নায়ক (১৯৬৬-এর চলচ্চিত্র)
নায়ক ১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ও সত্যজিৎ রায় পরিচালিত একটি ভারতীয় বাংলা ড্রামা চলচ্চিত্র। এই ছবির কাহিনী ও চিত্রনাট্যও সত্যজিৎ রায়ই রচনা করেছিলেন। উল্লেখ্য, ১৯৬২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিটির পর এই ছবির চিত্রনাট্যই সত্যজিৎ রায় রচিত সম্পূর্ণ মৌলিক চলচ্চিত্র।
নায়ক | |
---|---|
পরিচালক | সত্যজিৎ রায় |
প্রযোজক | আর. ডি. বনশল |
রচয়িতা | সত্যজিৎ রায় |
শ্রেষ্ঠাংশে | উত্তম কুমার শর্মিলা ঠাকুর |
সুরকার | সত্যজিৎ রায় |
প্রযোজনা কোম্পানি | আর. ডি. বনশল অ্যান্ড কোং |
পরিবেশক | এডওয়ার্ড হ্যারিসন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) |
মুক্তি |
|
স্থিতিকাল | ১২০ মিনিট |
দেশ | ভারত |
ভাষা | বাংলা |
এই ছবির প্রধান চরিত্র বাংলা চলচ্চিত্রের এক ম্যাটিনি আইডল অরিন্দম মুখোপাধ্যায়। তিনি একটি জাতীয় পুরস্কার গ্রহণের জন্য রেলপথে কলকাতা থেকে দিল্লি যাচ্ছিলেন। সেই ২৪ ঘণ্টার যাত্রাপথে অদিতি নামে এক অল্পবয়সী সাংবাদিকের কাছে নিজের ভুলভ্রান্তি, নিরাপত্তাহীনতা ও অনুতাপ প্রকাশের মধ্যে দিয়ে তিনি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, তা-ই এই ছবির উপজীব্য বিষয়। অদিতি পূর্বে ম্যাটিনি আইডল জাতীয় খ্যাতনামা ব্যক্তিদের বিশেষ অপছন্দ করতেন। কিন্তু অরিন্দমের কথা শুনে তিনি বুঝতে পারেন, তার খ্যাতির আড়ালে তার মনের মধ্যে কোথাও একটি একাকিত্বের ভাব রয়েছে। অদিতির মনে অরিন্দমের প্রতি সহানুভূতি জাগে। তিনি স্থির করেন, অরিন্দমের কথা তিনি প্রকাশ করবেন না এবং ম্যাটিনি আইডল জনমানসে তার ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে সাহায্য করবেন। এই ছবিতে সাতটি ফ্ল্যাশব্যাক এবং দু’টি স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে অরিন্দমের জীবনের সঙ্গে তার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থানটিকে পরিস্ফুট করে তোলা হয়েছে।[১][২]
কাহিনী-সারাংশ
সম্পাদনাবাংলা চলচ্চিত্রের ম্যাটিনি আইডল অরিন্দম মুখোপাধ্যায় (উত্তম কুমার) একটি সম্মানজনক জাতীয় পুরস্কার গ্রহণের জন্য দিল্লি যাচ্ছিলেন। কিন্তু বিমানের টিকিট না পাওয়ায় তিনি রেলপথে যাত্রা করতে বাধ্য হন। ট্রেনের রেস্তোরাঁ কারে অরিন্দমের সঙ্গে অদিতি সেনগুপ্ত (শর্মিলা ঠাকুর) নামে এক অল্পবয়সী সাংবাদিকের আলাপ হয়। অদিতি আধুনিকা নামে মেয়েদের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।[২] যাত্রার দিন সকালে সংবাদপত্রে অরিন্দম সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সেই প্রতিবেদনে এমন একটি অপ্রীতিকর ঘটনার উল্লেখ ছিল, যেটির সঙ্গে অরিন্দম বিশ্রীভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন। অদিতি অরিন্দমকে ঠিক পছন্দ করতেন না। তাই অরিন্দমের জীবনের অজ্ঞাত দিকগুলি তুলে ধরার জন্য এবং পাঠকদের কাছে নিজের পত্রিকাটিকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য অদিতি গোপনে তার একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। ধীরে ধীরে অরিন্দমের কথার মধ্যে দিয়ে তার ব্যক্তিসত্তাটি অদিতির কাছে ধরা পড়ে যায়।
