ফ্রান্সিস বুকানন
ড. ফ্রান্সিস বুকানন এ ছিলেন একজন এফআরএস, এফআরএসই, এফএলএস, এফএএস, এফএসএ, ডি এল, পরবর্তীতে তিনি ফ্রান্সিস হেমিলটন নামে সুখ্যাতি লাভ করলেও সাধারণত তাকে ফ্রান্সিস বুকানন—হেমিলটন নামে নির্দেশ করা হয়। তিনি ভারতে থাকাকালীন একজন ভৌগলিক, প্রাণিবিদ্যাবিত এবং উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি ভারত থেকে অবসর গ্রহণের তিন বছর পর্যন্ত তিনি 'হেমিলটন' নামটি সম্পর্কে ভাবেন নি।[১]
উদ্ভিতত্ত্বে উদ্ভাবকদের নামের একটি সাধারণ সংক্ষেপণ হলো "বুক.-হাম." (Buch.-Ham)। এটি দ্বারা তার বর্ণিত উদ্ভিদ এবং প্রাণিকে অভিহিত করা হয়, যদিও বর্তমানে মৎস্যবিজ্ঞানে সাধারণত বেশি "হেমিল্টন, ১৮২২" ব্যবহৃত হয় এবং তা মৎস্যবিজ্ঞানীদেরও অধিক পছন্দনীয়।
প্রাথমিক জীবন
সম্পাদনাড. ফ্রান্সিস বুকানন পার্থশিয়ার এর ক্যালেন্ডার শহরের বারডোউয়িতে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে তার মাতা এলিজাবেথ ব্রানজিট এ বসবাস করতেন। তার পিতা টোমাস পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। তিনি স্টারলিং শহরে এসে বুকানন নামটি গ্রহণ করেন এবং লেনি স্টেট এ নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৭৪ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৭৭৯ সালে তিনি এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।[২] তার তিনজন বড় ভাই থাকায় তাকে কোনো কাজের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে হতো। তাই, তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যায়ন করেন। রসখান থেকে ১৭৮৩ সালে এমডি স্নাতক লাভ করেন। সূতরাং, তিনি মার্চেন্ট নেভি জাহাজগুলোতে কাজ করেন এবং তারপর ১৭৯৪ থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত বেঙ্গল মেডিকেল সার্ভিস এ কাজ করেন। তিনি এডিনবরায় জন হোপের অধীনে উদ্ভিদবিদ্যাও অধ্যায়ন করেন, যিনি ব্রিটেন থেকে উদ্ভিদের নামকরণের লিনেন পদ্ধতি শেখাতে এসেছিল তাদের মধ্যে একজন, যদিও তিনি আরও কয়েক জনকে চিনতেন যারা এন্থোইন লরেন্ট ডি জুসিউ অধীনে প্রশিক্ষণ প্রহণ করছিল।[৩]
ভারতে কর্মজীবন
সম্পাদনাবুকাননের প্রথম কর্মজীবন ছিল ইংল্যান্ড এশিয়ার মধ্যে যাতায়াতকারী জাহাজগুলোতে। তার কর্মজীবনের প্রথম বছরগুলো ক্যাপটেন আলেক্সান্ডার গ্রে এবং জোসেফ ডোরিন এর অধীনে বম্বে এবং চীনে যাতায়াতকারী 'ডিউক অব মন্ট্রোজ' জাহাজ ডাক্তার ছিলেন। তারপর তিনি ক্যাপটেন গ্রে এর অধীনে করমন্ডল উপকূল করাবর যাতায়াতকারী জাহাজ 'ফিনিক্স' এ কাজ করেন। ১৭৯৪ সালে তিনি পোর্টসমাউথ থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া জাহাজ 'দা রোজ' এ কাজ করেন। সেই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে তিনি Bengal Presidencyবেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মেডিকেল সার্ভিস এ যোগ দেন। ক্যাপটেন সাইমস এর অধীনে বার্মা আভা রাজ্যে একটি রাজনৈতিক মিশনের জন্য তার চিকিৎসক এবং উদ্ভিদবিদ হিসেবে প্রশিক্ষণ আদর্শ ছিল। তিনি তাই আভা মিশনের জন্য 'সি হর্স' জাহাজে রওনা দিলেন (পূর্বে নিযুক্ত ডাক্তার পিটার কোকরেন এর পরিবর্তে) এবং আন্দামান দ্বীপ, পেগু এবং আভা পারি দিয়ে আবার কলকাতায় ফিরে আসেন।[৩]
তারপর তাকে বর্তমান বাংলাদেশের চাঁদপুরের কাছে অবস্থিত পাত্তাহাটে নিয়োগ করা হয়।
