বাংলাদেশের উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী
উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী (ইংরেজি: Coastal Greenbelt) উপকূল বরাবর বনায়ন এবং বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করার মাধ্যমে উপকূবর্তী এলাকায় ভাঙন প্রতিরোধ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস করার লক্ষ্যে গৃহীত একটি কার্যকর ব্যবস্থা। রাস্তার ধার এবং বেড়িবাঁধ বরাবর গাছপালা রোপণ নিঃসন্দেহেই সবুজবেষ্টনী গড়ে তোলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পাশাপাশি উপকুলীয় ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধেও এটি অবদান রাখে। বাংলাদেশে ১৯৬৬ সাল থেকে ম্যানগ্রোভ বনায়ন শুরু করা[১] হলেও দক্ষিণ এবং পূর্ব উপকুলীয় অঞ্চলকে জলোচ্ছ্বাস এবং উপকূলীয় ভাঙন থেকে রক্ষা করার জন্য ১৯৯১ সালের ২৯-শে এপ্রিল[২][৩] সংঘটিত প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের পরেই মূলত উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী প্রকল্প হাতে নেয়া হয়।
উদ্দেশ্য
সম্পাদনাসবুজবেষ্টনী রচনার প্রধান দুটি উদ্দেশ্য রয়েছে। যথাঃ (১) বেড়িবাঁধের সম্মুখে অবস্থিত ঢালকে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ থেকে রক্ষা এবং (২) উপকূলবর্তী এলাকাসমূহের কৃষিজমি ও জান-মাল রক্ষা করা।
উল্লিখিত উদ্দেশ্য ছাড়াও বনায়ন কর্মসূচির দ্বারা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা এবং দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গরান বনের সুরক্ষা ও পুনর্বাসন করাও এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। নদী এবং সমুদ্রস্থিত বাঁধ বরাবর বহুবর্ষজীবী গাছপালা রোপণের কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী প্রকল্প ক্রমহ্রাসমান বনভূমির পরিমাণ বৃদ্ধিতেও অবদান রাখছে।
ইতিহাস
সম্পাদনাবাংলাদেশের উপকূলবতী এলাকাসমূহে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে প্রতিবছরই বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, প্রচলিত নিয়মে সারিবদ্ধভাবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বৃক্ষরোপণ করেও যেখানে জলোচ্ছ্বাসের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভবপর হয় নি, সেখানে বরং উপকূলরেখার সম্মুখ অংশে ব্যাপক বনায়নের মাধ্যমে এবং বিস্তীর্ণ চর এলাকায় গরান বনভূমি তৈরি করার মাধ্যমে তা প্রতিরোধ সম্ভব হতে পারে। ১৯৯১ সালে বাংলাদশে এক প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়[৪] আঘাত হানে। সেখানে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ মাপা হয়েছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিমি এবং সমুদ্র থেকে উঠে আসা বিশাল বিশাল ঢেউগুলি ছিল প্রায় ২০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট। এ ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় একলক্ষ ৩৮ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে।[৫] সাধারণ মানুষের বসতবাড়ি এবং অন্যান্য স্থাপনাসমূহ মিলিয়ে প্রায় ২৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম পরিমাণ সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উক্ত ঝড় এবং তৎপূর্ববর্তী অন্যান্য ঘূর্ণিঝড়সমূহের অভিজ্ঞতা থেকে বিশেষজ্ঞরা মত দেন যে, উপকূলবর্তী এলাকায় ব্যাপক বনায়ন, বিশেষত ম্যানগ্রোভ জাতীয় বৃক্ষাদি রোপন করার মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হতে পারে। ৯১' সালের ঘূর্ণিঝড়ের পরেই তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার সর্বপ্রথম উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী তৈরীর জন্য প্রকল্প হাতে নেয়।[২]
