নাক
শারীরস্থানে, নাক (Nose)হল মেরুদণ্ডীর মুখের সামনে থাকা একপ্রকার স্ফীত সংবেদক অঙ্গ। নাকের নাসারন্ধ্র দিয়ে শ্বাসক্রিয়ার বায়ু প্রবেশ ও প্রস্থান করে। নাকের পিছনে অলফ্যাক্টরি মিউকোসা ও সাইনাস থাকে। নাসিকাগহ্বরের পিছন থেকে, বায়ু ফ্যারিংক্সের মধ্য দিয়ে গিয়ে পরিপাক তন্ত্রে বিভাজিত হয়, এবং তারপর শ্বসনতন্ত্রের বাকী অংশে প্রবেশ করে। মানুষের ক্ষেত্রে, নাকটি মুখের ওপর কেন্দ্রীয়ভাবে অবস্থিত এবং বিশেষত দুগ্ধপোষ্য শিশুদের জন্য একটি বিকল্প শ্বসনপথ পরিবেশন করে। অধিকাংশ অন্য স্তন্যপায়ীর ক্ষেত্রে, এটি তুণ্ডের ঊর্ধ্বপ্রান্তের ওপরে অবস্থিত।
নাক | |
---|---|
বিস্তারিত | |
শনাক্তকারী | |
লাতিন | নেসাস (Nasus) |
মে-এসএইচ | D009666 |
টিএ৯৮ | A06.1.01.001 A01.1.00.009 |
টিএ২ | 117 |
শারীরস্থান পরিভাষা |
বায়ু সরবরাহ
সম্পাদনানাক হল শ্বাসতন্ত্রের প্রথম অংশ। এটি বায়ুর থেকে অক্সিজেন গ্রহণ ও দেহ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিষ্কাশনের পথ হিসাবে কাজ করে। বাহ্যিক পরিবেশ ও প্রাণীর দেহের আভ্যন্তরীণ ফুসফুসের মধ্যে প্রাথমিক সমন্বয় রক্ষাকারী হিসাবে নাক শ্বসনের সময় প্রবিষ্ট বায়ুর আনুকূলিক কাজ যেমন: তাপীয় নিয়ন্ত্রণ ও পরিস্রাবণ ঘটায়, এবং ঘ্রাণের সংবেদী উপলব্ধিকে জাগ্রত করে।
যেকোনো অবাঞ্ছিত কণা শ্বসনতন্ত্রে প্রবেশে বাধা দেওয়ার জন্য নাসারন্ধ্রের ভিতরদিকে অসংখ্য লোম থাকে। এগুলি সুরক্ষার প্রাথমিক স্তর হিসাবে আগত বায়ু থেকে ধূলিকণা, ধোঁয়া ও অন্যান্য স্থৈতিক প্রতিকূলতা যা শ্বসন প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করতে পারে, তাদেরকে বাধাপ্রদান করে এবং বায়ুবাহিত অসুস্থতার বিরুদ্ধে একধরনের পরিস্রাবকের কাজ করে। পরিস্রাবকের কাজ করার সাথে আনুসঙ্গিকভাবে, নাকের ভিতরে উৎপন্ন শ্লেষ্মা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে শরীরের প্রচেষ্টাকে সম্পূরণ করে এবং শ্বসনতন্ত্রের সংবদ্ধ অংশসমূহকে আর্দ্র করতে অবদান রাখে। নাকের কৈশিক গঠন শরীরে প্রবিষ্ট বায়ুকে উষ্ণ ও আর্দ্র রাখে; পরে, আর্দ্রতা বজায় রাখতে এই ভূমিকা ফুসফুসের মধ্যে অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের যথাযথ বিনিময় (অর্থাৎ, শ্বসন) করতে অ্যালভিওলির আনুকূলিক অবস্থা জাগ্রত করে। নিশ্বাস ছাড়ার সময়, লোমগুচ্ছ কিছু আর্দ্রতার পুনরুদ্ধারে, বিশেষত তাপীয় নিয়ন্ত্রণের একটি কাজ হিসাবে পুনরায় সহযোগিতা করে।
