বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল
বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল (বাংলাদেশ হাসপাতাল নামে সর্বাধিক পরিচিত) হলো অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সরাসরি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত একমাত্র স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান।[১] এটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘরে প্রতিষ্ঠা করা হয়।[২]
বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল | |
---|---|
ভৌগোলিক অবস্থান | |
অবস্থান | মেলাঘর, পশ্চিম ত্রিপুরা, ত্রিপুরা, ভারত |
সংস্থা | |
তহবিল | অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (যুক্তরাজ্য) |
ধরন | সাধারণ |
পৃষ্ঠপোষক | ডা. এম এ মবিন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী |
পরিষেবা | |
শয্যা | ৪৮০ |
ইতিহাস | |
চালু | ১৯৭১ |
বন্ধ | ১৯৭২ |
পটভূমি
সম্পাদনাবাংলাদেশের প্রায় নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের উপর ক্র্যাকিংয়ের পর । পাকিস্তান সেনাবাহিনী সারাদেশের সমস্ত সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি অফিসার ও সৈন্যদের টার্গেট করেছিল।
নিয়মানুগ পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সন্ত্রাসের সিরিজে গুলির ফলে ক্রুদ্ধ বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষেরা পাকিস্তান ও পাকিস্তান পেশার আর্মির বিরুদ্ধে প্রায়শই বিদ্রোহ প্রকাশ করেছিলেন এবং শোধ নিয়েছিলেন।
ইতিহাস
সম্পাদনাএই হাসপাতালের সূচনা হয় ১৯৭১ সালে ভারতের মাটিতে, আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে। মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফ তখন সেই এলাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্যে গড়ে তোলা হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। ছন, বাঁশ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল এই হাসপাতাল। যুদ্ধে গুরুতর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জটিল অপারেশনও করা হতো বাঁশের তৈরি এই হাসপাতালে।
১৯৭১ সালের ২৯ শে মার্চ ক্যাপ্টেন আক্তার আহমেদকে নিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চল, শিমন্তপুরের একটি গোয়ালঘাটে চিকিৎসা কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয় যার প্রথম রোগী ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্বারা পায়ে গুলিবিদ্ধ এক গ্রামবাসী। ক্যাপ্টেন আক্তার পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস থেকে নায়েক শামসু মিয়াকে তার সহকারী হিসাবে পেয়েছিলেন।[৩]
পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ১৯শে মে, চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বারুদের সংকটের কারণে পিছিয়ে যেতে হয়, ড. আহমেদকে তার হাসপাতাল ভারতের ত্রিপুরায় সোনামুড়ার বন রেস্ট হাউজে স্থানান্তর করতে হয়েছিল। এই দিনগুলিতে নার্স সুবেদার মান্নান ডা. আহমেদের সহকারী হিসাবে যোগদান করেছিলেন। তবে খুব ছোট আকারের মেডিকেল সেন্টার, সরঞ্জাম ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুবিধার অভাবে ভুগছিল এবং চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানির কমান্ডার ডা. আহমেদ হাসপাতালটিকে আরও ভাল জায়গায় স্থানান্তরিত করার কথা ভাবছিলেন।[৪]
সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ কর্তৃক হাসপাতাল স্থাপনের আদেশ পাওয়ার পর, ক্যাপ্টেন আক্তার আহমেদ তার মেডিকেল সেন্টার মতিনগরে স্থানান্তরিত করেন যা আগরতলার সেক্টর-২ সদর দফতরের কাছাকাছি। তিনি তার সহযোগীদের নিয়ে মেলাঘর সদর থেকে দুই মাইল দূরে দারোগা বাগিচায় একটি তাঁবু স্থাপন করেছিলেন।[৫]
মুক্তিযুদ্ধের সময় এক হাজার প্রবাসী বাংলাদেশী ডাক্তার নিয়ে যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন।[৬] সেই সময় এক জরুরি বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ১৯৭১ সালের মে মাসের মধ্যেই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা. এম এ মবিন নিজ খরচে কলকাতা যাবেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য। নানান ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমানযোগে কলকাতা থেকে আগরতলা আসেন তারা। দুই নম্বর সেক্টরের মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর জিয়া, সফিউল্লাহ, মীর শওকত আলী ও অন্যদের সঙ্গে দেখা করেন তারা। যুদ্ধে ফিল্ড হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানান তারা। প্রথমে রাজি না হলেও আহত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়তে থাকায় মেজর খালেদ মত বদলাতে বাধ্য হন। দুই মাসের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর দেহরক্ষী হাবুল ব্যানার্জির আনারসবাগানে শুরু হয় ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’।[৭] পরে, অস্থায়ী সরকার হাসপাতালের জন্য ত্রিশ হাজার টাকা মঞ্জুর করে এবং ড. আহমেদ ত্রিপুরার বিশ্রামগঞ্জের লিচু বনে ২০০ শয্যা বিশিষ্ট একটি হাসপাতাল কমপ্লেক্স স্থাপন করেন।[৮] হাসপাতাল কমপ্লেক্সটি ১৯৭১ সালের ২৬শে আগস্ট থেকে কার্যক্রম শুরু করে।[৯]