১ম প্রকল্প বাস্তবায়ন
সম্পাদনা১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ১৯৯৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত প্রকল্পটি সূত্রবদ্ধকরণের কাজ চলে এবং ১৯৯৫ সালের দোসরা মার্চ প্রকল্পটি এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে। একই বছরের এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখে প্রকল্পের ঋণ বিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আর ২৮ জুলাই থেকে প্রকল্পটি কার্যকর বলে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০২ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত এটির শেষ সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীকালে এ সময়সীমা সামান্য সংশোধন করার মাধ্যমে সম্পূর্ণ ভোলা জেলাকেও এর আওতাভুক্ত করা হয়। এ প্রকল্পে সর্বমোট ১০টি বনবিভাগ অন্তর্ভুক্ত ছিল। যথাঃ
- পটুয়াখালী বনবিভাগ (পটুয়াখালী জেলা এবং বরগুনা জেলা নিয়ে গঠিত)
- চট্টগ্রাম বনবিভাগ (কক্সবাজার জেলা এবং চট্টগ্রাম জেলা নিয়ে গঠিত)
- লক্ষ্মীপুর বনবিভাগ
- ভোলা বনবিভাগ
- নোয়াখালী বনবিভাগ
- ফেনী বনবিভাগ
- বাগেরহাট বনবিভাগ
- পিরোজপুর বনবিভাগ
- বরিশাল বনবিভাগ এবং
- ঝালকাঠি বনবিভাগ
উল্লিখিত বনবিভাগগুলোর অধীনে ৩০ লক্ষ হেক্টর জমি (প্রায়) ছিল। হিসেবে এ জমির পরিমাণ বাংলাদেশের মোট আয়তনের শতকরা প্রায় ১৬% থেকে ১৭%।[২]
পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত বাঁধসমূহের প্রায় ১৩০০ কিমি এলাকায় বিস্তৃত বনায়নের কথা ছিল। প্রকল্পটির সমাপ্তি পর্যন্ত ১৩৯৪ কিমি এলাকায় বনায়ন সম্পন্ন হয়। রেললাইনের ধারে বাংলাদেশ রেলওয়ের অধীনস্থ প্রায় ২০ কি.মি. জমিতে, সরকারি প্রকৌশল বিভাগের অধীনস্থ ‘বি’ টাইপের ছোট ছোট রাস্তাগুলির পার্শ্ববর্তী ২৮০ কিমি জায়গা, বিশ্বরোড এবং ‘রোডস্ অ্যান্ড হাইওয়েস’ ডিপার্টমেন্টের কর্তৃত্বাধীন ছোট ছোট রাস্তাগুলির তীরবর্তী প্রায় ৪১০ কি.মি. জায়গা এবং গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত ছোট রাস্তাগুলির আশেপাশের প্রায় ৪০০০ কি.মি. স্থানে বৃক্ষরোপণ উক্ত প্রকল্পের পরিকল্পনার অধীনে ছিল। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে যে বনাঞ্চল সৃষ্টি হয়েছে উপকূল অঞ্চলের পরিবেশ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।[২]
ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় সবুজবেষ্টনীর ভূমিকা
সম্পাদনা২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ হানা দেয়। উপকূলবর্তী এলাকাসমূহে এই ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক। বরগুনা, পটুয়াখালী এবং ঝালকাঠি জেলায় জলোচ্ছ্বাস ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। সুন্দরবনের প্রায় এক চতুর্থাংশ প্রচন্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধের জন্য রোপিত বৃক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোকে এই প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে অনেকটা রক্ষা করেছে।[৬] এই বনাঞ্চল না থাকলে ক্ষয়ক্ষতি আরো ব্যপক হতে পারত। ‘মোরা’, ‘আইলা’ ‘সিডর’, ‘রোয়ানু’ ‘নার্গিসে’র মতো দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাসে উপকূলীয় সবুজবেষ্টনীর ভূমিকা ছিল অনন্য। উপকূলীয় সবুজ বেস্টনী এক্ষেত্রে ঢাল হিসেবে কাজ করেছে।
২য় প্রকল্প
