ফাতিহ মসজিদ, ইস্তাম্বুল
ফাতিহ মসজিদ (তুর্কি: Fatih Camii, বাংলায়: "বিজেতার মসজিদ") তুরস্কের ইস্তাম্বুলের ফাতিহ জেলার একটি উসমানীয় মসজিদ। মূল মসজিদটি ১৪৬৩ থেকে ১৪৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অ্যাপোস্টলস গির্জার ভূমিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এটি ১৭৬৬ সালে ভূমিকম্পে প্রায় লয়প্রাপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তারপর ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে ভিন্ন নকশায় মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করা হয়। এটি উসমানীয়-ইসলামী স্থাপত্যের অন্যতম বড় উদাহরণ এবং এটি উসমানীয় স্থাপত্যের ক্লাসিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে প্রতিনিধিত্ব করে। এই মসজিদটির নাম উসমানীয় সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহের নামে নামকরণ করা হয়েছে। যিনি তুর্কীতে "ফাতিহ সুলতান মেহমেদ" নামে পরিচিত। এই উসমানীয় সুলতান ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপল বিজয় করেন।
ফাতিহ মসজিদ | |
---|---|
ধর্ম | |
অন্তর্ভুক্তি | সুন্নী ইসলাম |
অবস্থান | |
অবস্থান | ইস্তাম্বুল, তুর্কী |
ইস্তাম্বুলের ফাতিহ জেলায় মসজিদটির অবস্থান | |
স্থানাঙ্ক | ৪১°১′১১″ উত্তর ২৮°৫৬′৫৯″ পূর্ব / ৪১.০১৯৭২° উত্তর ২৮.৯৪৯৭২° পূর্ব |
স্থাপত্য | |
স্থপতি | আতিক সিনান, মিমার মেহমেত তাহির |
ধরন | মসজিদ |
ভূমি খনন | ১৪৬৩ |
সম্পূর্ণ হয় | ১৭৭১ (ভূমিকম্পের পর পুনঃস্থাপিত) |
বিনির্দেশ | |
গম্বুজের ব্যাস (ভেতরে) | ২৬ মিটার (৮৫ ফু) |
মিনার | ২ |
উপাদানসমূহ | গ্রানাইট, মার্বেল |
সাহন-ই সেমান মাদরাসা, যেটি ধর্মতত্ত্ব, আইন, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা এবং গণিতের মতো বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী মুসলিম বিজ্ঞান অধ্যয়নের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল; সেটি ফাতিহ মসজিদের অংশ হিসেবে্বংই ছিল এটি তুর্কী জ্যোতির্বিজ্ঞানী আলী কুশজি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যাকে মুহাম্মাদ ফাতিহ ইস্তাম্বুলে তার রাজদরবারে আমন্ত্রণ করেছিলেন।
ইতিহাস
সম্পাদনাফাতিহ মসজিদ কমপ্লেক্সটি ছিল অভূতপূর্ব আকার এবং জটিলতার একটি ধর্মীয় ও সামাজিক ভবন, যেটি ১৪৬৩-১৪৭০ সালের মধ্যে ফাতিহ সুলতান মুহাম্মাদের আদেশে ইস্তাম্বুলে স্থাপিত হয়েছিল।[১] মসজিদটি বাইজেন্টাইন গির্জা অ্যাপোস্টলসের ভূমিতে নির্মিত হয়েছিল। গির্জাটি চতুর্থ ক্রুসেডের পর থেকে অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় পড়ে ছিল। এরপর ফাতিহ মসজিদ স্থাপনের জন্য গির্জাটি ভেঙ্গে ফেলা হয়।[১] গির্জাটি ছিল রোমান সম্রাট কনস্টানটাইনের সমাধিস্থল— মসজিদ নির্মাণের আগে, কনস্টানটাইনের শবধারটি যিশুর প্রেরিত ১২জন প্রতিনিধির শবধারের প্রতীকী স্থানের মাঝখানে স্থাপন করা হয়েছিল।[২]
এটি নির্মাণ করেছিলেন গ্রীক স্থপতি আতিক সিনান।[১][৩] ফাতিহ মসজিদটি উসমানীয় স্থাপত্য ঐতিহ্যের প্রথম স্মারক প্রকল্প।[১]
মূল কমপ্লেক্সটি মসজিদের চারপাশে নির্মিত সুপরিকল্পিত ভবনগুলির আনুষঙ্গিকের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মধ্যে রয়েছে আটটি মেদরেসে, গ্রন্থাগার, হাসপাতাল, ধর্মশালা, ক্যারানভানসরাই,[৪] বাজার, মুসাফিরদের জন্য গোসলখানা, প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং জনসাধারণের রান্নাঘর (ইমারেত) যা দরিদ্রদের খাবার পরিবেশন করে। পরবর্তীতে বিভিন্ন মাজার যোগ করা হয়েছে। মূল কমপ্লেক্সটি ফেভজিপাসা রাস্তার গোল্ডেন হর্নের পাশ বরাবর চতুর্ভুজ আকারে ৩২৫ মিটার (১,০৬৬ ফুট) স্থান দখল করেছে।