১৭৯৮ সালে তাকে চট্টগ্রাম ও তার সন্নিহিত এলাকায় রপ্তানির উপযোগী মশলা ও কৃষিপণ্য উৎপন্ন করা যায় কিনা তার উপর জরিপ করার দায়িত্ব পান। ১৭৯৮ সালের ২ মার্চ থেকে মে মাসের ২১ তারিখ পর্যন্ত তিনি মাটির গুণাগুণ, ফসল উৎপাদনের ধরন, উদ্ভিদ সংক্রান্ত বিষয়, সমাজিক প্রতিষ্ঠান, গবাদি পশু পালনের অবস্থা এবং উক্ত অঞ্চলের সমাজ ও অর্থনীতি সম্পর্কিত নানা বিষয় নিয়ে জরিপ তৈরি করেন। তাঁর জরিপ ও সংগৃহীত তথ্যাদি ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রকৃতিবিজ্ঞানিগণ বর্তমান সময়ের বাংলা সম্পর্কে গবেষণার উৎস হিসেবে তার বিবরণী ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেন।
টিপু সুলতান এর পরজয় এবং মহীশূরের পতনের পর তাকে দক্ষিণ ভারতের উপর একটি জরিপ পরিচালনা করতে বলা হয়, যার কারণে তাকে মাদ্রাস থেকে মহীশূর, কানারা এবং মালাবার এর দেশগুলোর মধ্যে একটি যাত্রা করতে হয় (১৮০৭ সালে)। তিনি নেপাল রাজ্যেরও বিবরণী লিখেছেন (১৮১৯ সালে)।
তিনি ১৮০৭ সাল থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত দুটি জরিপ পরিচালনা করেছিলেন, যার প্রথমটি ছিল মহীশূরের উপর এবং দ্বিতীয়টি ছিল বঙ্গের উপর। তিনি ১৮০৩ সাল থেকে ১৮০৪ সাল পর্যস্ত কলকাতায় ভারতের জেনারেল রিচার্ড ওয়েলেসলি এর ডাক্তার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি একটি চিড়িয়াখানাও তৈরি করেছিলেন, যা ছিল আলিপুর চিড়িয়াখানা। ১৮০৪ সালে, তিনি ভারতের সাধারণ ইতিহাস প্রচারের জন্য ব্যারাকপুরে ওয়েলসলি এর প্রতিষ্ঠা করা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন।
১৮০৭ সাল থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত বায়লার শাসন বিভাগের নির্দেশনায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আইনি ক্ষমতার অধীনে থাকা স্থানগুলোর একটি বিস্তৃত জরিপ তৈরি করেন। তাকে ভূসংস্থান, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, বসবাসকালী মানুষের অবস্থা, প্রকৃতিক উৎপাদন (সাধারণত মৎষজ, বন, উৎস এবং খনি), কৃষি (শাকসবজি, সরঞ্জাম, সার, খাদ্য, গৃহপালিত পশু, খামার, ভূ-সম্পত্তি, জরিমানা এবং প্রচলিত শিল্প) এবং বাণিজ্যের (আমদানি-রপ্তানি, ভর ও পরিমাণ এবং পণ্যের বিক্রয়পত্র) বিবরণী উপস্থাপন করতে বলা হয়। তার ফলাফল একটি গ্রন্থের সিরিজে লেখা হয়, যুক্তরাজ্যের পাঠাগারগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিবর্তীতভাবে রাখা আছে; অনেকগুলো আধুনিক সংস্করণে পুন:প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোতে গঙ্গা এবং অন্যান্য শাখা নদীতে পাওয়া বিভিন্ন মাছের বিবরণ রয়েছে (১৮২২ সাল লেখা)। এগুলোতে ১০০-র বেশি প্রজাতির মাছের বিবনণ দেওয়া হয়েছে, যেগুলো তেমন বৈজ্ঞানিকভাবে চেনা যায় না।
সে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন নতুন উদ্ভিদও সংগ্রহ করেছেন। তিনি ভারত এবং নেপালের বিভিন্ন উদ্ভিদ এবং পশুর জলরংও সংগ্রহ করেছেন, যা সম্ভবত ভারতীয় শিল্পীদের রং করা। এখন সেসক বিবরণী লন্ডনের লন্ডনের লিনেন সোসাইটির পাঠাগারে রয়েছে।
১৮০৬ সালের মে মাসে তিনি রয়েল সোসাইটির একজন কর্মী[৪] এবং ১৮১৭ সালের জানুয়ারি মাসে এডিনবরা এর একজন কর্মী হিসেবে নির্বাচিত হন।
পরবর্তী জীবন
সম্পাদনাতিনি ১৮১৪ সালে কলকাতা উদ্ভিদ উদ্যান অধ্যক্ষের দায়িত্ব উইলিয়াম রক্সবার্গকে হস্তান্তর করেন। ১৯১৪ সালে তাকে তার অসুস্থতার জন্য ব্রিটেনে ফিরে যেতে হয়। একটি মজার ব্যাপার এই যে, ১৭৮০ সালে হোপের উদ্ভিদবিদ্যার বক্তব্যগুলোর যে নোট তিনি নিয়েছিলেন তা ১৭৮৫ সালে জাহাজে তার এক সহযাত্রী আলেকজেন্ডার বোসওয়েল তার কাছ থেকে ধার নিয়েছিল। কোসওয়েল সেই নোটগুলো মহীশূরের সথ্যামঙ্গলমে হারিয়ে ফেলেন এবং সেগুলো টিপু সুলতানের পান এবং তিনি সেগুলো আবার একত্রিত করেন। ১৮০০ সালে একজন তা টিপু সুলতানে পাঠাগার থেকে খুজে পান এবং তা বুকাননকে ফিরিয়ে দেন।