সম্পাদনাপরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় উদ্যোগে বাংলাদেশে ২য় বারের মতো উপকুলীয় বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলার ১৯টি উপকূলীয় উপজেলায় ১ হাজার ১৪৯ কিলোমিটার এলাকায় নন ম্যানগ্রোভ গাছের বনায়ন করার কথা বলা হয়।[৭] প্রকল্পটির নাম- ‘এ ফরেস্টেশন ইন ফাইভ কোস্টাল ডিসট্রিক্টস অব বাংলাদেশ’। প্রকল্পের আওতায় ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন মেয়াদে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হবে উপকূলীয় এলাকায়।[৮]
সবুজবেষ্টনীর ক্ষতিসাধন
সম্পাদনাবিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত রিপোর্টে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের উপকূলীয় বেষ্টনীর ৫০ শতাংশেরও বেশি সুশোভিত ঝাউবন উজাড় হবার কথা গনমাধ্যমে উঠে আসে।[৯] এর পেছনে অসৎ কাঠ ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি, বনদস্যুদের নির্বিচারে গাছ কাটা, যথেচ্ছ ও অপরিকল্পিত চিংড়ি ঘের, লবণ চাষ এবং শিপব্রেকিং ইয়ার্ড তৈরি অনেকাংশে দায়ী। এমনকি বনদস্যুদের সাথে নির্বিচারে বন-জঙ্গল ধ্বংসের তান্ডবের সাথে কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংশ্লিষ্ট থাকার কথাও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে।[৯][১০] এসমস্ত কারণে যে উদ্দেশ্যে এইসকল প্রকল্প গৃহীত হয়েছে তা ব্যর্থ হচ্ছে।[১১][১২]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "উপকূলীয় বনায়নে অর্জিত সাফল্য"। বন অধিদপ্তর। সংগ্রহের তারিখ ২৫ এপ্রিল ২০২০।
- ↑ ক খ গ ঘ "উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী"। বাংলাপিডিয়া। ৫ মে ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ২৫ এপ্রিল ২০২০।
- ↑ "উপকূলের ঢাল সবুজ বেষ্টনী"। দৈনিক ইত্তেফাক। ২৫ মার্চ ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ "বাংলাদেশে ১৯৯১-এর ঘূর্ণিঝড়: প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় ভয়াল সে রাতের কথা"। বিবিসি নিউজ বাংলা। ২৯ এপ্রিল ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ২৫ এপ্রিল ২০২০।
- ↑ "বাংলাদেশে আঘাত হানা ভয়ঙ্কর সব ঘূর্ণিঝড়"। দৈনিক যুগান্তর। ২ মে ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২৫ এপ্রিল ২০২০।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "উপকূলের ঢাল সবুজ বেষ্টনী"। দৈনিক ইত্তেফাক। ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫। ২৫ মার্চ ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
বিশেষ করে ২০০৭ সালে সিডর এবং ২০০৯ সালে আইলা আঘাত হানে উপকূলে। কিন্তু এ দুটি ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি আগের মতো হয়নি। এর অন্যতম কারণ উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী বা উপকূলীয় বন।
- ↑ "১১৪৯ কিমি উপকূলীয় এলাকায় সবুজ বেষ্টনী"। বাংলানিউজ২৪।
- ↑ "বাংলাদেশের উপকূলীয় বনায়ন ও পুনঃবনায়নে কমিউনিটিভিত্তিক অভিযোজন কর্মসূচি" (পিডিএফ)। ইউএনডিপি। ১০ মার্চ ২০২২ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ এপ্রিল ২০২০।
- ↑ ক খ "উপকূলের সবুজ বেষ্টনী উজাড়"। দৈনিক ইনকিলাব। ২৮ অক্টোবর ২০১৭।
- ↑ "উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী রক্ষা প্রসঙ্গে"। দৈনিক সংগ্রাম। ১০ অক্টোবর ২০১১।
- ↑ "আমতলীর উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীর গাছ কেটে উজাড়"। দৈনিক যুগান্তর। ২৯ এপ্রিল ২০১৮।
- ↑ "Mindless destruction of coastal green belt"। The Daily Star।