দিক নির্ণয়
সম্পাদনাকুকুরের সিক্ত নাসিকা দিক নির্ণয়ের জন্যও উপযোগী। চামড়ায় থাকা শীতল সংবেদনশীল সংগ্রাহক ঠিক কোন্ জায়গায় নাকটি সর্বাধিক শীতলতা প্রাপ্ত হচ্ছে, সেটি নির্ণয় করতে পারে এবং এইভাবে কোনো নির্দিষ্ট একটি গন্ধ কোন্ দিক থেকে আসছে, তা প্রাণীটি সেই মুহূর্তে খুঁজে নেয়।[১]
বায়ু-শ্বসনের অংশসমূহের গঠন
সম্পাদনাউভচর এবং লাংফিসের ক্ষেত্রে, নাসারন্ধ্র ছোট থলিসমূহের মধ্যে উন্মুক্ত হয় - যা ঘোরানোর সময় - কোয়ানার মধ্য দিয়ে মুখের সামনের তলে উন্মুক্ত হয়। এই থলিগুলি খুবই কম পরিমাণে অলফ্যাক্টরি এপিথেলিয়াম ধারণ করে, যা সিলিয়ানদের ক্ষেত্রে, আশেপাশের কিছু সংখ্যক কর্ষিকা নিয়ে সারি গঠন করে। ঐ উভচর প্রাণীদের কাঠামোয় সাধারণ সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও, লাংফিসের নাসারন্ধ্র শ্বসনকার্যে ব্যবহৃত হয় না, যেহেতু এইসব প্রাণী তাদের মুখের মাধ্যমে শ্বাসগ্রহণ করে। উভচরদের অলফ্যাক্টরি এপিথেলিয়াম দ্বারা রেখাযুক্ত একটি নিক্ষেপনাসা অঙ্গও থাকে; কিন্তু ঐ অ্যামনিয়োটদের থেকে ব্যতিক্রমীভাবে স্যালামান্ডারদের মধ্যে এটি সাধারণত একটি সরল কোষ যার সাথে নাসিকাতন্ত্রের বাকি অংশের সামান্যই সংযোগ রয়েছে।[২]
সরীসৃপদের ক্ষেত্রে, মুখের তলের ভিতরের বেশ কিছুটা পিছনে অবস্থিত কোয়ানার সঙ্গে নাসিকাগহ্বরটি সাধারণত বড়। কুমিরদের ক্ষেত্রে, পশুটিকে আংশিকভাবে নিমজ্জিত অবস্থায় শ্বাসগ্রহণ করতে সাহায্য করার জন্য গহ্বরটি অস্বাভাবিক দীর্ঘ হয়। সরীসৃপদের নাসিকাগহ্বর তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়: একটি সম্মুখস্থ ভেস্টিবিউল, প্রধান অলফ্যাক্টরি গহ্বর, এবং একটি পিছনের নাসা-গলবিল। অলফ্যাক্টরি গহ্বরটি এর ঊর্ধ্বপৃষ্ঠের উপর অলফ্যাক্টরি এপিথেলিয়াম দ্বারা রেখাযুক্ত এবং সংজ্ঞাবহ এলাকা বৃদ্ধি করতে কিছু সংখ্যক ঘূর্ণনযন্ত্র পোষণ করে। টিকটিকি এবং সাপদের ক্ষেত্রে, নিক্ষেপনাসা অঙ্গটি এতটাই সুগঠিত যে, এটি নাসিকাগহ্বরের সঙ্গে কোনোরকম সংযোগ না রেখে সরাসরি মুখের তলের ভিতরে উন্মুক্ত হয়। কচ্ছপের ক্ষেত্রে এটি ছোট এবং এর মূল নাসা-সংযোগ অপরিবর্তিত; প্রাপ্তবয়স্ক কুমিরদের ক্ষেত্রে এটি অনুপস্থিত।[২]
