নাৎসি বন্দীশিবির
১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নাৎসি জার্মানিতে সহস্রাধিক বন্দীশিবির পরিচালনা করা হতো। জার্মানির মূল ভূখণ্ড এবং জার্মান অধিকৃত অন্যান্য ইউরোপীয় অঞ্চলে এই বন্দীশিবিরগুলি অবস্থিত ছিল।
১৯৩৩ সালে অ্যাডলফ হিটলার জার্মান চ্যান্সেলর নির্বাচিত হবার পর প্রথম বন্দীশিবিরগুলি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৩৪ সালে "দীর্ঘ ছুরির রাত্রি"(হিটলারের নির্দেশে সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড) সংঘটনের পর শ্যুৎসষ্টাফেলন (এসএস) বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বন্দীশিবিরগুলি প্রতিষ্ঠা করা হয়। শুরুতে অধিকাংশ সদস্যই ছিল জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। পরবর্তীতে "স্বভাবগত অপরাধী", "সমাজবিরোধী" এবং "ইহুদি"দের এসব বন্দীশিবিরে বন্দী করা হতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বন্দীশিবিরগুলিতে বন্দীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। ২য় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি বিজয়ী হলে বন্দীশিবিরগুলির বন্দীদের মুক্ত করা হয়। তবে ইতোমধ্যে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল।
এক হাজারেরও বেশি বন্দীশিবির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এবং ১৬ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ সেগুলিতে বন্দী হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছিল।
পটভূমি
সম্পাদনাধারণা করা হয়, দ্বিতীয় বুর যুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা বন্দীশিবির ধারণাটির উদ্ভব ঘটায়। তবে ঐতিহাসিক ড্যান স্টোন-এর মতে, ফিলিপাইন ও কিউবায়ও বন্দীশিবিরের প্রচলন ছিল। ড্যানের মতে, এটি উপনিবেশবাদী চিন্তাধারার একটি যুক্তিসংগত বিস্তার।[১] তবে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিটিশ পরিচালিত বন্দীশিবিরে নাৎসিদের বন্দীশিবিরের মত পদ্ধতিগত গণহত্যার প্রচলন ছিল না। নাৎসি বন্দীশিবিরে মৃত্যুহার ছিল ৪৫%, যা ব্রিটিশ বন্দীশিবিরে মৃত্যুহারের দ্বিগুণ। [১]
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অনেক সৈন্যকেই যুদ্ধবন্দী করে রাখা হয়। যে সকল স্থানে তাদের বন্দী রাখা হয়, সেই স্থানগুলোর অনেকগুলোতেই নাৎসি বন্দীশিবির প্রতিষ্ঠা করা হয়। জার্মানিতে অনেক বন্দীকেই প্রয়োজনীয় আহার্য থেকে বঞ্চিত করে বিপজ্জনক পরিবেশে রাখা হয়, যা ১৯০৭ সালের হেগ সম্মেলন চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ছিল। আর্মেনীয় গণহত্যার সময় আর্মেনীয়দের সিরিয়ার মরুভূমিতে নির্বাসিত করার আগে দুর্বিষহ পরিবেশে আটকে রাখা এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে অনেক পূর্ব ইউরোপীয় ইহুদি ব্যক্তি জার্মানিতে ফিরলে তাদের "অবাঞ্ছিত বিদেশী" হিসাবে আখ্যায়িত করে আটকে রাখা হয়। জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে অনেক সন্দেহভাজন নাগরিকদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হয়। [১]
ইতিহাস
সম্পাদনা১৯২৯ সালের মহামন্দার ফলে জার্মানিতে ভাইমার প্রজাতন্ত্র অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। ১৯৩০ সালে নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটে। পল ভন হিন্ডেনবুর্গ ভাইমার সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একের পর এক চ্যান্সেলর নিয়োগ দিতে থাকেন। পূর্বসূরি ফ্রানৎস ফন পাপেনের সাথে সমঝোতা করে হিটলার ক্ষমতায় আসীন হতে সক্ষম হন।[২]
