বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী

বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিলে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয় এবং ৯ এপ্রিলে এটি পাশ হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমান ‍এই সংশোধনী উত্থাপন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দানসহ এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে “বিস্‌মিল্লাহির-রহ্‌মানির রহিম” সংযোজন করা হয়। এই সংশোধনী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রকৃতিকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করেছে। [] ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে এই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনরায় যুক্ত করা হয়। []

পটভূমি

সম্পাদনা

রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর অভ্যুত্থানকারী সেনাসদস্যদের সমর্থনে খন্দকার মোশতাক আহমদ নতুন সরকার গঠন করে। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি অভ্যুত্থানে জড়িতদের দায়মুক্তি দিয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে জারিকৃত দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ ১৯৭২ প্রত্যাহার করেন। পরে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিধান সরিয়ে দেন এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের ভোটার ও সংসদ সদস্য হওয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।[] ১৫ আগস্টের পর থেকে বেশকয়েকটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ সামরিক আইনের অধীনে ছিল। [] ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত দ্বিতীয় সংসদ ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল এই সংশোধনী পাস হয়।[]

উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন

সম্পাদনা
  • সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বিস্‌মিল্লাহির-রহ্‌মানির রহিম’ সংযোজন করা হয়।
  • সংবিধান থেকে "বাঙালি জাতীয়তাবাদ" অপসারণ করে "বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ" অন্তর্ভূক্ত করা হয়। []
  • ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি দিয়ে জারি করে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।[]
  • ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হইতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখ পর্যন্ত সামরিক সরকারের সকল কার্যাবলীর বৈধতা দেওয়া হয়। []
  • এতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় এবং উক্ত দলগুলোর নিবন্ধনের অনুমতি দেওয়া হয়। []
  • সংবিধানের মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে সংবিধানের প্রস্তাবনার আগে "সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস" যুক্ত করা হয়। []
  • সংবিধানের মূলনীতিতে থাকা সমাজতন্ত্রকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করে "সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র" রাখা হয় । []
  • এটি সমাজতন্ত্রকে অপসারণ করে এবং শোষণ থেকে স্বাধীনতা ক্রমবর্ধমান স্থানীয় সরকার এবং মহিলাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করে। []
  • ২৫(২) অনুচ্ছেদ সংযোজন করে বলা হয়, ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ ও জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।

ইতিহাস

সম্পাদনা

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ অভ্যুত্থানের পর পুরান ঢাকার মুন সিনেমা হল জাতীয়করণ করা হয় এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মুন সিনেমার হোল্ডিং কোম্পানি আদালতে মামলা দায়ের করে। এই মামলাটি বাংলাদেশ ইতালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লিমিটেড বনাম বাংলাদেশ সরকার নামে পরিচিতি পায়।

২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট বাংলাদেশের হাইকোর্ট এই মামলায় প্রেক্ষিতে পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে। বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে করা এই মামলার রায় ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারিতে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ বহাল রাখে।[] বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ আদালতকে বলেন, পঞ্চম সংশোধনী প্রয়োজন ছিল এবং তা সবাই মেনে নিয়েছে।[]

১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট মুন সিনেমার মালিক মাকসুদুল আলমকে তার কোম্পানি জাতীয়করণের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসাবে ১ কোটি টাকা হস্তান্তর করে। [১০]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Islam, Rafiqul। "Law and Our Rights:5th Amendment case: Some concerns"দ্য ডেইলি স্টার। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৪-১৬ 
  2. "Secularism in Bangladesh: The troubled biography of a constitutional pillar"দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২০-১২-১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৪-১৬ 
  3. Liton, Shakhawat (২২ জুলাই ২০১০)। "The depth of 5th amendment"দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ১৬ এপ্রিল ২০২১  উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; আলাদা বিষয়বস্তুর সঙ্গে ":0" নামটি একাধিক বার সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে
  4. Karzon, Sheikh Hafizur Rahman। "Law and Our Rights: The Fifth Amendment"দ্য ডেইলি স্টার। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৪-১৬ 
  5. Pias, Mehedi Hasan। "Inside the Indemnity Ordinance that protected the killers of Bangabandhu"bdnews24.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৪-১৬ 
  6. Sanjana, Miti (২০২০-০৮-২৬)। "OP-ED: The darkest law in the history of Bangladesh"Dhaka Tribune (Op-ed)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৪-১৬ 
  7. "Fifth amendment was a historical necessity"দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১০-০১-২২। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৪-১৬ 
  8. Manik, Julfikar Ali (২০১০-০৮-২৫)। "5th amendment verdict paves way for justice"দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৩-১০ 
  9. Correspondent, Staff (২০১০-০১-২২)। "Fifth amendment was a historical necessity"দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৩-১০ 
  10. "Govt pays Moon Cinema Hall owner Tk 1 billion in cheque"bdnews24.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-০১