বাক্য

এক বা একাধিক পদের দ্বারা যখন বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পায়, তখন তাকে বাক্য বলে

এক বা একাধিক বিভক্তিযুক্ত পদের দ্বারা যখন বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পায়, তখন তাকে বাক্য বলে।[][] অথবা যে সুবিন্যস্ত পদসমষ্টি দ্বারা কোনো বিষয়ে বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণরুপে প্রকাশিত হয়, তাকে বাক্য বলে। যেমন: মারিয়া আরমানকে ভালোবাসে। তারা একে অপরকে বিভিন্ন কাজে সহায়তা করে।

কতগুলো পদের সমষ্টিতে বাক্য গঠিত হলেও যে কোনো পদসমষ্টিই বাক্য নয়। বাক্যের বিভিন্ন পদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বা অন্বয় থাকা আবশ্যক। এ ছাড়াও বাক্যের অন্তর্গত বিভিন্ন পদ দ্বারা মিলিতভাবে একটি অখণ্ডভাব পূর্ণ রুপে প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন, তবেই তা বাক্য হবে। বাক্য হলো যোগ্যতা, আকাঙ্ক্ষা, আসত্তি সম্পন্ন পদসমষ্টি, যা বক্তার মনের ভাব সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করে।

বাক্যের গুন

সম্পাদনা

ভাষার বিচারে বাক্যের এ তিনটি গুণ থাকা চাই। যথা:

  1. আকাঙ্ক্ষা: বাক্যের অর্থ পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য এক পদের পর অন্যপদ শোনার যে ইচ্ছা তাই আকাঙ্ক্ষা। যেমন: চন্দ্র পৃথিবীর চারদিকে- এইটুকু মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করে না, আরও কিছু জানার ইচ্ছা থাকে। কিন্তু যদি বলা যায় চন্দ্র পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, তবে বাক্যটি সম্পূর্ণ হবে। অর্থাৎ কোনো বাক্য শ্রবণ করে যদি বাক্যের উদ্দেশ্য বোঝা যায়, তাহলে বুঝতে হবে যে বাক্যটির আকাঙ্ক্ষা গুণটি সম্পূর্ণ।
  2. আসত্তি: বাক্যের অর্থসঙ্গতি রক্ষার জন্য সুশৃঙ্খল পদবিন্যাসই আসত্তি। যেমন: কাল বিতরণী হবে উৎসব আমাদের পুরস্কার স্কুলে অনুষ্ঠিত। বাক্যটি ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু, কাল আমাদের স্কুলে পুরস্কার বিতরণী উৎসব অনুষ্ঠিত হবে, বাক্যটি আসত্তিসম্পন্ন। অর্থাৎ বাক্যের পদগুলো যদি এরুপ সজ্জিত থাকে যে বাক্যের সম্পূর্ণ অর্থ স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, তবে তার আসত্তি গুণটি সম্পূর্ণ।
  3. যোগ্যতা: বাক্যস্থিত পদসমূহের অর্থগত ও ভাবগত মেলবন্ধনের নাম যোগ্যতা। যেমন: বর্ষার বৃষ্টিতে প্লাবনের সৃষ্টি হয়। বাক্যটি যোগ্যতা সম্পন্ন, কিন্তু বর্ষার রোদে প্লাবনের সৃষ্টি হয় বললে বাক্যটি তার যোগ্যতা হারাবে।[] কারণ, রোদের কারণে কখনো প্লাবণ সংগঠিত হয় না। অর্থাৎ, বাক্যের অর্থ যেনো সত্য ও যুক্তিযুক্ত হয়, তাহলেই বাক্যের যোগ্যতা থাকবে।

শব্দের যোগ্যতার সঙ্গে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো জড়িত থাকে:

  • রীতিসিদ্ধ অর্থবাচকতা: প্রকৃতি-প্রত্যয়জাত অর্থে শব্দ সর্বদা ব্যবহৃত হয়। যোগ্যতার দিক থেকে রীতিসিদ্ধ অর্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে কতগুলো শব্দ ব্যবহার করতে হয়। যেমন-
শব্দ রীতিসিদ্ধ প্রকৃতি + প্রত্যয় প্রকৃতি + প্রত্যয়জাত অর্থ
১. বাধিত অনুগৃহিত বা কৃতজ্ঞ বাধ + ইত বাধাপ্রাপ্ত
২.তৈল তিল জাতীয় বিশেষ কোনো শস্যের রস তিল +ষ্ঞ তিলজাত স্নেহ পদার্থ
  • দুর্বোধ্যতা : অপ্রচলিত, দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করলে বাক্যের যোগ্যতা বিনষ্ট হয়। যেমন- তুমি আমার সঙ্গে প্রপঞ্চ করেছ।(চাতুরি বা মায়া অর্থে ,কিন্তু বাংলা প্রপঞ্চ শব্দটি অপ্রচলিত)
  • উপমার ভুল প্রয়োগ: ঠিকভাবে উপমা ব্যবহার না করলে যোগ্যতা হানি ঘটে। যেমন-

আমার হৃদয়-মন্দিরে আশার বীজ উপ্ত হলো। বীজ ক্ষেতে উপ্ত করা হয়, মন্দিরে নয়। কাজেই বাক্যটি হওয়া উচিত:আমার হৃদয়-ক্ষেত্রে আশার বীজ উপ্ত হইল। অথবা, আমার হৃদয়-মন্দিরে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠল।

  • বাহুল্য দোষ: প্রয়োজনের অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহার করলে বাহুল্য দোষ ঘটে এবং এর ফলে বাক্য তার যোগ্যতা গুণ হারিয়ে থাকে। যেমন- দেশের সব আলেমগণ রাই এ ব্যাপারে আমাদের সমর্থন দান করেন।’আলেমগণ’ বহুবচনবাচক শব্দ।এর সঙ্গে ‘সব’ শব্দটি বাহুল্য দোষ করেছে।
  • বাগধারার শব্দ পরিবর্তন:বাগধারা ভাষাবিশেষের ঐতিহ্য। এর যথেচ্ছ পরিবর্তন করলে শব্দ তার যোগ্যতা হারায়। যেমন- ‘অরণ্যে রোদন’(অর্থ: নিষ্ফল আবেদন)-এর পরিবর্তে যদি বলা হয়,’বনে ক্রন্দন’ তবে বাগধারাটি তার যোগ্যতা হারাবে।
  • গুরুচণ্ডালি দোষ: তৎসম শব্দের সঙ্গে দেশীয় শব্দের প্রয়োগ কখনো কখনো গুরুচণ্ডালীদোষ সৃষ্টি করে। এ দোষে দুষ্ট শব্দ তার যোগ্যতা হারায়।’গরুর গাড়ি’, ‘শবদাহ’, ‘মড়াপোড়া’ প্রভৃতি স্থলে যথাক্রমে ‘গরুর শকট’, ‘শবপোড়া', ’মড়াদাহ’ প্রভৃতির ব্যবহার গুরুচণ্ডালীদোষ সৃষ্টি করে

যদি কোনো বাক্যে এ তিনটি গুণের একটি অনুপস্থিত থাকে, তবে তাকে বাক্য বলে গণ্য করা হবে না।

অর্থগত বাক্যের অংশ

সম্পাদনা

প্রতিটি বাক্যে ২টি অংশ থাকে: কর্তা বা উদ্দেশ্য ও বিধেয়।

যাহার সম্মন্ধে কিছু বলা যায়, তাহা উদ্দেশ্য বা কর্তা ( subject ); এবং প্রথমে উদ্দেশ্যের উল্লেখ করিয়া, পরে উদ্দেশ্য-সমন্ধে যে কথা বলা যায়, তাহা বিধেয় ( predicate ); যথা — ঈশ্বর মঙ্গলময় এখানে ঈশ্বর উদ্দেশ্য, মঙ্গলময় বিধেয়। তদ্রুপ ঈশ্বর‌ই আমাদের একমাত্র-আশ্রয় স্থল — এখানে ঈশ্বর উদ্দেশ্য, ও আশ্রয় স্থল বিধেয়। এই বিধেয় পদ, ক্রিয়াও হ‌ইতে পারে; কিন্ত ইহা উদ্দেশ্য পদের সম্পর্কিত কোন‌ও গুণ, ধর্ম, বা অবস্থা প্রকাশ করে, সেই জন্য ইহা এক প্রকারের বিশেষণ ব্যতীত আর কিছুই নহে। অবস্থা বা গুণবাচক বিধেয়কে এই জন্য বিধেয় বিশেষণ ( predicative adjective ) বলা হয়। বিশেষ্য-পদ‌ও বিধেয়-বিশেষণ হ‌ইয়া থাকে; যথা — ঈশ্বর আমাদের আশ্রয়-স্থল।