প্যারামেডিক প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল একদল সেবাদানকারী। মানবাধিকার কর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামালও ছিলেন তাদের একজন। ডা. মবিন, যিনি এফআরসিএস ডিগ্রি নিয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন, শিগগিরই হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারকে আধুনিকায়ন করেছিলেন। ডিসেম্বর মাসে যুদ্ধ শেষে হাসপাতালটি ৪০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে রূপান্তরিত হয়েছিল। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল ঢাকার ইস্কাটন সড়কে পুনঃস্থাপিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ পরিবর্তিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামে যাত্রা শুরু করে ১৯৭২ সালে।[১০][১১]
সংযুক্ত ব্যক্তিবর্গ
সম্পাদনা- ডা. মোঃ আব্দুল মবিন ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী[২] (প্রতিষ্ঠাতা)
- মেজর আক্তার আহমেদ (বাজেট প্রণেতা)
- ডা. নাজিমুদ্দিন আহেদ
- ডা. ক্যাপ্টেন সিতারা রহমান (কমান্ডিং অফিসার)[১২]
- শামসুদ্দিন (সেপ্টেম্বরে দাইলার সাথে চলে যান)
- মাহমুদ
- কিরণ শঙ্কর দেবনাথ
- মোর্শেদ চৌধুরী
- এমএ কসেম
- মোহাম্মদ জুবায়ের
- লুৎফর রহমান
- সুলতানা কামাল (স্বেচ্ছাসেবী)
সেবিকা
সম্পাদনাসেবিকাদের প্রধান ছিলেন ঢাকার ইডেন কলেজের শিক্ষিকা জাকিয়া, তাঁর ডেপুটি ছিলেন সুলতানা কামাল। ছিলেন সাইদ কামাল, তার স্ত্রী সৈয়দা নুরুননাহার। নীলিমা বৈদ্য ছিল একমাত্র পাস করা স্টাফ সেবিকা।[১৩]
পুরস্কার ও সম্মননা
সম্পাদনাবাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্বে থাকা ডা. ক্যাপ্টেন সিতারা রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক “বীর প্রতীক” উপাধীতে ভূষিত হয়েছেন।[১২]
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও তার গণস্বাস্থ্য"। theprofiles। ১৪ জুলাই ২০১৭। ৪ আগস্ট ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ অক্টোবর ২০১৭।
- ↑ ক খ "আমি শেখ হাসিনারও শুভানুধ্যায়ী : জাফরুল্লাহ চৌধুরী"। দৈনিক প্রথম আলো। ১৭ এপ্রিল ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২৩ অক্টোবর ২০১৭।
- ↑ মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তাঁর বিয়োগান্ত বিদায়। প্রথমা প্রকাশনী। মার্চ ১৯৮২। পৃষ্ঠা 127। আইএসবিএন 978 984 90253 1 3।
- ↑ আখতার আহমেদ বীর প্রতীক
- ↑ মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তাঁর বিয়োগান্ত বিদায়। প্রথমা প্রকাশনী। মার্চ ১৯৮২। পৃষ্ঠা 129। আইএসবিএন 978 984 90253 1 3।
- ↑ "First hospital of Bangladesh, 'Bangladesh Field Hospital', treats wounded muktijuddhas"। লন্ডনী (ইংরেজি ভাষায়)। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১।
- ↑ "মুক্তিযুদ্ধের ফিল্ড হাসপাতাল"। কালের কণ্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-০৭।
- ↑ বিশ্রামগঞ্জের বাংলাদেশ হাসপাতাল
- ↑ স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র: দশম খণ্ড। হাক্কানী পাবলিশার্স। মার্চ ১৯৮২। পৃষ্ঠা 156। আইএসবিএন 984-433-091-2।
- ↑ "মুক্তিযুদ্ধ, গণস্বাস্থ্য, ডা. জাফরুল্লাহ ও মাছ চোর"। দ্য ডেইলি স্টার। ২০১৮-১১-০১। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-০৭।
- ↑ সানজিদা খান (২০১২)। "জাতীয় পুরস্কার"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- ↑ ক খ "তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না"। দৈনিক প্রথম আলো। ১৩ জুন ২০১১। ২০১৭-০৪-০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ অক্টোবর ২০১৭।
- ↑ "ফিরে দেখা একাত্তর: একদল চিকিৎসাকর্মী ও একঝাঁক শরণার্থীর কথা"। opinion.bdnews24.com। ২০১৬-১২-২৬। ২০১৭-০৮-০৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-০৭।