বাংলাদেশ বার কাউন্সিল
বাংলাদেশ বার কাউন্সিল বাংলাদেশের আইন অনুশীলনকারী আইনজীবীদের জন্যে ১৯৭২ সালের 'বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাকটিশনার্স অ্যান্ড বার কাউন্সিল আদেশ' এর অধীনে প্রতিষ্ঠিত একটি সংবিধিবদ্ধ স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা।[১][২] এটি বাংলাদেশের আইনজীবীদের আইন পেশা অনুশীলনের সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কাজ করে। এটিকে আইনজীবী বা অ্যাডভোকেট তৈরির কারখানা হিসেবেও অভিহিত করা হয়।[৩]
ধরন | সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা |
---|---|
যে অঞ্চলে কাজ করে | বাংলাদেশ |
দাপ্তরিক ভাষা | বাংলা এবং ইংরেজি মাধ্যম |
সভাপতি | বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল |
ওয়েবসাইট | barcouncil |
ইতিহাস
সম্পাদনা১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির জারিকৃত এক আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল প্রতিষ্ঠালাভ করে। এর সদস্য সংখ্যা রাখা হয় ১৫ জন। প্রতিটি কমিটির মেয়াদ থাকে ৩ বছর। এরমধ্যে পদাধিকারবলে বার কাউন্সিলের সভাপতি থাকেন বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল। বাকি ১৪ জন সদস্যের মধ্যে ৭ জন আইনজীবীদের মধ্য থেকে তাদের ভোটে নির্বাচিত, বাকি ৭ জন প্রতিটি গ্রপ থেকে একজন করে ৭টি গ্রুপে বিভক্ত স্থানীয় আইনজীবী সমিতিগুলির সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হন। বার কাউন্সিলের সদস্যরা নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচন করে। বার কাউন্সিল ‘বাংলাদেশ আইনি সিদ্ধান্ত’ নামে একটি আইনি জার্নাল প্রকাশ করে। [৪]
গঠনপূর্ব পটভূমি
সম্পাদনা১৭৭৪ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োগকৃত অ্যাটর্নিদের নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব লেটার্স প্যাটেন্টের ১১ ধারা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আদালতের ওপর ন্যস্ত হয়। ১৭৯৩ সালের ৭ নং প্রবিধান অনুযায়ী সদর দেওয়ানি আদালতে ও অধস্তন কোম্পানি আদালতগুলিতে আইনপেশায় নিয়োজিত উকিলদের নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণের কাজ করতো সুপ্রিম কোর্ট।[৫]
১৮৬২ সালে সদর দেওয়ানি আদালত ও সদর নেজামত আদালত তুলে দিয়ে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে জজিয়তি হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়। উক্ত হাইকোর্ট তার আইনজীবী, অ্যাটর্নি (রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োগকৃত সর্বোচ্চ আইনকর্মকর্তা), উকিল, কৌঁশুলিদের নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পায়। তখন বেশিরভাগ আইনজীবীরা ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড থেকে ডিগ্রি অর্জন করা ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল' অথবা স্কটল্যান্ডের ফ্যাকাল্টি অফ অ্যাডভোকেটস-এর সদস্য ছিলেন। [৫]