প্রথম জীবনে অরিন্দম পাড়ার নাটকে অভিনয় করতেন। চলচ্চিত্র জগৎ থেকে ডাক পাওয়ার পর অরিন্দমের রক্ষণশীল নাট্যশিক্ষক তার প্রবল বিরোধিতা করেন। কিন্তু শঙ্করদার মৃত্যুর পর অরিন্দম তার মতকে ভুল মনে করে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। অরিন্দম তার প্রথম শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা, তার সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং অন্যান্য অপ্রীতিকর নানা ঘটনার কথা অদিতিকে বলেন। এই ঘটনাগুলি ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে ছবিতে তুলে ধরা হয়। এর সঙ্গে যাত্রাপথে তিনি যে দু’টি স্বপ্ন দেখেন, সেগুলির মাধ্যমে তার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা নিরাপত্তাহীনতা, সীমাবদ্ধতা ও অপরাধবোধটিও প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
অদিতি প্রথম দিকে অরিন্দমের কথা নোট করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু পরে অরিন্দমের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে সেই লেখা বন্ধ করে দেন। তবে খানিকটা সমালোচনা-মূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি অরিন্দমের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। এর ফলে অরিন্দমের মানসিক অবস্থাটি সম্পূর্ণ অদিতির কাছে ধরা পড়ে যায়।
ছবির শেষ পর্যায়ে দেখা যায়, অরিন্দম মদ্যপ অবস্থায় অনুভব করেন অদিতির কাছে তার দুষ্কর্মগুলি প্রকাশ করা প্রয়োজন। কিন্তু অদিতি তার মানসিক অবস্থাটি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি তাকে থামিয়ে দেন। অদিতির ভয় হয়, পাছে অরিন্দম আত্মহত্যা করে বসে। তাই নিজের কিউবিকলে ফিরে যাওয়ার আগে অদিতি অরিন্দমকে তার কিউবিকলে পাঠিয়ে দেন।
পরদিন সকালে দিল্লি পৌঁছানোর ঠিক আগে অরিন্দম বুঝতে পারেন, অদিতির সঙ্গে তার একটি বন্ধন গড়ে উঠেছে। তিনি মনে শান্তি পান। অদিতিও অরিন্দমের খ্যাতি ও সাফল্যের আড়ালে লুকায়িত একাকিত্বটি অনুভব করে তার সহানুভূতির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। অরিন্দমের সাক্ষাৎকার তিনি নষ্ট করে দেন। জনসাধারণের কাছে অরিন্দমের নায়ক-সুলভ ভাবমূর্তি বজায় রাখতে দেন।
তিনি যা লিখেছিলেন, তা তিনি ছিঁড়ে ফেললেন। তিনি এভাবেই অরিন্দমকে জনসাধারণের কাছে তার নায়ক-সুলভ ভাবমূর্তি বজায় রাখতে সাহায্য করেন।
নির্মাণ
