বলরাম হাড়ি

বাংলার ধর্মীয় নেতা

বলরাম হাড়ি (১৮২৫–১৮৯০; (বাংলা: ১২৩২ এবং ৩০ অগ্রহায়ণ ১২৯৭) ব্রিটিশ ভারতের বাংলা অঞ্চলের একজন বিশিষ্ট সাধক, ধর্মীয় নেতা, গীতিকার ও সমাজ সংস্কারক ছিলেন।[] তিনি বলরামি সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন, যা বলরাম ভজা বা বলহাড়ি সম্প্রদায় নামেও পরিচিত।[]

বলরাম হাড়ি
ব্যক্তিগত তথ্য
জন্ম১৮২৫
মৃত্যু১৮৯০
জাতীয়তাব্রিটিশ ভারতীয়
দাম্পত্য সঙ্গীমলনী
কাজ
  • সাধক
  • ধর্মীয় নেতা
  • গীতিকার
এর প্রতিষ্ঠাতাবলরামি সম্প্রদায়
দর্শন

বলরামি সম্প্রদায়ের আদর্শ হলো লোভ ও ইন্দ্রিয়-আসক্তির ঊর্ধ্বে থেকে নির্মল ও সহজ জীবনযাপন করা। তাদের মতে প্রার্থনা করা তাদের প্রধান কর্তব্য। চুরি ও মিথ্যা বলাকে তারা গুরুতর পাপ বলে মনে করে। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, এই মহাবিশ্ব হলো ঈশ্বরের দেহ। হিন্দু শিষ্যরা তাদের দেবতাকে হাড়ি-রাম নামে ডাকেন, আর মুসলিম শিষ্যরা তাকে হাড়ি-আল্লাহ নামে অভিহিত করেন।

বর্তমানেও কিছু জায়গায় বলহাড়ি সম্প্রদায়ের অনুসারী দেখা যায়, যেমন মেহেরপুর (বর্তমান বাংলাদেশে), নদিয়ার নিশ্চিন্তপুর, পুরুলিয়ার দাইকিয়াড়ি, বাঁকুড়ার শালুনিগ্রাম ইত্যাদি।[]

বলরাম হাড়ির জন্ম ১৮২৫ সালে মেহেরপুর, নদিয়া, বাংলা প্রেসিডেন্সি, (বর্তমান মেহেরপুর জেলা, বাংলাদেশ)-এ, গোবিন্দ হাড়ি এবং গরমণির পরিবারে।[] তরুণ বয়সে তিনি স্থানীয় এক জমিদার পরিবারের প্রহরী হিসেবে কাজ করতেন। তবে কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে তাকে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে অত্যাচার করা হয়, যা তাকে সেই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য করে। কয়েক বছর ঘুরে বেড়ানোর পর তিনি একজন ধর্মীয় শিক্ষক হয়ে উঠেন। বলরাম হাড়ি প্রায় বিশ হাজার নিম্নবর্ণের জনগণ ও মুসলিম অনুসারী অর্জন করেন এবং এর মধ্য দিয়ে বলরামি সম্প্রদায় গঠিত হয়।[]

তিনি ছিলেন অশিক্ষিত, তবে শব্দ নিয়ে খেলা করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। তিনি কথা বলার বা বিতর্কের সময় তার শ্রোতাদের মুগ্ধ করতে পারতেন।

১৮৯০ সালে ৬৫ বছর বয়সে বলরাম হাড়ি মেহেরপুর, নদিয়া, বাংলা প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান মেহেরপুর জেলা, বাংলাদেশ)-এ মৃত্যুবরণ করেন (বাংলা: ৩০ অগ্রহায়ণ ১২৯৭)।[]

বলরাম হাড়ি প্রতিষ্ঠিত বলরামি সম্প্রদায়ের দর্শন ছিল লোভ ও ইন্দ্রিয় আসক্তির ঊর্ধ্বে নির্মল ও সরল জীবনযাপনের আদর্শ। তিনি হিন্দুদের বর্ণ ব্যবস্থার, বিশেষত ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন।[] এই সম্প্রদায় মূর্তিপূজার বিরোধী ছিল। প্রচলিত ধর্মের প্রচারক বা ‘গুরু’ এবং অবতার ধারণাগুলি তার বলরামি সম্প্রদায়ে ছিল না।[] বলরামি সম্প্রদায়ের অনুসারীদের বিশেষ কোনো চিহ্ন বা পোশাক নেই।

বলরাম হাড়ির মতে, মানুষের দেহ আঠারোটি গুণ দিয়ে গঠিত। তিনি স্থানীয় নিম্নবর্ণের বা সমাজের বাইরের জনগণ এবং মুসলিমদের প্রায় বিশ হাজার অনুসারী অর্জন করেছিলেন। কিছু বলরামি সদস্য ভিক্ষাবৃত্তি করতেন। বর্তমানেও কিছু জায়গায় বলরামি সম্প্রদায়ের অনুসারী দেখা যায়, যেমন বাংলাদেশের মেহেরপুর এবং ভারতের নদিয়ার নিশ্চিন্তপুর, সাবেনগর, পালিশিপাড়া, নাটনা, হাওলিয়া, অর্জিনগর, গরিবপুর; পুরুলিয়ার দাইকিয়াড়ি এবং বাঁকুড়ার শালুনিগ্রাম।[][]

তার কয়েকজন বিশিষ্ট শিষ্যের মধ্যে ছিলেন বিন্দাবন, তনু, রামচন্দ্র, জলধর, রাজু ফকির এবং সীমন্ত। তার উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে: "দিবজুগে যে হরিরাম / মেহেরপুরে তার নিত্যধাম", "র’ শব্দে পৃথিবী বোঝাই/‘ম’ শব্দে জয়ের আশ্রয়", এবং "হরিরামত্রত নিহিত অর্থ বেদবেদান্ত ছাড়া/ করে সর্বধর্ম পরিত্যাগ সেই পেয়েছে ধরা"।[]

বলহাড়ি সম্প্রদায়ের একটি উপশাখা সন্ধ্যায় তার মৃত্যুস্থলে প্রদীপ ও মোমবাতি প্রজ্বালন করে। কিছু সদস্য হোলি উৎসবও উদ্‌যাপন করেন, যদিও বলহাড়ি ধর্মে এ ধরনের কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই।[]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Sudhir Chakrabarti, Dr (২০১৪)। Chowdhury, সম্পাদক। Gavir Nirjan Pathe। কলকাতা: Ananda Publishers। আইএসবিএন 978-8177562668 
  2. Mukherjee, Sujata (১৯৯৬)। "Popular Sects and Elite Culture in Nineteenth Century Bengal : Some Aspects of Interraction and Assimilation"Proceedings of the Indian History Congress57: 612–623। আইএসএসএন 2249-1937জেস্টোর 44133366 
  3. "Folk Sects"Banglapedia 
  4. Bhattacharya, Jogendra Nath (১৮৯৬)। Hindu Castes and Sects: An Exposition of the Origin of the Hindu Caste System and the Bearing of the Sects Towards Each Other and Towards Other Religious Systems (ইংরেজি ভাষায়)। Thacker, Spink। 
  5. "Balarami"