অ্যাটর্নি জেনারেলদের অনুমোদন সাপেক্ষে আইনজীবীরা কলকাতা হাইকোর্টে হাজিরা দেয়া ও ওকালতি করতে পারতেন এবং ওই আদালতের আপিল বিভাগ ও অন্যান্য অধস্তন আদালতে ওকালতি করার অনুমতি নিতেন।সেসময় হাইকোর্টে আইন চর্চাকারীরা ছিলেন অ্যাডভোকেট বা ব্যারিস্টার যাদের ইংরেজি আইনে ডিগ্রি ছিলো। তবে এ পদ্ধতিতে দেশীয় ভারতীয় আইনজীবী যাদের ব্রিটিশ আইনের কোনো ডিগ্রি নেই তারা অধস্তন আদালত ছাড়া হাইকোর্টে মূল বিভাগে কাজ করার তেমন কোনো অধিকার পেতেন না, তাদের পদবী ছিলো উকিল বা ভাকিল (Vakil), এরা মূলত মুসলিম ও হিন্দু আইন এবং মুঘল দেওয়ানি ও ফৌজদারী আইনে শিক্ষা নিতেন । তাই উপমহাদেশে একটি সর্বভারতীয় বার গঠন এবং অ্যাডভোকেট ও উকিলদের মধ্যে পার্থক্য করার জন্যে জোরালো দাবি ওঠে। এ দাবির প্রেক্ষিতে ১৯২৩ সালে ইন্ডিয়ান বার কমিটি গঠন করা হয়। এর সভাপতি ছিলেন স্যার এডওয়ার্ড চ্যামিয়ার। ১৯২৪ সালে ওই কমিটি প্রতিবেদন পেশ করে এবং ইন্ডিয়ান বার কাউন্সিল অ্যাক্ট ১৯২৬ কার্যকর করে। [৫]
ভারতের বার কাউন্সিল অ্যাক্ট অনুযায়ী প্রথমবারের মতো প্রতিটি হাইকোর্টে যৌথ সংগঠন হিসেবে একটি করে বার কাউন্সিল গঠনের বিধি প্রবর্তন করা হয়। ওইসব কাউন্সিলে ১৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত প্রতিটি বার কাউন্সিলে অ্যাডভোকেট জেনারেল, হাইকোর্ট কর্তৃক মনোনীত ৪ জন সদস্য এবং হাইকোর্টের অ্যাডভোকেটদের নিজেদের মধ্য থেকে নির্বাচিত ১০ জন সদস্য থাকতেন।
তখন হাইকোর্টের অনুমতি সাপেক্ষে বার কাউন্সিলকে আইনজীবীদের নিবন্ধন ও তাদের নিয়ন্ত্রণের নিয়মকানুন তৈরি করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে কোনও ব্যক্তিকে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে হাইকোর্ট আপত্তি জানালে তা খর্ব করার অধিকার বার কাউন্সিলের ছিলো না। এ আইনে হাইকোর্টের মূল বিভাগে আইন ব্যবসায়ে আগ্রহী আবেদনকারীদের যোগ্যতা নির্ধারণের ক্ষমতা এবং তাদের গ্রহণ কিংবা প্রত্যাখ্যান এবাং কী কী শর্তে বা পরিস্থিতিতে তারা ওই আদালতের অধীনে আইনব্যবসা করতে পারবেন তার সবটাই নির্ধারণ করতো কলকাতার হাইকোর্ট। [৫]
হাইকোর্ট আইনজীবীদের কোনও অসদাচরণের অভিযোগের তদন্তকার্য বার কাউন্সিলের ট্রাইব্যুনালের উপর ন্যস্ত করতে পারত এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে ট্রাইব্যুনাল আইনজীবীকে তিরস্কার, তার আইন ব্যবসা সাময়িকভাবে স্থগিত বা স্থায়ীভাবে বাতিল করতে পারত। আইনজীবীদের নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ছিল হাইকোর্টের হাতে, বার কাউন্সিল ছিল নেহাৎ একটি উপদেষ্টা সংগঠন। কালক্রমে কলকাতা হাইকোর্ট তার বিধিবিধান উদার করে এবং নন-ব্যারিস্টার অ্যাডভোকেটদের হাইকোর্টে মূল মামলা পরিচালনার অনুমতি দেয়। ১৯৬৫ সালের লিগ্যাল প্র্যাকটিশনার্স অ্যান্ড বার কাউন্সিল অ্যাক্ট কার্যকর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে। ওই আইনের ফলে সমগ্র দেশের জন্য একটি এবং পাকিস্তানের প্রতি দুই প্রদেশের জন্য একটি করে বার কাউন্সিল গঠিত হয়। এতে ছিলেন ১৪ জন নির্বাচিত সদস্য এবং পদাধিকারবলে একজন সভাপতি। এ আইনে ব্যারিস্টার ও নন-ব্যারিস্টার এবং অন্যান্য শ্রেণীর আইনজীবীদের মধ্যকার পার্থক্য লোপ পায় এবং দুই শ্রেণীর আইনজীবীর নিবন্ধনের বিধান চালু হয়; এক শ্রেণী হাইকোর্টের জন্য এবং অপর শ্রেণী অধস্তন আদালতসমূহের জন্য। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশবলে ১৯৬৫ সালের আইন বাতিল করে বার কাউন্সিল পুনর্গঠন করা হয়।
কমিটি
সম্পাদনাবার কাউন্সিলের কয়েকটি স্থায়ী কমিটি রয়েছে। এরমধ্যে
- নির্বাহী কমিটি - প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত।
- পরীক্ষা পরিচালনা ও নিবন্ধন কমিটি - আইনজীবীদের সদস্যভুক্ত করার জন্য পরীক্ষা গ্রহণ করে।
- ফাইন্যান্স কমিটি - কাউন্সিলের তহবিল নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত।
- আইনি শিক্ষা কমিটি- আইনজীবীদের আইনগত শিক্ষার মান নির্ধারণ করে থাকে।