সম্পাদনাউত্তম কুমারকে নিয়ে পরিচালক সত্যজিৎ রায় কাজ করেছেন দুটো সিনেমাতে। উত্তমকে যখন সত্যজিৎ রায় প্রথম বড়পর্দায় দেখেন, তখন উত্তম কুমার ইতোমধ্যেই মহানায়ক, কিন্তু সত্যজিৎ তখনো তার পরিচালনার খাতা খুলতে পারেননি। সত্যজিতের সবচেয়ে চোখে পড়েছিল নির্মল দে পরিচালিত উত্তম কুমারের বসু পরিবার চলচ্চিত্রটি। মঞ্চ অভিনেতা হওয়া সত্ত্বেও তার সিনেমার অভিনয়ে ছিল না মঞ্চের কোনো ছাপ। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে রোমান্টিক জুটি হয়ে সারা বাংলা কাঁপালেও সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তার কাজ করা হয়েছিল ব্যতিক্রমী দুটি সিনেমায়, একটির নাম নায়ক, অপরটি চিড়িয়াখানা।
নিজের প্রথম সিনেমা "পথের পাঁচালি" দিয়ে সত্যজিৎ রায় একদম নতুন একটি পথে হাঁটা শুরু করেছিলেন, আর আবির্ভাব ঘটেছিল নতুন একটি যুগের।
নায়ক যখন মুক্তি পায়, তখন সেই সিনেমার সাথে তৎকালীন সমালোচকেরা বার্গম্যানের ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ সিনেমার মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। চলন্ত ট্রেনের মধ্যে বিভিন্ন নাটকীয় মুহূর্ত আছে হিচককের বিখ্যাত সিনেমা নর্থ বাই নর্থওয়েস্টে। এই সিনেমার সাথে নায়কের কিছু মিল খুঁজে পাওয়া গেলেও, ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ এর সাথে নায়ক চলচ্চিত্রটির আদতে কোন মিল ছিল না।
নায়ক সিনেমার শুটিং এর আগে উত্তম কিছুটা অসুস্থ ছিলেন। বাড়ির খাবার ছাড়া কিছু খেতেন না। সেই খাবার তাকে দিতে যেতেন তার স্ত্রী সুপ্রিয়া দেবী, কিন্তু কখনও স্টুডিওতে প্রবেশ করেননি তিনি। তবে একদিন করেছিলেন, সেই বিখ্যাত স্বপ্নদৃশ্যের সময়। উত্তম বারবার সুপ্রিয়াকে বলছিলেন, “একটু দেখে যাও! এত ভালো একটা সিন!” দৃশ্যটা ঠিকমতো টেক হচ্ছিল কিনা, সে বিষয়ে বেশ টেনশনে ছিলেন উত্তম।
সিনেমার মুক্তির দিন সম্পর্কে সুপ্রিয়া দেবী বলেন, “ভবানীপুরের ইন্দিরা সিনেমাতে ছিল চলচ্চিত্রটির প্রিমিয়ার শো। আমি আর উত্তম হাজরা মোড়ে পৌঁছে দেখি হাজার হাজার মানুষের মাথা। কি করে হলে পৌঁছাব কিছুতেই বুঝতে পারছি না! উত্তম রীতিমত ঘামছে। অনেক কষ্টে পৌঁছালাম শেষ পর্যন্ত। শো শেষ করে যখন বের হচ্ছি, পাবলিক ‘গুরু, গুরু’ বলে এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল যে উত্তমের শার্টের একটা হাতা ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল। আমার শাড়ির আঁচলটাও নেই! কোনমতে ঐ অবস্থায় গাড়িতে উঠে আমরা তখন সোজা গ্র্যান্ড হোটেলে চলে আসলাম”
সত্যজিৎ রায় এই সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছিলেন দার্জিলিংয়ে বসে। উত্তমের প্রতি সত্যজিতের আলাদা একটা দুর্বলতা ছিল। সত্যজিতের মা-ও উত্তমকে অনেক পছন্দ করতেন। এই চরিত্রে উত্তম ছাড়া আর কাউকে ভাবতেই পারেননি সত্যজিৎ। কারণ এই গল্পটা একজন স্টারের । তাছাড়া মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা একজন মানুষ সংগ্রামের মাধ্যমে স্টার হয়ে উঠেছে, সেটার সাথে উত্তমের জীবনটা বেশ মিলে যায়। উত্তমও প্রচণ্ড খুশি হয়েছিলেন সত্যজিতের সাথে কাজ করে। এত চমৎকার সব শট দিতেন যে সবাই মুগ্ধ হয়ে যেতেন। নায়ক সিনেমার বেশিরভাগ সিন এক টেকে ‘ওকে’ হওয়া। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
