বনু কায়নুকা আক্রমণ

ইসলামের ঐতিহ্যগত ইতিহাস অনুসারে, ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে বনু কায়নুকা আক্রমণ সঙ্ঘটিত হয়[] যা বনু কায়নুকার বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান নামেও পরিচিত।[] বনু কায়নুকা ছিল একটি ইহুদি গোত্র যাকে ইসলামের নবি মুহাম্মাদ মদিনা সনদ নামক চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগে বহিষ্কার করেছিলেন,[][] ঘটনার শুরু হয় এক মুসলিম মহিলার সম্ভ্রমহানি করার মাধ্যমে। বনু কায়নুকার এক স্বর্ণকার এক মুসলিম মহিলার কাপড় পেরেকের সাথে আটকে দিয়েছিল, যার ফলে তার কাপড় সম্পূর্ণ ছিঁড়ে গিয়ে তিনি বিবস্ত্র হয়ে পড়েন। এর প্রতিশোধে এক মুসলিম যুবক এ ঘটনায় সম্পৃক্ত ইহুদিকে হত্যা করেন, এবং তা দেখে ইহুদিরা কোন বিচার ছাড়াই মুসলিম যুবককে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই ঘটনায় প্রতিহিংসার আগুন দুই দলের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে এবং মুসলিম ও বনু কায়নুকার মাঝে শত্রুতা ফুলে ফেঁপে উঠে, যার ফলে মুসলিমগণ বনু কায়নুকার দুর্গ অবরোধ করে।[][][]:১২২ গোত্রটি অবশেষে নবী মুহাম্মাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে, মুহাম্মাদ প্রথমে গোত্রের সকল সদস্যকে গ্রেফতার করতে চাইলেও পরবর্তীতে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের অনুরোধে তিনি এই সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করেন এবং তাদের শুধুমাত্র বহিষ্কার করেন।[]

প্রেক্ষাপট

সম্পাদনা

ইহুদিদের বনু কাইনুকা গোত্র ছিল পেশায় কর্মকার, স্বর্ণকার ও তৈজসপত্র নির্মাতা। বদর যুদ্ধের কিছুদিন পর তাদের বাজারে এক মুসলিম মেয়ে এক ইহুদি স্বর্ণের দোকানে একটি কাজে গিয়েছিল। ঐ মুসলিম মহিলা যখন ঐ দোকানে গিয়েছিলেন তখন ঐ ইহুদি কর্মচারী মুসলিম মহিলাটির মুখ খুলতে বলে। কিন্তু মহিলাটি তার মুখ খুলতে রাজি না হওয়ায় মহিলাটি যখন স্বর্ণের দোকানের একটি চেয়ারে বসে তখন ইহুদি কর্মচারীটি ওই মহিলার পোশাকে পেরেক মেরে চেয়ারের সাথে আটকে দেয়, ফলে উঠতে গিয়ে ঐ মহিলার জামা ছিঁড়ে সারা শরীর অনাবৃত হয়ে যায়। মুসলিম মহিলার আর্তনাদ শুনে এক মুসলিম পথচারী এটা দেখে খেপে গিয়ে ঐ ইহুদি কর্মচারীকে হত্যা করেন, এরপর ইহুদি কর্মচারীর পক্ষের লোকেরা সবাই মিলে ঐ মুসলমানকে কোন বিচার ছাড়াই নির্মমভাবে হত্যা করে।।[][]:১২২[] উক্ত ঘটনার ফলে, ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে, মুসলিমগণ ইহুদি গোত্র বনু কায়নুকার উপর আক্রমণ চালায়, এবং ১৫ দিন তাদেরকে অবরোধ করে রাখার পর অবশেষে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে।

আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের সম্পৃক্ততা

সম্পাদনা

মুসলিম ঐতিহাসিকদের মতে, ইবনে উবাই তখন বনু কায়নুকার সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্কে আবদ্ধ থাকায় মুহাম্মাদের কাছে তাদের শাস্তি লঘু করার জন্য আবেদন করেন।[] মুহাম্মাদ উত্তরে বলেন, আমাকে যেতে দাও। ইবনে উবাই তাতে উত্তর দিলেন:

"কক্ষনো না [...] আমি ততক্ষণ আপনাকে যেতে দেবো না যতক্ষণ না আপনি আমার বন্ধুদের প্রতি অণুকম্পা প্রদর্শন করেন; গাড়িবহরে অস্ত্রসহ সজ্জিত ৩০০ জন সেনা এবং নীরস্ত্র ৪০০ জন লোক, -- এরা হাদাইক ও বুয়াসের ময়দানে আমাকে প্রতিটি বিপদ থেকে রক্ষা করেছিল। এদেরকে কি আপনি একদিনেই মেরে ফেলবেন, হে মুহাম্মাদ ? আমি তো এমন এক ব্যক্তি যে কিনা আমার জন্য ভাগ্যের পরিহাস নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভয় করি।"[১০]

এতে মুহাম্মাদ তার অণুরোধ গ্রহণ করলেন, এবং বনু কায়নুকাকে শহর ছেড়ে চলে যাবার জন্য তিন দিনের সময় দিলেন।[১১]

ইবনে উবাইয়ের শেষের উক্তিটি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। রবিনসনের বিবেচনায় এটি ছিল মুহাম্মাদের উপর ইবনে উবাইয়ের হুমকি,[১১] অপরদিকে উইলিয়াম মন্টগোমেরি ওয়াট মনে করেন যে, ইবনে উবাই মক্কা থেকে আসন্ন আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে তাদেরকে একটি উপযুক্ত যোদ্ধাবাহিনী হিসেবে মুহাম্মাদের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।[]

মুসলিমগণ এই ঘটনাটিকেও ঐতিহ্যগতভাবে ইবনে উবাইয়ের কুটিলতার আরেকটি প্রমাণ হিসেবে দেখেছেন, কারণ ইসলামের গণ্ডিতে প্রবেশ করেও ইবনে উবাই তার অতীতের গোত্রীয় ও ব্যক্তিগত আনুগত্যের দায়িত্বকে সম্পূর্ণরূপে ছাড়তে পারে নি।[১২] পরিশেষে, ইবনে উবাই বনু কায়নুকাকে রক্ষা করতে না পারলেও তাদের জন্য মুহাম্মাদের কাছে করুণা প্রদর্শনের আবেদন করেন। তার আবেদনে এটি প্রতীয়মান হয় যে মুহাম্মাদ হয়ত তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে চেয়েছিলেন, যে আদেশ তিনি এরপরে বনু কুরায়জার জন্যেও দিয়েছিলেন, কিন্তু ইবনে উবাইয়ের মধ্যস্থতার পর তাদের শাস্তি লঘু করে তাদেরকে মদিনা থেকে বহিষ্কার করা হয় মাত্র এবং তাদের সহায়-সম্পত্তি সাথে নিয়ে যাওয়ারও অণুমতি দেওয়া হয়। বনু কায়নুকা যাওয়ার সময় এমনকি তাদের ঘরের দরজা পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তারা তাদের বাসস্থান গুলি ধ্বংস করে দেয় যাতে মুসলিমরা সেখানে থাকতে না পারে কিংবা তাদের নির্মাণশৈলী সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে না পারে।[১৩]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Mubarakpuri, Saifur Rahman Al (২০০৫), Ar-Raheeq Al-Makhtum, Darussalam Publications, পৃষ্ঠা 117 
  2. Mubarakpuri, Saifur Rahman Al (২০০২), When the Moon Split, DarusSalam, পৃষ্ঠা 159, আইএসবিএন 978-9960-897-28-8 
  3. Sirat Rasul Allah [The Life of Muhammad], transl. Guillaume, পৃষ্ঠা 363  Authors list-এ |প্রথমাংশ1= এর |শেষাংশ1= নেই (সাহায্য)
  4. Watt (১৯৫৬), Muhammad at Medina :২০৯
  5. Mubarakpuri, Saifur Rahman Al (২০০৫), The sealed nectar: biography of the Noble Prophet, Darussalam Publications, পৃষ্ঠা 284, আইএসবিএন 978-9960-899-55-8 
  6. Stillman, The Jews of Arab Lands: A History and Source Book .
  7. Cook, Michael, Muhammad, পৃষ্ঠা 21 .
  8. Guillaume 363, ibn Kathir 2
  9. William Montgomery Watt, "`Abd Allah b. Ubayy", Encyclopaedia of Islam
  10. William Muir, The Life of Mahomet, vol. 3, chapter 13
  11. Rodinson (2002), p. 173
  12. Glubb (p. 197) refers to Ubada ibn al-Samit as an alternative; a Muslim from the tribe of Aws and also an ally of the Qunayqa, he renounced his friendship the Jews at this point.
  13. Glubb (2002), p. 197f.