পাখিদেরও সরীসৃপদের অনুরূপ ঠোঁটের উপরের পিছন-অংশে অবস্থিত নাসারন্ধ্রযুক্ত একটি নাক আছে। সাধারণত অত্যল্প ঘ্রাণক্ষমতাযুক্ত হওয়ায় এদের অলফ্যাক্টরি গহ্বরটি ছোট, যদিও এটা তিনটি ঘূর্ণনযন্ত্র ধারণ করে, বরং কখনো কখনো স্তন্যপায়ীদের যেমন একটি জটিল কাঠামো আছে তার অনুরূপ। ঘুঘু ও জংলি পাখিসহ অনেক পাখির ক্ষেত্রে, নাসারন্ধ্র একটি শৃঙ্গাকার প্রতিরক্ষামূলক ঢাল দ্বারা আচ্ছাদিত। পাখিদের নিক্ষেপনাসা অঙ্গটি হয় অনুন্নত নতুবা পুরোপুরি অনুপস্থিত, যা প্রজাতির উপর নির্ভর করে। [২]
স্তন্যপায়ীদের উভয় নাসাগহ্বরই একটির মধ্যে সংযোজিত হয়। অধিকাংশ প্রজাতির মধ্যে তারা অত্যন্ত বড় হয়, সাধারণত মাথার খুলির অর্ধেক দৈর্ঘ্য পর্যন্ত অধিষ্ঠিত। যাইহোক, প্রাইমেট, বাদুড়, এবং সিটেসিয়ান সহ কিছু দলের ক্ষেত্রে, নাকটি গৌণভাবে হ্রস্ব হয়েছে, এবং এর পরিণামে এইসব প্রাণীর ঘ্রাণক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কমে গেছে। স্তন্যপায়ীদের নাসাগহ্বরটি মূল মুখগহ্বরের সমগ্র ঊর্ধ্বপৃষ্ঠ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি তালুর বিকাশের দ্বারা অংশত বিস্ফারিত হয়েছে, যা তালুটিকে মুখের একটি তল হিসাবে পরিত্যাগ করে ফলত নাকের একটি অংশ হয়ে উঠেছে। বিস্ফারিত নাসাগহ্বরটি কুণ্ডলিত স্ক্রোল-সদৃশ আকৃতি গঠনকারী জটিল ঘূর্ণনযন্ত্র ধারণ করে, যা বাতাসকে ফুসফুসে পৌঁছাবার আগে গরম করতে সাহায্য করে। গহ্বরটি প্রতিবাসী করোটির হাড়েও প্রসারিত, যা আনুসঙ্গিক বায়ুগহ্বর (প্যারানাজাল সাইনাস নামে পরিচিত) গঠন করে।[২]
সিটেসিয়ানদের ক্ষেত্রে, নাকটি নাসারন্ধ্র পর্যন্ত হ্রস্ব হয়েছে, যা অধিকাংশিক নিমজ্জনের সময় শ্বাসগ্রহণের ক্ষমতা এবং আরও একটি প্রবাহীরেখাযুক্ত দেহাকৃতি উৎপাদন ঘটিয়ে মাথার শীর্ষ পর্যন্ত চলে এসেছে। বিপরীতভাবে, হাতির নাক একটি দীর্ঘ, পেশীবহুল, ব্যবহারোপযোগী অঙ্গে সম্প্রসারিত হয়েছে, যাকে শুঁড় বলা হয়।
স্তন্যপায়ীদের নিক্ষেপনাসা অঙ্গটি সাধারণত সরীসৃপের অঙ্গের অনুরূপ। অধিকাংশ প্রজাতির ক্ষেত্রে, এটা নাসাগহ্বরের তলের মধ্যে অবস্থিত, এবং দুটি নাসাতালব্য নালি দিয়ে তালুর মাধ্যমে ধাবিত হয়ে মুখের মধ্যে উন্মুক্ত হয়, কিন্তু এটা অনেক তীক্ষ্ণদন্ত প্রাণীর নাকে সরাসরি উন্মুক্ত হয়। অবশ্য, এটি মানুষ সহ অনেক স্তন্যপায়ী এবং বাদুড় মধ্যে হারিয়ে গেছে। [২]
মাছের ক্ষেত্রে