উত্তম কুমারের খন্যান স্টেশনে চা খাওয়ার দৃশ্যটি নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছিল। কারণ যে ট্রেনটি দেখানো হয়েছিল, সেই ট্রেনের যাত্রাপথে খন্যান স্টেশন পড়ার কথা নয়। বাংলার দর্শকদের জন্য ব্যাপারটা অস্বস্তিকর হলেও, বিদেশি দর্শকের এতে কোন সমস্যা ছিল না।
উত্তমকুমারকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তাই সিনেমার শেষ দৃশ্যটি হাওড়া স্টেশনেই নেয়া হয়েছিল। চিত্রগ্রাহক সুব্রত মিত্র দিল্লি গিয়ে ওখানকার স্টেশনের শট তুলে এনেছিলেন। পরে এডিটিং এর টেবিলে শট দুটোকে মিলিয়ে দেয়া হয়েছিল।
সত্যজিৎ রায় ডিটেলিং নিয়ে কি পরিমাণ খুঁতখুঁতে ছিলেন, সেটা কমবেশি সবারই জানা। উত্তমকুমারের জন্য শেভিং ব্রাশ খুঁজতে গিয়ে অনেক ধকল গিয়েছিল ইউনিটের লোকদের। প্রায় একশোটা শেভিং ব্রাশ অপছন্দ হওয়ার পর তিনি যেটাতে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, সেটি ছিল পরিচালক তরুণ মজুমদারের।
অদিতি চরিত্রে প্রথমে অন্য কাউকে নেয়ার কথা থাকলেও, শেষ পর্যন্ত পছন্দমত আর কাউকে না পেয়ে সত্যজিৎ শর্মিলা ঠাকুরকেই ডাকেন। শর্মিলা তখন মুম্বাইয়ের সিনেমা নিয়ে অনেক ব্যস্ত। এরপরেও- সত্যজিতের সিনেমা বলে কথা। তিনি ঠিকই শিডিউল ম্যানেজ করে ফেললেন। শুটিং এর সময় মনসুর আলি খান পতৌদি প্রায়ই শুটিং দেখতে আসতেন। সত্যজিৎ খুবই খুশি হয়েছিলেন এই দুজনের বিয়ের খবরে।
শর্মিলা যে চশমাটি নায়ক সিনেমাতে পরেছিলেন, সেটা সম্পর্কে তিনি সত্যজিতকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন- চশমাটা কি শর্ট সাইটের জন্য না লং সাইটের জন্য? সত্যজিৎ অবাক হয়ে শর্মিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, “হায় ভগবান! তুমি এসব কবে থেকে ভাবতে শুরু করে দিয়েছ?”
নিজের পছন্দের ব্যাপারে সত্যজিৎ খুবই জেদি ছিলেন। যেটা ভেবেছেন সেটাই করবেন, কেউ তাকে টলাতে পারতো না। সৌমিত্র এসে একদিন সত্যজিতকে বলেছিলেন, “নায়ক সিনেমাতে আমাকে নিলেন না কেন?” সত্যজিৎ তখন তার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “তুমি কি উত্তম?”
নায়ক চলচ্চিত্রটি শুটিং-এর প্রথম দিনে মেকাপ আর্টিস্ট অনন্ত দাসকে সত্যজিৎ বলেছিলেন, “উত্তম এলে বলো, ওর কোন মেকাপ হবে না। আমি কোন মেকাপ চাই না।” অনন্ত দাস চলে গেলেন। একটু পরে আমতা আমতা করে বললেন, “মানিকদা, উত্তমবাবু এসেছেন। আর এসেই উনি মেকাপ চেয়ারে বসে পড়েছেন।”
সত্যজিৎ- “তোমাকে না বললাম, উত্তমকে বলতে যে ওর কোন মেকাপ হবে না?”