১৫০৯ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পে প্রথম তৈরি করা মসজিদটি খুবই বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।[৫] যা পরবর্তীতে মেরামত করা হয়। কিন্তু এরপর আবার ১৫৫৭ ও ১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পে এটি ক্ষতিগ্রস্থ হয় ও মেরামত কর আহরা হয়। কিন্তু ২২শে মে ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পে এটি পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তখন মূল গম্বুজটি ধ্বসে পড়ে ও দেয়ালগুলো মেরামতের অযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বর্তমান মসজিদটি (পুরোপুরি ভিন্ন নকশায় স্থাপিত) ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে সুলতান তৃতীয় মুস্তফার অধীনে নির্মিত হয়।[৪] স্থাপত্যটি মিমার মেহমেত তাহির নামের তুর্কী বিখ্যাত স্থপতি কর্তৃক অঙ্কিত হয়।[৫]
স্থাপত্য
সম্পাদনাবহিরাগত
সম্পাদনাপ্রথম ফাতিহ মসজিদের একটি কেন্দ্রীয় গম্বুজ ছিল কিবলার দিকে ব্যাসের একটি একক অর্ধগম্বুজের, যা চারটি খিলানে ঝুলানো ছিল, এর গম্বুজের ব্যাস ছিল 26 মিটার।[১] দ্বিতীয় মসজিদ যা ১৭৬৬ সালের ভূমিকম্পের পর সুলতান মুস্তফা তৃতীয় দ্বারা নির্মিত (১৭৭১) একটি বর্গাকার মসজিদের পরিকল্পনায় নির্মিত হয়েছিল। এটির একটি কেন্দ্রীয় গম্বুজ রয়েছে যা চারটি অর্ধগম্বুজ দ্বারা বেষ্টিত।[১] প্রাঙ্গণ, প্রধান প্রবেশদ্বার এবং মিনারের নীচের অংশগুলি মূল নির্মাণ থেকে রয়ে গেছে, বাকি অংশ ১৭৭১ সালের বারোক পুনর্গঠনের অন্তর্ভুক্ত।
অভ্যন্তরীণ
সম্পাদনাফাতিহ মসজিদের বর্তমান অভ্যন্তরটি মূলতঃ সিনান দ্বারা উদ্ভাবিত প্রাথমিক নকশার একটি অনুলিপি, যা ইস্তাম্বুলে সিনান এবং তার উত্তরসূরিরা বারবার ব্যবহার করেছেন (এই কৌশলটি আয়া সোফিয়ার অনুকরণীয়)। ২৬ মিটার ব্যাসের কেন্দ্র গম্বুজটি প্রতিটি অক্ষের চারটি অর্ধ-গম্বুজ দ্বারা বেষ্টিত, যা চারটি বড় মার্বেল কলাম দ্বারা সমর্থিত। মসজিদটির দুইটি মিনার রয়েছে, যার প্রত্যেকটির দুটি করে ধারি রয়েছে। মসজিদের ভিতরের চারুলিপি এবং মিম্বর বারোক স্থাপত্যের প্রভাব প্রমাণ করে। তবে নিম্নমানের সাদা টালিগুলোর কারণে রুস্তম পাশা মসজিদের মত ইজনিক টালি দ্বারা কারুকার্যকৃত অন্যান্য মসজিদগুলো সাথে এটির তুলনা করা যায়না। মসজটির মিহরাবটি প্রথম নির্মাণের সময়কার।[১]
কমপ্লেক্স
সম্পাদনাইস্তাম্বুলের অন্যান্য উসমানীয় মসজিদগুলোর ন্যায় ফাতিহ মসজিদও একটি কুল্লিয়া বা সংলগ্ন কাঠামোর সমন্বয়ে ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক উভয় প্রয়োজনের জন্য নকশা করা হয়েছিল।
মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণে রয়েছে সাহন-ই সেমান, উভয় দিকেই চারটি করে আটটি বড় বড় মাদরাসা। এই ভবনগুলো প্রতিসম এবং প্রতিটিতে ছাত্রদের জন্য ১৮টি ঘর রয়েছে (প্রতিটিতে চারজন শিক্ষার্থী থাকতে পারে)। আরো রয়েছে একটিদের্শানে । প্রতিটি ভবনের পিছনে একটি আনুষঙ্গিক অংশ ছিল, যেগুলোর আকার মাদরাসার প্রায় অর্ধেক ছিল; যার সবকটিই রাস্তা নির্মাণের ফলে ধ্বংস হয়ে গেছে। মাদরাসাগুলো প্রায় এক হাজার ছাত্রের জন্য নিমার্ণ করা হয়েছিল, যা কমপ্লেক্সটিকে সেসময়ের জন্য একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেছিল।