- অন্যান্য কমিটি - বার কাউন্সিলের সদস্য সমন্বয়ে গঠিত বিভিন্ন সময়ে কর্মসূচি পরিচালনার জন্যে তৈরি কমিটি।[৫]
কার্যক্রম
সম্পাদনাবাংলাদেশের নাগরিক ও ন্যূনতম ২১ বছর বয়স্ক আইনের স্নাতক বা ব্যারিস্টার, অন্যূন ৭ বছরের অভিজ্ঞ কোন অ্যাডভোকেটের অধীনে ৬ মাসের শিক্ষানবিসী সম্পন্ন করে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের ফি পরিশোধের মাধ্যমে হাইকোর্ট বিভাগের অধীনস্থ আদালতসমূহে আইনব্যবসা করার লক্ষ্যে নিবন্ধনের জন্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্য বলে বিবেচিত হন। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তাকে বার কাউন্সিলের লিগ্যাল এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং ইস্টিটিউট পরিচালিত প্রশিক্ষণেও অংশ নিতে হয়। অ্যাডভোকেট হিসেবে কোন অধস্তন আদালতে দুবছর আইনব্যবসার অভিজ্ঞতা লাভ (যদি শর্তমুক্ত না করা হয়ে থাকে) ও অন্যান্য শর্তাদি পূরণের পর তিনি হাইকোর্ট বিভাগের অ্যাডভোকেট হিসেবে নিবন্ধনের জন্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করেন। নিবন্ধনের জন্য বার কাউন্সিল কর্তৃক পরিচালিত লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে অতিরিক্ত ফি প্রদানের মাধ্যমে তিনি হাইকোর্ট বিভাগের অ্যাডভোকেট হিসেবে নিবন্ধিত হন। কয়েকটি নির্দিষ্ট শর্তে বার কাউন্সিল আইনজীবী সমিতি ও আইনজীবীদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। নিবন্ধন লাভের পর প্রত্যেক অ্যাডভোকেটকে কোনো না কোনো আইনজীবী সমিতির সদস্য হতে হয়।
আইনজীবীদের বিরুদ্ধে অভিযোগসমূহ তদন্ত ও বিচারের জন্য বার কাউন্সিল ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১৯ সালে এই জাতীয় পাঁচটি ট্রাইব্যুনাল ছিল। একটি ট্রাইব্যুনাল কোনও আইনজীবীকে তিরস্কার বা স্থগিত করতে বা অনুশীলন থেকে সরিয়ে দিতে পারে। এটি ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত আইনজীবীদের বিরুদ্ধে ৩৭৮টি অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করেছে। এসব অভিযোগে ৯ জন আইনজীবী তাদের লাইসেন্স স্থায়ীভাবে হারিয়েছেন এবং ৬ জনকে সীমিত সময়ের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। [৬]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "Remarkable insight on admission to practice in Bangladesh Bar Council"। দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। ৬ মে ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ২০ আগস্ট ২০১৭।
- ↑ "Bangladesh Bar Associations"। hg.org। সংগ্রহের তারিখ ২০ আগস্ট ২০১৭।
- ↑ "Bar Council penalises 3 lawyers"। দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। ২০ জুলাই ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০ আগস্ট ২০১৭।
- ↑ "Bangladesh Bar Council election held"। দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। ২৬ আগস্ট ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ২০ আগস্ট ২০১৭।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ "আইনজীবী তৈরির কারখানা 'বাংলাদেশ বার কাউন্সিল'"। The Daily Sangram। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১১-১৩।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "How does the Bar Council Tribunal function"। Daily Star। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ১৫ এপ্রিল ২০১৯।