মূলত নাৎসিবিরোধীদের অবদমনের লক্ষ্যেই নাৎসি বন্দীশিবিরের উৎপত্তি। ১৯৩৩ সালের রাইখষ্টাগ অগ্নিকাণ্ডকে অজুহাত বানিয়ে হাজার হাজার মানুষকে নাৎসি সরকার গ্রেফতার করে। "রাইখষ্টাগে অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কিত অধ্যাদেশ" জারি করে সকল প্রকার ব্যক্তিস্বাধীনতা বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। ৩ মার্চ ট্যুরিঙেন রাজ্যের নোরা শহরের একটি বিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম বন্দীশিবির প্রতিষ্ঠা করা হয়। [২] ৫ই মার্চের নির্বাচনের পরে আটকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। স্থানীয় পুলিশ, শ্যুৎস্টাফেলন প্রভৃতি বন্দীশিবিরগুলি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
"সুরক্ষা দেবার জন্য নিরাপদ হেফাজতে নেওয়া",কিংবা "রাষ্ট্রদ্রোহী আচরণ প্রতিহতকরণ"- এ সকল ভিত্তিতে মানুষদের বন্দীশিবিরে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো। খবরের কাগজগুলো এ সময় বিশাল প্রতিবেদন রচনা করত এবং ঐ প্রতিবেদনে বন্দীশিবিরের বন্দীদের তীব্র ভর্ৎসনা করত।[৩] আশি শতাংশ বন্দী ছিল কমিউনিস্ট ও দশ শতাংশ বন্দী সোশ্যাল ডেমোক্রেট পার্টির সদস্য ছিল। মার্টিন শুমাখারের মতে, ভাইমার যুগের ২৪১ জন সাংসদকে বন্দী করে রাখা হয়। [২] ১৯৩৩ সালে "খ্রিস্টীয় দায়মুক্তি" নামক বহুল প্রচারিত একটি সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে অনেকেই মুক্তি পান।[৪]
১৯৩৪-১৯৩৭
সম্পাদনা১৯৩৩ সালের ২৬শে জুন হেনরিক হিমলার থিওডোর আইকে-কে দাচাউ বন্দীশিবিরের দ্বিতীয় সেনাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেন। বন্দীশিবিরটি অন্যান্য বন্দীশিবিরের জন্য আদর্শ হয়ে উঠে। অবাধ্য কয়েদিদের জন্য চাবুকাঘাতসহ অনেক কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রেখে তিনি একটি শাস্তি আইন প্রণয়ন করেন। [২] ১৯৩৪ সালে লাইখটেনবুর্গ ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ হিমলারের নির্দেশে শ্যুৎস্টাফেলন থেকে প্রুশীয় প্রশাসনের হাতে চলে যায়। ১৯৩৪ এর ডিসেম্বরে বন্দীশিবির পরিদর্শন দপ্তর (আইকেএল) প্রতিষ্ঠা করা হয়, যার প্রথম প্রধান ছিলেন থিওডোর আইকে। এর অধীনে সকল ক্যাম্পের ভার ন্যস্ত করা হয়।
১৯৩৩ সালের খ্রিষ্টীয় দায়মুক্তি হিমলারকে ক্রুদ্ধ করে। তিনি একে নাৎসি সরকারের সবচেয়ে বড় ভুল হিসাবে বর্ণনা করেন। তিনি কমিউনিস্ট, সামাজিক গণতন্ত্রী, ফ্রিম্যাসন, ইহুদি - এ শ্রেণির মানুষকে অধঃপতিত বলে গণ্য করতেন। হিটলার হিমলারের চিন্তাধারার সঙ্গে সহমত হয়ে ১৯৩৬ সালে তাকে পুলিশপ্রধান নিযুক্ত করেন।[৪]
১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ছয়টি এসএস শিবিরের মধ্যে শুধূ্ দুইটিই ১৯৩৮ সালে সক্রিয় ছিল। পুরনো বন্দীশিবিরগুলির জায়গায় আইকে নতুন বন্দীশিবির প্রতিষ্ঠা করেন। বন্দীশিবিরগুলিতে বন্দিদের শিবিরের উর্দি ও ব্যাজ পরিধান করতে হতো। এগুলো তারকাঁটা, নজরদারী ফাঁড়ী ও সেনাশিবির দ্বারা বেষ্টিত ছিল। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত তরুণদের এর নিরাপত্তারক্ষী হিসাবে নিযুক্ত করা হত।
১৯৩৭-১৯৩৯
সম্পাদনাতথাকথিত "স্বভাবগত অপরাধী" এবং "সমাজবিরোধী"দের গ্রেফতার করার ফলে ১৯৩৮ সাল নাগাদ বন্দীর সংখ্যা তিন গুণ বেড়ে ২৪০০০-এ দাঁড়ায়। এদের মধ্যে অধিকাংশ বন্দীই ছিল ছিঁচকে চোর বা ছোটখাটো অপরাধী।[৪] ১৯৩৮ সালের জুনে ১০,০০০ বেকার, মানসিক প্রতিবন্ধী এবং গৃহহীনকে বন্দীশিবিরে আটকে রাখা হয়।
নতুন বন্দীদের আবাসনের জন্য ফ্লোসেনবুর্গ, মাউটহাউযেন এবং রাভেনসবুর্গ এলাকায় তিনটি বন্দীশিবির স্থাপন করা হয়, এদের মধ্যে র্যাভেন্সবুর্গ প্রথম নারী বন্দীশিবির। মহামন্দা নিরসনের ফলে বেকারত্বের হার অনেকটাই কমে যায়। তাই কর্মে অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে কর্মরতদের দিয়ে কঠোর পরিশ্রম করানো হত। কুখ্যাত নাৎসিবাদী স্থপতি আলবার্ট স্পির সর্বত্র নাৎসি সৌধ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এজন্য বন্দীশিবিরের বন্দীদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হতো।[৪]
