন ঘোষণার শুরুর লাইনটি ছিল:[৩]
"এই বিপ্লবের উদ্দেশ্য একটাই–নিপীড়িত শ্রেণীর স্বার্থ। সে জন্য সশস্ত্র বাহিনীর পুরো কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে। অনেক দিন আমরা ছিলাম ধনিক শ্রেণীর সেনাবাহিনী। ধনীরা নিজেদের স্বার্থে আমাদের ব্যবহার করেছে। ১৫ আগস্টের ঘটনা এর একটি উদাহরণ মাত্র। যাইহোক, এবার আমরা ধনীদের জন্য বা তাঁদের পক্ষে বিদ্রোহ করেছি না। এবার আমরা বিদ্রোহ করেছি দেশের গণমানুষের সঙ্গে। আজ থেকে জাতির সশস্ত্র বাহিনী দেশের নিপীড়িত শ্রেণীর রক্ষক হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলবে।"
অভ্যুত্থান
সম্পাদনা৬ নভেম্বর মধ্যরাত নাগাদ অভ্যুত্থানের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। ৭ নভেম্বর ভোররাতে সুবেদার মেহবুব একটি গুলি চালান, যা অভ্যুত্থান শুরুর ইঙ্গিত দেয়। সৈনিকরা অস্ত্রাগার লুট করে এবং ট্রাক ও জিপে চড়ে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নেয়। যশোর ও কুমিল্লা থেকে সৈনিকরা অভ্যুত্থানের সমর্থনে ঢাকায় আসে। অভ্যুত্থানের সময় হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক সৈনিকদের সমর্থনে রাস্তায় নেমে আসে এবং "জনতা ও সৈনিক এক হয়েছে" এর মতো স্লোগান দেয়।[৩]
৬ নভেম্বর রাতে বিএসএসের সৈনিকেরা জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে এবং ২য় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের সদরদপ্তরে নিয়ে যায়। মুক্তির পর রেকর্ড করা এক বেতার ভাষণ ৭ নভেম্বর সকালে রেডিও বাংলাদেশে প্রচারিত হয়েছিল। লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এম এ হামিদের মতে, ঐ ভাষণে জিয়া বলেছিলেন যে তিনি "সেনাবাহিনীর অনুরোধে" প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।[৪] ২য় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের সদরদপ্তরে তাহের আসার পর জিয়া তাঁকে আলিঙ্গন করেন এবং তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য তাহেরকে ধন্যবাদ জানান।[৩] জিয়া আরও বলেন, "তুমি জাতিকে বাঁচিয়েছ"।[২] যখন বিএসএস জিয়ার কাছে তাঁদের বারোটি দাবি পেশ করে, তখন তিনি দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে একটি নথিতে স্বাক্ষর করেন।[৩] যাইহোক, দাবিগুলোর কয়েকটিই কেবল পূরণ করা হয়েছিল, কারণ জিয়া অভ্যুত্থানের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বিএসএসের বেশিরভাগ নেতাকে গ্রেপ্তার করেছিলেন। লরেন্স লিফশুল্ৎজ্ মনে করেন যে নথিতে স্বাক্ষর করা একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত ছিল, অর্থাৎ জিয়া কেবল অভ্যুত্থানের দিন বিএসএসকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য এটিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।[৩]
মোশাররফ, হুদা ও হায়দার হত্যাকাণ্ড
সম্পাদনাঅভ্যুত্থানের সময় মোশাররফ, হুদা ও হায়দার তিনজন অফিসার ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদরদপ্তরে নিহত হন। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন জলিল ও ক্যাপ্টেন আসাদ তাঁদের সৈনিকদেরকে এই তিন অফিসারকে হত্যা করার নির্দেশ দেন।[৫] অ্যান্থনি মাসকারেনহাসে মতে, হয় ক্যাপ্টেন জলিল নয়তো ক্যাপ্টেন আসাদ আবু তাহের কর্তৃক প্রভাবিত হয়েছিলেন।[১]
জিয়া–তাহের বিভক্তি