ধর্মীয় অতিথিশালা (তাফানে ) মসজিদ চত্বরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের বাইরে অবস্থিত। ভবনটিতে একটি সুন্দর উঠোন রয়েছে, যাতে রয়েছে ১৬টি ভের্দ অ্যান্টিক ও গ্রানাইটের ব্যতিক্রমধর্মী স্তম্ভ, যা সম্ভবত অ্যাপোস্টলস গির্জা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। তাফানের বিপরীতে রয়েছে সুলতান মাহমুদ দ্বিতীয়র মা নকশ-ই দিল সুলতানার বড় মাজার।
মসজিদের অন্তরালে কিবলার দিকের গোরস্থানে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ ও তার স্ত্রী গুলবাহার হাতুনের মাজার। দুটিই ভূমিকম্পের পর পুনর্গঠিত হয়। ফাতিহের মাজারটি বারোকসহ অত্যন্ত শালীনভাবে সজ্জিত। গুলবাহার হাতুনের মাজারটি একেবারে সাদাসিধা আর সম্ভবতঃ প্রায় ফাতিহের মাজারের অনুরূপ। এছাড়াও, কবরস্থানে উসমান নূরী পাশাসহ অনেক নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের কবর রয়েছে। বিশিষ্ট উসমানীয় সালাতনাতের গবেষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হালিল ইনালসিককে ২০১৬ সালে এখানে সমাহিত করা হয়েছিল।
মসজিদের কিবলার পাশে মসজিদের সাথেই যুক্ত, একটি গম্বুজযুক্ত গ্রন্থাগার রয়েছে; যা ১৭২৪ সালে নির্মিত হয়েছিল। গ্রন্থাগারটির একটি দরজা রাস্তার দিকে মুখ করা, অন্য দুটি মসজিদের অভ্যন্তরীণ প্রাঙ্গণে মুখ করা। গ্রন্থাগারটি মেরামত করা হচ্ছে এবং বইগুলি সুলেমানিয়া লাইব্রেরির সুরক্ষার অধীনে রয়েছে।
কমপ্লেক্সের ক্যারাভানসেরাই ১৯৮০-এর দশকে মেরামত করা হয়েছিল এবং একটি কর্মক্ষেত্র হিসাবে কাজ শুরু করার জন্য নতুন দোকানগুলোর সাথে যুক্ত করা হয়েছিল। মূল কমপ্লেক্সের অন্তর্গত হাসপাতাল, বাজার, রান্নাঘর ও গোসলখানা এখন আর নেই।
-
ফাতিহ মসজিদ পশ্চিম পাশে
-
ফাতিহ মসজিদের ভিতরের অংশ
-
ফাতিহ মসজিদের ছাদ
-
ফাতিহ মসজিদের ভিতরের অংশ
-
ফাতিহ মসজিদের গম্বুজ
-
ফাতিহ মসজিদের সাজসজ্জা
-
ফাতিহ সুলতান মসজিদ মাছের চোখ
-
ফাতিহ মসজিদ গ্রুপ
-
ফাতিহ মসজিদ প্রাঙ্গণ
প্রভাব
সম্পাদনাতুর্কী ঐতিহাসিক মেহমেত আগা-ওগলুর মতে, মসজিদটি বাইজেন্টাইন চার্চের স্থাপত্যের প্রতিনিধিত্ব করেনা। বরং ইসলামী ফরাসী মাদরাসা স্থাপত্যের প্রতিনিধিত্ব করে।[৬] এই মতটি তুর্কী অন্যান্য গবেষকদের দ্বারা সমর্থিত যে, উসমানীয় স্থাপত্য "প্রাচ্যের স্থাপত্য ঐতিহ্যের" একটি প্রসারিতরূপ।[৬]
আরও দেখুন
সম্পাদনাপাদটীকা
সম্পাদনা- Cruikshank, Dan (১৯৯৬)। Sir Banister Fletcher's A History of Architecture.। Architectural Press। আইএসবিএন 0-7506-2267-9।
- Freely, John (২০০০)। Blue Guide Istanbul। W. W. Norton & Company। আইএসবিএন 0-393-32014-6।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ Encyclopedia of the Ottoman Empire, Gábor Ágoston,Bruce Alan Masters, page 216
- ↑ Nelson, Eric (২০০১-০৮-০১)। The Complete Idiot's Guide to the Roman Empire। Penguin। আইএসবিএন 978-1-101-19918-3।
- ↑ Van Millingen, Alexander (1912). Byzantine Churches of Constantinople. London: MacMillan & Co., p. 276.
- ↑ ক খ "Fatih Mosque | Istanbul, Turkey Attractions"। Lonely Planet। ২০১৯-১১-০৮।
- ↑ ক খ "A 550-year-old monument to a conqueror Fatih Mosque"। Hurriyet Daily News। ২০১৩-০৩-৩০।
- ↑ ক খ David Gebhard, The Problem of Space in the Ottoman Mosque, The Art Bulletin 45, no. 3 (1963): 272.
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- ফাতিহ মসজিদের ছবি ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে
- ফাতিহ কামি ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখে (তুর্কি)
- মসজিদ ও সমাধির ৯০টিরও বেশি ছবি