রাজনৈতিক বাস্তবতাবাদ
রাজনৈতিক বাস্তবতাবাদ বা বস্তুতন্ত্রবাদ বা রাজনৈতিক বস্তুতন্ত্রবাদ বা রাজনৈতিক বাস্তববাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিদ্যার একটি বিশেষ শাখা। এটি কোন রাষ্ট্রের এমন বিশেষ রাজনৈতিক আচরণের ব্যাখ্যা দেয় যে আচরণের ফলে রাষ্ট্র নৈতিকতা, আদর্শ, সামাজিক পূণর্গঠন ইত্যাদি বিষয়াবলীকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধুমাত্র ও যেকোন উপায়ে জাতীয় স্বার্থ কায়েম ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নীতি নির্ধারণ করে থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় বস্তুতন্ত্রবাদ ও ক্ষমতার রাজনীতিকে ক্ষেত্র বিশেষে পরস্পরের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বস্তুতন্ত্রবাদের মতে- আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা কার্যত নৈরাজ্যবাদমূলক; প্রতিটি রাষ্ট্র টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলোকে প্রাধান্য দেয় এবং পদক্ষেপগুলো রাষ্ট্রের স্বতঃস্ফুর্ততা ও গতিময়তার মধ্য দিয়ে সম্পাদিত হয়; রাষ্ট্রের এরূপ নীতিমালার জন্য মানবকূল পরস্পরের প্রতি সাংঘর্ষিক মনোবৃত্তি ধারণ করে; ব্যক্তি পর্যায়ের নৈতিক আদর্শগুলোর দ্বারা রাষ্ট্রসমূহের কূটনীতিকে মূল্যায়ন করা যায় না কেননা রাষ্ট্রসমূহ যখন পরস্পরের মুখোমুখি হয় তখন তা তারা ব্যক্তি হিসেবে নয় বরং একেকটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে হয়; রাজনৈতিক নীতিমালার ভিত্তি যতটা না আদর্শ, তার চেয়ে বেশি স্বার্থ ও ক্ষমতা; টিকে থাকার লড়াই ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্র এককভাবে দায়ী।
রাজনৈতিক বাস্তববাদ হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্বসমূহের মধ্যে একটি চিন্তাধারা, যা প্রারম্ভিক আধুনিক ইউরোপের বাস্তব-রাজনৈতিক ধারণার মধ্য দিয়ে উদ্ভূত হয়েছিল। এই চিন্তাধারা মূলত এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে যে, বিশ্ব রাজনীতি চূড়ান্তভাবে সবসময় এবং অপরিহার্যভাবে ক্ষমতান্বেষণকারীদের দ্বন্দ্ব-ক্ষেত্র। এই প্রত্যাখ্যান-অযোগ্য দ্বন্দ্বের উৎস্য কী - সেই বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক বাস্তববাদীদেরকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। ধ্রুপদী বাস্তববাদীগণ মনে করেন এর উৎস্য মানব প্রকৃতি বা প্রবৃত্তিতেই নিহিত। নব্যবাস্তববাদীগণ নৈরাজ্যময় রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামোকে এই দ্বন্দ্বের উৎস্য বলে মনে করেন। এদিকে নব্য-ধ্রুপদী বাস্তববাদীগণ এর উৎস্য হল মানব প্রকৃতি ও নৈরাজ্যময় রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামো দুটোই, ও সেই সাথে কিছু নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় আভ্যন্তরীন চলক। এছাড়াও বিশ্ব রাজনীতির পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রগুলোকে কিরকম কাজ করা উচিত তা নিয়েও নব্যবাস্তববাদীরা দুইভাগে বিভক্ত: প্রতিরক্ষামূলক বাস্তববাদ ও আক্রমণাত্মক বাস্তববাদ। বাস্তববাদীরা দাবি করেন, প্রাচীন যুগের থুসিডাইডিসের সময়কাল থেকে আজ পর্যন্ত রাজনীতির ইতিহাসের সকল সময়ে রাজনৈতিক বাস্তববাদের ঐতিহ্য বজায় রয়েছে।