১৮১৫ সালে তিনি ভারত ত্যাগ করেন এবং সেই বছরই তিনি তার মাতার সম্পত্তি লাভ করেন। তাই তিনি তার মায়ের নামের শেষ অংশ 'হেমিলটন' লাভ করেন, ফলে তিনি 'ফ্রান্সিস হেমিলটন', আনুষ্ঠানিকভাবে 'বুকানন' এবং সাধারণভাবে ফ্রান্সিস হেমিলটন নামে পরিচিত ছিলেন, তাকে যদিও অনেক সময়ই তাকে 'বুকানন হেমিলটন', 'ফ্রান্সিস হেমিলটন বুকানন', 'ফ্রান্সিস কুকানন হেমিলটন' নামে অভিহিত করা হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
১৮১৫ সাল থেকে ১৮২৯ সাল পর্যন্ত এডিনবরাতে ডঃ উইলিয়াম রক্সবার্গ পরিবর্তে তিনি রোয়াল বোটানিক গার্ডেনের রিজিয়াস কিপার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।[৫]
তিনি রংপুর ও দিনাজপুরের উপর যে জরিপ করেছিলেন তার বিবরণী বর্তমানের গবেষকগণের কাছে একটি অমূল্য আকর। তিনি ১৮২৯ সালের ১৫ই জুন মৃত্যুবরণ করেন।
আদর্শ
সম্পাদনাফ্রান্সিস হেমিলটন-কুকাননকে দক্ষিণ এশীয় কচ্ছপের একটি প্রজাতির নির্দিষ্ট নাম "জিওক্লেমিস হেমিলটনি" এর মাধ্যমে স্মরণ করা হয়।[৬]
সংক্ষেপণ
সম্পাদনাকোনো উদ্ভিদের নামের উদ্ধৃতি প্রদানের সময় একটি সাধারণ সংক্ষেপণ "বুক.-হাম." (Buch.-Ham.) ব্যবহার করা হয়, যা উক্ত এই ব্যক্তিকে উদ্ভাবক হিসেবে নির্দেশ করে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ V.H. Jackson, preface in "Journal of Francis Buchanan", Delhi 1989
- ↑ Biographical index of former fellows of the Royal Society of Edinburgh 1783 – 2002 (পিডিএফ)। The Royal Society of Edinburgh। জুলাই ২০০৬। আইএসবিএন 0 902 198 84 X। ২৪ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ এপ্রিল ২০২০।
- ↑ ক খ Watson, Mark F.; Noltie, Henry J. (২০১৬)। "Career, collections, reports and publications of Dr Francis Buchanan (later Hamilton), 1762–1829: Natural history studies in Nepal, Burma (Myanmar), Bangladesh and India. Part 1"। Annals of Science। 73 (4): 392। ডিওআই:10.1080/00033790.2016.1195446। পিএমআইডি 27399603।
- ↑ "Library and Archive Catalogue"। Royal Society। সংগ্রহের তারিখ ২০ ডিসেম্বর ২০১০।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ Grants Old and New Edinburgh
- ↑ Beolens, Bo; Watkins, Michael; Grayson, Michael (2011). The Eponym Dictionary of Reptiles. Baltimore: Johns Hopkins University Press. xiii + 296 pp. আইএসবিএন ৯৭৮-১-৪২১৪-০১৩৫-৫. ("Hamilton", p. 114).
আরও পড়ুন
সম্পাদনা- Vicziany, Marika (১৯৮৬)। "Imperialism, Botany and Statistics in Early Nineteenth-Century India: The Surveys of Francis Buchanan (1762-1829)"। Modern Asian Studies। 20 (4): 625–660। জেস্টোর 312628।
- Buchanan, Francis (১৮০৭)। A Journey from Madras through the Countries of Mysore, Canara and Malabar। London: T. Cadell & W. Davies / Black, Parry & Kingsbury। – in three volumes, publishers noted as booksellers to the Asiatic Society and the East India Company, respectively.
- Noltie, H.J. (1999) Indian botanical drawings 1793–1868. আইএসবিএন ১-৮৭২২৯১-২৩-৬