বাক্যের প্রকারভেদ

সম্পাদনা

অর্থ অনুসারে:-

সম্পাদনা

অর্থ অনুযায়ী বাক্য সাত প্রকার। যথা:

  1. নির্দেশক বাক্য
  2. প্রশ্নবোধক বাক্য
  3. অনুজ্ঞাসূচক বাক্য
  4. বিস্ময়সূচক বাক্য
  5. ইচ্ছাসূচক বাক্য
  6. কার্যকারণাত্মক বাক্য
  7. সন্দেহ সূচক বাক্য

গঠন অনুসারে

সম্পাদনা

গঠন অনুসারে বাক্য তিন প্রকার। যথা:

  1. সরল বাক্য (কর্তা+কর্ম+ক্রিয়া)
  2. জটিল বাক্য (সাপেক্ষ সর্বনাম+বাক্য+সাপেক্ষ সর্বনাম+বাক্য)
  3. যৌগিক বাক্য (....+অব্যয়+....)

১। সরল বাক্য: যে বাক্যে একটিমাত্র কর্তা (উদ্দেশ্য) এবং একটিমাত্র সমাপিকা ক্রিয়া (বিধেয়) থাকে, তাকে সরল বাক্য বলে। যেমন- ছেলেরা ফুটবল খেলছে।

২। জটিল বাক্য: যে বাক্যে একটি প্রধান বাক্যাংশ এবং এক বা একাধিক অপ্রধান বাক্যাংশ থাকে, তাকে মিশ্র বা জটিল বাক্য বলে। যেমন- যে মানুষের সেবা করে, সেই শ্রেষ্ঠ মানুষ।

৩। যৌগিক বাক্য: পরস্পর নিরপেক্ষ দুই বা দুয়ের অধিক বাক্য যখন কোনো সংযোজক অব্যয় দ্বারা যুক্ত হয়ে একটি সম্পূর্ণ বাক্য তৈরি করে, তখন তাকে যৌগিক বাক্য বলে। যেমন- সে দরিদ্র, কিন্তু সুখী।

সরল, জটিল ও যৌগিক – বাক্যের এই তিন গঠনগত বিভাগের পারস্পরিক পরিবর্তনকে বলে বাক্য পরিবর্তন।

বর্ণনা অনুসারে

সম্পাদনা

অর্থ অনুযায়ী বাক্য দুই প্রকার। যথা: ১. ইতিবাচক ২. নেতিবাচক

ইতিবাচক: যে বাক্য দ্বারা হ্যাঁ বোধক অর্থ প্রকাশ করা হয়,তাকে হ্যাঁ বাচক বা ইতিবাচক বাক্য বলে। যেমন: আমি লেখালেখি করি, সে স্কুলে যায়, আমি সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠি।

নেতিবাচক: যে বাক্য দ্বারা না বোধক অর্থ প্রকাশ পায় তাকে নেতিবাচক বাক্য বলে। যেমন: সে পড়াশোনা করে না, তারা বিদ্যালয়ে যায় না, আমি সকালে ঘুম থেকে দেরিতে উঠি।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. ৮ম ও ৯ম থেকে ১০ম শেণি, বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি;বাংলা ভাষার ব্যাকরণ। বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি ৮ম শ্রেণি; বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ৯ম থেকে ১০ম শেণি 
  2. *অধ্যাপক ডাক্তার সৌমিত্র শেখর
    • শুভ রায়
      বাংলা ব্যাকরণ ও নিমিত্তি
      অষ্টম শ্রেণী পৃষ্ঠা ৫৫
  3. বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
    • মুনীর চৌধুরী
    • মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী
      ৫ম অধ্যায়
      ১ম পরিচ্ছেদ
      বাক্য প্রকরণ