জোনাথন হাসলাম রাজনৈতিক বাস্তববাদকে "বিভিন্ন ধারণার একটি মতপরিসর" হিসেবে উল্লেখ করেছেন।[১] যে সংজ্ঞাই ব্যবহার করা হোক না কেন, রাজনৈতিক বাস্তববাদের তত্ত্ব সমূহ চারটি কেন্দ্রীয় প্রস্তাবকে ঘিরেই আবর্তিত হবে:[২]
- আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোন ব্যক্তি বা আন্তর্জাতিক সংস্থা নয়, বরং রাষ্ট্রসমূহই হচ্ছে কেন্দ্রীয় চরিত্র।
- আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা হচ্ছে নৈরাজ্যময় কেননা রাষ্ট্রসমূহের উপর নিয়ম আরোপ বা বলবৎ করবে এরকম কোন অধিজাতীয় কর্তৃপক্ষ নেই।
- আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার চরিত্রসমূহ এমনভাবে বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন (যৌক্তিক অহংবাদী) যাতে তাদের কার্যসমূহের দ্বারা তারা সর্বোচ্চ আত্মস্বার্থ অর্জন করতে পারে।
- প্রত্যেকটি রাষ্ট্রই ক্ষমতা চায় যাতে তারা আত্ম-সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে।
রাজনৈতিক বাস্তববাদকে প্রায়ই প্রয়োগবাদী রাজনীতি-র (রেয়ালপোলিটিক) সাথে সম্পর্কিত করা হয়, কেননা উভয়ই অভীষ্ট, অর্জন এবং ক্ষমতার প্রয়োগের ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভরশীল। যাই হোক, প্রয়োগবাদী রাজনীতি একটি পুরনো দৃষ্টিভঙ্গি যা নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ (যেমন বৈদেশিক নীতি)। অন্যদিকে রাজনৈতিক বাস্তববাদ হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট তাত্ত্বিক পরিকাঠামো, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধীনের বিভিন্ন বিষয়কে বর্ণনা করতে, ব্যাখ্যা করতে এবং ভবিষ্যদ্বাণী করতে ব্যবহৃত হয়। এই তত্ত্বগুলোকে রাজনৈতিক উদারতাবাদের আদর্শগুলোর সাথে প্রতিতুলনা করা হয়।
রাজনৈতিক বাস্তববাদ হচ্ছে আধুনিক বিদেশ নীতিগত চিন্তাধারার একটি প্রভাবশালী শাখা। একটি শিক্ষায়তনিক অভিষ্ট হিসেবে রাজনৈতিক বাস্তববাদ কোন মতাদর্শের বন্ধনে আবদ্ধ নয়। এটি না কোন নৈতিক দর্শনের পক্ষে থাকে, না কোন মতাদর্শকে রাষ্ট্রের আচরণের প্রধান বিষয় হওয়া উচিত বলে মনে করে। রাজনৈতিক বাস্তববাদীদের অগ্রাধিকারকে "মাকিয়াভেল্লীয়" হিসেবে বর্ণনা করা হয়, যেখানে তাদের কেন্দ্রীয় মনোযোগের বিষয় হয় অন্য রাষ্ট্রগুলোর তুলনায় নিজের রাষ্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।[৩]
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- গতানুগতিক ও নব্য বস্তুতন্ত্রবাদের তুলনা ও পার্থক্য
- বিশ্ব শক্তির পরিমাপক
- বস্তুতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা by অ্যান্ড্রু বাচেভিচ, বস্টোন গ্লোব, ৬ নভেম্বর, ২০০৫
- জাতীয় স্বার্থ
- রবার্ট জার্ভিসের সাক্ষাৎকার ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৭ জুলাই ২০১৯ তারিখে (জুলাই ২০০৮)
- নব্য রক্ষণশীল বনাম বস্তুতন্ত্রবাদী[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Goodin, Robert E. (২০১০)। The Oxford Handbook of International Relations। Oxford: Oxford University Press। পৃষ্ঠা 132। আইএসবিএন 978-0-19-958558-8।
- ↑ Goodin, Robert E. (২০১০)। The Oxford Handbook of International Relations। Oxford: Oxford University Press। পৃষ্ঠা 133। আইএসবিএন 978-0-19-958558-8।
- ↑ Garrett Ward Sheldon (২০০৩)। The History of Political Theory: Ancient Greece to Modern America। Peter Lang। পৃষ্ঠা 251। আইএসবিএন 978-0-8204-2300-5।