অনন্ত- “মানিকদা, আমি বলতে ঠিক সাহস পাচ্ছি না। এটাও তো এমন একটা অভ্যাসের ব্যাপার…।”
সত্যজিৎ তখন নিজে মেকাপরুমে এসে বললেন, “উত্তম, তোমার কোন মেকাপ হবে না।”
উত্তম খুবই ধাক্কা খেয়েছিলেন এটা শুনে। মাত্র কিছুদিন আগেই জলবসন্ত থেকে উঠেছিলেন তিনি, মুখে কিছু দাগ থেকে গিয়েছিল। এই কারণে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন তিনি। সত্যজিৎ তখন বুঝিয়ে বললেন, “তোমার কোন চিন্তা নেই। ফ্ল্যাশব্যাক তো আছেই। তাতে একটু মেকাপ হবে। কিন্তু এমনিতে কোন মেকাপ দেব না। ঘাম বা গরমের প্রবলেম হলে জাস্ট প্যাড করে দেব। আর কিছু হবে না। তোমার যদি সমস্যা মনে হয়, আমি তোমাকে কিছু রাশ দেখাতে পারি। রাশ প্রিন্টে তোমার যদি নিজেকে খারাপ লাগে, তখন দেখি কি করতে পারি। তখন ভাবনা চিন্তা করব।” রাশ দেখে উত্তম প্রচণ্ড খুশি হয়েছিলেন।
কারিগরি দিক থেকে বিবেচনা করলে নায়ক চলচ্চিত্রশিল্পের একটি রত্ন । শিল্প নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত আলাদা করে ট্রেনের কামরা বানিয়েছিলেন এই সিনেমার জন্য। রেল ইয়ার্ডে গিয়ে তিনি দেখে এসেছিলেন, রেল প্রকৌশলীরা কীভাবে ট্রেনের কামরার বিভিন্ন অংশ তৈরি করেন। বাঙ্ক, দরজা, জানালার মাপ কত হয়, সেটা দেখেছিলেন। গোটা সেট বানাতে এক মাসেরও বেশি সময় লেগেছিল। চলন্ত ট্রেন বোঝানোর জন্য তিনি এমন একটি প্ল্যাটফর্মের উপরে সেটটি তৈরি করেছিলেন, যার নিচে বড় বড় স্প্রিং লাগানো ছিল। শট তোলার সময়, স্প্রিঙের প্ল্যাটফর্মকে দোলানো হত, ফলে চলন্ত ট্রেনের দুলুনি দেখা যেত অভিনেতাদের শরীরে।
একটি দৃশ্যে পকেট থেকে কলম বের করে স্বাক্ষর করবেন উত্তম। কলমের কালি শেষ হয়ে গিয়েছিল। সত্যজিৎ কাট বলতে যাবেন, তখনই হালকা ঝাঁকি দিয়ে আবার সই করার চেষ্টা করলেন উত্তম। তাতেও কাজ না হওয়াও সামনে থাকা গ্লাসের জলে কলম চুবিয়ে স্বাক্ষর করলেন। প্রচণ্ড খুশি হয়েছিলেন সত্যজিৎ এই দৃশ্য দেখে। [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
কলাকুশলী
সম্পাদনা- উত্তম কুমার –অরিন্দম মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা
- শর্মিলা ঠাকুর – অদিতি সেনগুপ্ত, সাংবাদিক
- বীরেশ্বর সেন – মুকুন্দ লাহিড়ী, প্রবীণ অভিনেতা
- সোমেন বসু – শঙ্করদা, অরিন্দমের পাড়ার নাটকের ব্যবস্থাপক
- নির্মল ঘোষ – জ্যোতি, অরিন্দমের ম্যানেজার
- প্রেমাংশু বসু – বীরেশ, বামপন্থী শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা
- সুমিতা সান্যাল – প্রমীলা চট্টোপাধ্যায়, অরিন্দমের সহ-অভিনেত্রী
- রঞ্জিত সেন – হরেন বসু
- ভারতী দেবী – মনোরমা, হরেন বসুর স্ত্রী
- লালী চৌধুরী – বুলবুল, হরেন বসুর কন্যা
- কামু মুখোপাধ্যায় – প্রীতিশ সরকার, বিজ্ঞাপন এজেন্ট
- সুস্মিতা মুখোপাধ্যায় – মলি, প্রীতিশ সরকারের স্ত্রী
- সুব্রত সেনশর্মা – অজয়, অদিতির সহযাত্রী
- যমুনা সিনহা – শেফালিকা, অজয়ের স্ত্রী
- সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় – ডব্লিউডব্লিউডব্লিউডব্লিউ সংগঠনের সন্ন্যাসী
সাউন্ডট্র্যাক
সম্পাদনানায়ক | |
---|---|
কর্তৃক সাউন্ডট্র্যাক অ্যালবাম |
সকল গানের গীতিকার সত্যজিৎ রায়; সকল গানের সুরকার সত্যজিৎ রায়।
গান | |||
---|---|---|---|
নং. | শিরোনাম | প্লেব্যাক | দৈর্ঘ্য |
১. | "অরিন্দম থিম" | যন্ত্রসংগীত | ১:৫২ |
প্রযোজনা
সম্পাদনাচলচ্চিত্র নির্মাণের অবসরে মে মাসে দার্জিলিং শহরে বসে সত্যজিৎ নায়ক ছবিটির চিত্রনাট্য রচনা করেন। প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের জন্য উত্তম কুমারকে নেওয়ার কথা মাথায় রেখেই তিনি চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন। কিন্তু এই ছবিতে তিনি তাকে শুধুমাত্র একজন অভিনেতা হিসেবে গ্রহণ করতে চাননি, বরং এক "বাহ্যমূর্তি" হিসেবে গ্রহণ করেন।[৩]
পুরস্কার
সম্পাদনা- শ্রেষ্ঠ বাংলা কাহিনীচিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৯৬৭
- শ্রেষ্ঠ অ-ইউরোপীয় চলচ্চিত্র বিভাগে বোডিল পুরস্কার, ১৯৬৭
- বিশেষ জুরি পুরস্কার, বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, ১৯৬৬[৪]
- সমালোচকদের পুরস্কার (ইউএনআইসিআরআইটি পুরস্কার), বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, ১৯৬৬
- বি.এফ.জে.এ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরস্কার: উত্তম কুমার
- বি.এফ.জে.এ শ্রেষ্ঠ পরিচালক পুরস্কার: সত্যজিৎ রায়
মনোনয়ন
সম্পাদনা- শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে গোল্ডেন বিয়ার, বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, ১৯৬৬
সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার
সম্পাদনা২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে সত্যজিৎ রায়ের যে চারটি ছবিকে পুনরায় প্রকাশের জন্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে পুনরুদ্ধার করা হয়, তার মধ্যে নায়ক ছবিটি ছিল অন্যতম।[১]
২০০৭ সালে অ্যাকাডেমি ফিল্ম আর্কাইভ নায়ক ছবিটিকে সংরক্ষণ করে।[৫]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ "Second look: Satyajit Ray's 'Nayak' revisited"। মিন্ট। ৩ ডিসেম্বর ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ৬ ডিসেম্বর ২০১৩।
- ↑ ক খ দারিউস কুপার (১৩ জানুয়ারি ২০০০)। The Cinema of Satyajit Ray: Between Tradition and Modernity। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। পৃষ্ঠা 102–। আইএসবিএন 978-0-521-62980-5।
- ↑ Andrew Robinson (১৯৮৯)। Satyajit Ray: The Inner Eye। University of California Press। পৃষ্ঠা 177–। আইএসবিএন 978-0-520-06946-6।
- ↑ "Berlinale 1966: Prize Winners"। berlinale.de। ২০১১-০৪-০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০২-২৪।
- ↑ "Preserved Projects"। Academy Film Archive।