পঞ্চানন কর্মকার
পঞ্চানন কর্মকার (মল্লিক) (মৃত্যু: ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন বাংলা মুদ্রণাক্ষরের স্রষ্টা ও মুদ্রণশিল্পের প্রযুক্তিবিদ। তিনি শ্রীরামপুরে বসবাস করতেন। তিনি চার্লস উইলকিন্সকে প্রথম বাংলা মুদ্রণকাজে সহায়তা করেন।[১] তাঁর আবিষ্কৃত কাষ্ঠনির্মিত বাংলা বর্ণ এবং মুদ্রণাক্ষর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহজ সংস্করণ প্রস্তাব করার আগপর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছিল।[২] কর্মকার বাংলা ছাড়াও আরবি, ফার্সি, মারাঠি, তেলুগু, বর্মী ও চীনাসহ ১৪টি ভাষার মুদ্রণশিল্পে উন্নয়ন করেন।[১]
পঞ্চানন কর্মকার | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দ |
পরিচিতির কারণ | মুদ্রণশিল্পে অবদান |
জন্ম
সম্পাদনাপঞ্চানন কর্মকার জন্মগ্রহণ করেন হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে।[৩][১][৪] তাঁর পূর্বপুরুষ পেশায় ছিলেন কর্মকার বা লৌহজীবী। কিন্তু বেশ কয়েক পুরুষ আগে তাঁরা ছিলেন লিপিকার। তাম্রপটে, অস্ত্রশস্ত্রে অলঙ্করণ বা নামাঙ্কনের কাজে তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ।[১] তাঁর চরিত্রেও পূর্বপুরুষদের এই শিল্পবৃত্তির গুণপনার প্রকাশ ঘটে। তাঁর পূর্বসূরিরা প্রথমে ছিলেন হুগলি জেলার জিরাটের অধিবাসী, পরে ত্রিবেণীতে বসবাস শুরু করেন।
কর্মজীবন
সম্পাদনা১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে চার্লস উইলকিন্স যখন হুগলিতে ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেডের লেখা 'অ্যা গ্রামার অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ' বইটি মুদ্রণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন,[৫] তখন পঞ্চাননবাবু তাঁর প্রযুক্তিজ্ঞান নিয়ে বাংলা হরফ প্রস্তুতের কাজে উইলকিন্সকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। বইটির মুদ্রণে ছেনিকাটা, ঢালাই করা চলনশীল বা বিচল যে ধাতব হরফ ব্যবহার করা হয়, তা উইলকিন্স এবং পঞ্চাননবাবুর যৌথ প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছিল।[৬] ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের উৎসাহে উইলকিন্সের পরিচালনাধীনে কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছাপাখানায় তিনি কাজ শুরু করেন। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে পুরোদমে এই সরকারি ছাপাখানা চালু ছিল; পঞ্চাননবাবু সেখানে কাজ করতেন। হরফ নির্মাণের কলাকৌশল তিনি উত্তমরূপে আয়ত্ত করেছিলেন। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ উইলিয়াম কেরির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয় এবং সে বছরই তিনি কেরি সাহেবের উদ্যোগে শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে যোগদান করেন।[১] একটি পুরোনো মেশিন নিয়ে এই প্রেসের কাজ শুরু হয়। কিন্তু পঞ্চাননবাবুর মেধা, অক্লান্ত পরিশ্রম ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অল্প দিনের মধ্যে এটি এশিয়ার বৃহত্তম অক্ষর তৈরির কারখানা অর্থ্যাৎ টাইপ ফাউন্ড্রিতে পরিণত হয়।
১৮০১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর তৈরি হরফে বাংলায় কেরির করা বাইবেলের নূতন নিয়মের অনুবাদ ছাপা হয়।[৭] ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনিই প্রথম ভারতবর্ষে দেবনাগরী ভাষায় হরফ নির্মাণ করেন। কেরির সংস্কৃত ব্যাকরণ মুদ্রণের জন্য তিনি দেবনাগরী ভাষায় হরফ তৈরি করেন।[১] পরে তিনি আরো ছোটো ও সুন্দর এক স্পষ্ট বাংলা হরফের নকশা তৈরি করেন। বাংলা মুদ্রণশিল্পে পঞ্চানন কর্মকারের তৈরি হরফের নকশা দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ছিল। বাংলা ভাষায় ছাপার ইতিহাসে প্রথম চলনসই বাংলা ও সংস্কৃত অক্ষরের ছাঁচ তৈরির অগ্রদূত হিসেবে পঞ্চানন কর্মকারের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
পঞ্চাননবাবু তাঁর জামাতা মনোহর কর্মকারকে সযত্নে তাঁর সমস্ত জ্ঞান ও কলাকৌশল শিখিয়ে যান; মনোহর কর্মকার পরিশ্রম, সাধনা ও মেধা পাথেয় করে আরবি, ফারসি, গুরুমুখি, মারাঠি, তেলুগু, বর্মি, চীনা প্রভৃতি অন্তত চোদ্দোটি বিভিন্ন ভাষার হরফ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
মৃত্যু
সম্পাদনাচলনযোগ্য বাংলা ও সংস্কৃত হরফ তৈরির প্রথম শিল্পী পঞ্চানন কর্মকার ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।[১][৩]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ আইয়ুব হোসেন (২০১২)। "পঞ্চানন কর্মকার"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- ↑ গোলাম মুরশিদ (২০১২)। "বিদ্যাসাগর, ঈশ্বরচন্দ্র"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- ↑ ক খ দৈনিক, ইত্তেফাক (১২ জুন ২০১৫)। "হরফ নির্মাতা পঞ্চানন কর্মকার ও তাঁর উত্তরসূরিগণ"। ইত্তেফাক। ১৫ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২২।
- ↑ "পঞ্চানন কর্মকার"। onushilon.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-০৪।
- ↑ গ্রীনস্প্যান, এজরা; রোজ, জনাথন (সেপ্টেম্বর ২০০৩)। Book History - Ezra Greenspan, Jonathan Rose। আইএসবিএন 0271023309। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৬-০২।
- ↑ Works [ed. by E.R. Rost]. - Horace Hayman Wilson -। ১৮৬৫। পৃষ্ঠা ২৭৩। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৬-০২ – ইন্টারনেট আর্কাইভ-এর মাধ্যমে।
charles wilkins.
- ↑ "Flower power resurrects Carey legacy"। দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া। ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১২। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ২০, ২০১৬।