সম্পাদনামাছের ঘ্রাণক্ষমতা সাধারণত দুর্বল, যা জলজ পরিবেশে স্বাদের চেয়ে সাধারণত কম গুরুত্বপূর্ণ। তবুও, ঘ্রাণের জন্য তাদের একটি নাক থাকে; যদিও, চতুষ্পদীদের সাথে বিসদৃশভাবে, এটির মুখের সাথে কোন সংযোগ, কিংবা শ্বসনকার্যে কোনো ভূমিকা নেই। পরিবর্তে, এটি সাধারণত মাথার সামনে বা দুপাশে নাসারন্ধ্রের পিছনে অবস্থিত একজোড়া থলি দিয়ে গঠিত। অনেক ক্ষেত্রে, নাসারন্ধ্রদ্বয়ের প্রতিটি একপাশ দিয়ে জল প্রবাহিত হতে এবং অন্যপাশ দিয়ে জল বের হতে দেওয়ার জন্য চামড়ার একটি ভাঁজ দ্বারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়।[২]
থলিগুলি অলফ্যাক্টরি এপিথেলিয়াম দ্বারা রেখাযুক্ত হয়, এবং সাধারণত পৃষ্ঠতল বৃদ্ধি করতে একটি অভ্যন্তরীণ ভাঁজের শ্রেণীকে অন্তর্ভুক্ত করে। কিছু টিলিয়স্ট জাতীয় মাছের ক্ষেত্রে, থলিগুলি অতিরিক্ত সাইনাস-সদৃশ গহ্বরের মধ্যে শাখাবিভক্ত হয়, যেখানে কোয়েলাকান্থদের ক্ষেত্রে, তারা নালিকার একটি শ্রেণী গঠন করে। চতুষ্পদীদের সাথে বিসদৃশভাবে, মাছের নাকের এপিথেলিয়ামটি যেহেতু স্বাভাবিকভাবেই আর্দ্র হয়, তাই কোনো শ্লেষ্মা-ক্ষরণকারী কোষকে অন্তর্ভুক্ত করে না।[২]
বেশিরভাগ আদিম বসবাসকারী মেরুদন্ডী ল্যামপ্রে এবং হাগফিস-এর ক্ষেত্রে, মাত্র একটি নাসারন্ধ্র এবং অলফ্যাক্টরি থলি থাকে। প্রকৃতপক্ষে, নাসারন্ধ্রটি হাইপোফাইসিসে উন্মুক্ত হয়। প্রয়োজনীয়তা না থাকা সত্ত্বেও, এই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বিবর্তনে একটি আদিম বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরবর্তীতে উদিত হয়ে থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, জীবাশ্ম হেটেরোস্ট্রেকানদের নাসারন্ধ্রগুলি জোটবদ্ধ ছিল, এবং এরা অতি প্রাচীন একটি মেরুদন্ডী গোষ্ঠী ছিল।[২]
আরও দেখুন
সম্পাদনা- মানুষের নাক
- নাসাসেতু
- রাইনেরিয়াম, অধিকাংশ স্তন্যপায়ীদের নাসারন্ধ্রের আশেপাশের ভিজে, নগ্ন পৃষ্ঠতল, হ্যাপ্লোরাইন প্রাইমেট যেমন: মানুষের মধ্যে অনুপস্থিত
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Dijkgraaf S.;Vergelijkende dierfysiologie;Bohn, Scheltema en Holkema, 1978, আইএসবিএন ৯০-৩১৩-০৩২২-৪
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ Romer, Alfred Sherwood; Parsons, Thomas S. (১৯৭৭)। The Vertebrate Body। Philadelphia, PA: Holt-Saunders International। পৃষ্ঠা 453–458। আইএসবিএন 0-03-910284-X।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- উইকিমিডিয়া কমন্সে নাক সম্পর্কিত মিডিয়া দেখুন।