১৯৩৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়া এবং অস্ট্রিয়া দখল করার পর চেক এবং অস্ট্রিয়ানদের গণহারে গ্রেফতার করে বন্দীশিবিরে পাঠানো হয়। ইহুদীদের অন্তরীণ হওয়ার হার ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। ক্রিস্টালনাখট গণহত্যার পরে হাজার হাজার ইহুদিকে গ্রেফতার করে ক্যাম্পে পাঠানো হয়। নির্যাতন,খুন, লুণ্ঠনের শিকার হয়ে অনেকেই মৃত্যুবরণ করে। এসময় অবশ্য ইহুদি হত্যা নয়, বরং তাদের বিদেশ গমনে বাধ্য করাই ছিল ইহুদি নির্যাতনের মুখ্য উদ্দেশ্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
সম্পাদনা১৯৩৯ সালে বন্দিদের পোলীয় উর্দিতে সজ্জিত করে পোল্যান্ড সীমান্তে পাঠিয়ে গণহারে হত্যা করে জার্মানি মিথ্যা নাটক মঞ্চস্থ করে, যাতে সে পোল্যান্ড আক্রমণ করতে পারে।
১৯৪১ সালে পাঁচটি নতুন বন্দীশিবির স্থাপন করা হয়। ঐ বছর এসএস বাহিনীর হাইকমান্ডের নির্দেশ মোতাবেক অসুস্থ এবং কাজ করতে অক্ষম, এমন বন্দিদের 'অপারেশন ১৪এফ১৩' এর মাধ্যমে হত্যা করা হয়। সোভিয়েত যুদ্ধবন্দিদের 'অপারেশন ১৪এফ১৪" এর মাধ্যমে নির্বিচারে খুন করে জার্মান বাহিনীর সদস্যরা। ১৯৪২ এর ভেতরে আউশভিটজ বন্দীশিবিরে বিষাক্ত জিকলন-বি গ্যাস প্রয়োগের ফলে ৪২,০০০ সোভিয়েত মৃত্যুবরণ করেন।[৪]
পরিসংখ্যান
সম্পাদনাওয়াখসম্যানের মতে,২৭টি প্রধান বন্দীশিবির এবং ১১০০টি গৌণ বন্দীশিবিরে বন্দিদের আটকে রাখা হয়েছিল।
ইতিহাসবিদ অ্যাডাম টুজের হিসাব অনুযায়ী,১৬ লক্ষ ৩০ হাজার নিবন্ধিত বন্দির মধ্যে ১১ লক্ষ বন্দীশিবিরে মারা যায়। আউশভিটজ গ্যাস প্রকোষ্ঠে আরো ১০ লক্ষ বন্দিকে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগে হত্যা করা হয়। এই ক্যাম্পগুলোতে সর্বমোট ২০ থেকে ২৮ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারান।[৫]
মুক্তি
সম্পাদনা১৯৪৪-১৯৪৫ সালের ভেতরে মিত্রশক্তি নাৎসি সাম্রাজ্যের অনেক বন্দীশিবির বন্ধ করে দেয়।
১৯৪৪ সালে সোভিয়েতরা সর্বপ্রথম মাজদানেক বন্দীশিবির আবিষ্কার করে। এছাড়াও আরো অনেক বন্দীশিবির তারা আবিষ্কার ও মুক্ত করে। তবে এগুলোর অধিকাংশ বন্দিকে জার্মানরা আগেই সরিয়ে ফেলে।
অনেক বন্দিই জার্মান উৎপীড়ন এবং অপুষ্টির কারণে মুক্তি পাওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করে।[৬]
পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ
সম্পাদনাপশ্চিম জার্মান সরকারের "ভিডারগুটমাখুং" ("পুনরায় ভাল কাজ করা") নীতির আলোকে অনেক বন্দিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, অন্যদিকে অনেক অপরাধীকে শাস্তির সম্মুখীন করা হয়। [৭]
বন্দীশিবিরের অনেক বন্দিই তাঁদের অভিজ্ঞতা বই আকারে প্রকাশ করেন। এদের মধ্যে ১৯৪৭ সালে প্রিমো লেভি তাঁর অভিজ্ঞতা "ইফ দিস ওয়াজ এ ম্যান" গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে সাড়া জাগাতে সক্ষম হন।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ Stone, Dan (২০১৯)। Concentration camps: a very short discussion।
- ↑ ক খ গ ঘ White, E Roberts। Introduction to the early camps।
- ↑ Fings, Carola। The public face of the camps।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ Weichsmann, Nikolaus। A History of the Nazi Concentration Camps।
- ↑ Orth, Karin। The Concentration Camp Personnel।
- ↑ Blatman, Daniel (২০১১)। The Death marches: final phase of the Nazi Genocide।
- ↑ Marcuse, Harold। The Afterlife of the camps।