সম্পাদনাএম এ হামিদের মতে, ৭ নভেম্বর থেকেই জিয়া ও তাহেরের মধ্যে মতানৈক্য তীব্র হয় এবং চরমে পৌঁছে, কারণ জিয়া বিএসএসের সকল দাবি মেনে নিতে চাইছিলেন না। বিএসএস সৈনিকেরা তখন অফিসারদের বিরুদ্ধে পাল্টা-অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ৭ তারিখ রাতে বিএসএস সৈনিকদের গুলিতে ঢাকা সেনানিবাসে ১২ জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। এরপর ৯ ও ১০ নভেম্বর বিএসএস ও সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়ার মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক হয়। ১০ নভেম্বর বৈঠকে বিএসএসের সৈনিকরা উত্তেজিত হয়ে উঠে। তাঁদের শান্ত করতে ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে জিয়া তাঁর ইউনিফর্মের কোমরের বেল্ট খুলে মাটিতে ছুঁড়ে দেন এবং বলেন, "এত দাবিদাওয়া উঠলে আমি আর এ আর্মির চিফ থাকতে চাই না!" এরপর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয় এবং সৈনিকদের দাবি ধাপে ধাপে মেনে নেয়া হবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়। এরপর জিয়া বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অফিসারদের নির্দেশ দেন।[৪]
বিলুপ্তি
সম্পাদনা৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই জিয়া অভ্যুত্থানের নেতাদের গ্রেফতার করেন। ২৩ নভেম্বর আবু তাহেরের ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানকে গ্রেফতার করা হয়। আবু তাহের জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তাঁকে পাওয়া যায় নি। তার পরিবর্তে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। এরশাদ তাহেরকে জানান যে তাঁর ভাইকে গ্রেফতার করা একটি পুলিশি বিষয়, যার ব্যপারে এরশাদ কিছুই জানেন না।[২]
২৪ নভেম্বর তাহেরকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে সৈন্যদের মধ্যে "শৃঙ্খলা ভঙ্গ" ও "সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব" সংগঠিত করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। মোট ৩৩ জনকে বিচারের সম্মুখীন হয়েছিল, যার মধ্যে রয়েছেন:[৬]
- লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবু তাহের (মৃত্যুদণ্ড)
- মেজর (বহিষ্কৃত) এম এ জলিল (মৃত্যুদণ্ড, পরবর্তীতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড)
- ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খান (মৃত্যুদণ্ড, পরবর্তীতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড)
১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আবু তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ৩৭ বছর পর ২০১৩ সালে, হাইকোর্টের একটি রায়ে বলা হয় যে আবু তাহেরের বিচার বেআইনি ছিল এবং এটিকে "ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড" হিসেবে বর্ণনা করা হয়।[৬]
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ Mascarenhas, Anthony (১৯৮৬)। Bangladesh : a legacy of blood.। Hodder and Stoughton। আইএসবিএন 0-340-39420-X। ওসিএলসি 242251870।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ "When Gen Zia betrayed Col Taher"। The Daily Observer। ৩০ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-২৪।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ Lifschultz, Lawrence (১৯৭৯)। Bangladesh : the unfinished revolution। Zed Press। আইএসবিএন 0-905762-07-X। ওসিএলসি 883842630।
- ↑ ক খ আক্তার, সাইয়েদা (৮ নভেম্বর ২০২২)। "জিয়াউর রহমান ৭ই নভেম্বর সামরিক শাসক হওয়ার পরের সপ্তাহজুড়ে কী করেছিলেন"। BBC News বাংলা।
- ↑ "Khaled Mosharraf Killing: An Eyewitness Account"। Daily Sun (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-২৪।
- ↑ ক খ Niloy, Suliman (২০ মে ২০১৩)। "'Zia staged trial to kill Col Taher'"। bdnews24.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-২৪।
এই নিবন্ধটিতে কোনও বিষয়শ্রেণী যোগ করা হয়নি। অনুগ্রহ করে একটি বিষয়শ্রেণী যোগ করুন, যেন এটি এই বিষয়ের অন্যান্য নিবন্ধের সাথে তালিকাভুক্ত করা যায়। |