ত্রিদেবী
ত্রিদেবী (সংস্কৃত: त्रिदेवी) হল হিন্দুধর্মের ত্রিমূর্তির নারী অবতারস্বরূপ তিনজন প্রভাবশালী দেবীর একটি জোড়। এঁদের ত্রিমূর্তির পত্নীত্রয়ও বলা যায়। এই তিনজনের দলে রয়েছেন হিন্দু দেবী সরস্বতী, লক্ষ্মী ও পার্বতী। শাক্তধর্ম অনুযায়ী, এই ত্রিমূর্তি সর্বোচ্চ দেবী। [১]
ত্রিদেবী | |
---|---|
সৃষ্টি, পালন, ধ্বংস | |
দেবনাগরী | त्रिदेवी |
অন্তর্ভুক্তি | দেবী |
সঙ্গী | ত্রিমূর্তি |
ত্রিমূর্তির নারী অবতার
সম্পাদনাপুরুষতান্ত্রিক হিন্দুধর্ম ত্রিদেবীকে প্রধান দেবত্রয় "ত্রিমূর্তি"র তিনজন পত্নী এবং অপ্রধান দেবী হিসেবে গণ্য করে। কিন্তু হিন্দুধর্মের নারীবাদী শাখা শাক্তধর্মে সৃষ্টিকর্তা (সরস্বতী), পালনকর্তা (লক্ষ্মী) ও সংহারকর্তা (মহাকালী) ― এঁরা তিনজন প্রধান দেবী রূপেই বিবেচিতা হন, আর এঁদের তিন স্বামী হলেন ত্রিমূর্তিরূপী প্রধান দেবতা।
ত্রিমূর্তির পত্নীত্রয়
সম্পাদনাসৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার স্ত্রী সরস্বতী হলেন বিদ্যা, শিল্প ও কৃষ্টি-সংস্কৃতির দেবী। তিনি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জ্ঞান, বুদ্ধি ও চেতনার আধার। শ্রীকৃষ্ণের জিহ্বাগ্র হতে দেবী সরস্বতীর জন্ম। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়।
পালনকর্তা বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী ধন, সমৃদ্ধি ও কামনা-বাসনার দেবী। যদিও, লক্ষ্মী বস্তুগত সম্পদের দেবী রূপে ততোধিক বিবেচিত হন না, বরং তাকে শ্রী, উৎকর্ষ, সৌভাগ্য, সুখ ও মহত্বের দেবী রূপেই পূজা করা হয়। দেবী লক্ষ্মী মহর্ষি ভৃগু ও খ্যাতির কন্যা। তিনি শ্রী, কমলা, লক্ষ্মী, পদ্মা আদি নামে অভিহিত। তিনি বিষ্ণুবক্ষস্থিতা মহালক্ষ্মী। দুর্বাসা মুনির অভিশাপে শ্রীভ্রষ্ট ইন্দ্রাদি দেবগণ সমুদ্র মন্থনের মাধ্যমে দেবী লক্ষ্মীকে পুনরুদ্ধার করেন। দেবী লক্ষ্মী সত্যযুগে নারায়ণের সঙ্গে লক্ষ্মী, ত্রেতাযুগে রামের সঙ্গে সীতা, দ্বাপর যুগে কৃষ্ণের সঙ্গে রাধারুপে ও রুক্মিণী রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কলিযুগে তিনি কল্কি অবতারের পত্নী, বৃহদ্রথ রাজার কন্যা পদ্মারূপে জন্ম নেবেন।
সংহারক শিবের পত্নী পার্বতী শক্তি, প্রেম,অসুর বিজয়,প্রলয় ও অধ্যাত্মের দেবী। তাকে তার বিনাশস্বরূপিণী রুদ্রমূর্তি কালী,তারা,চন্ডী,দুর্গা রূপেও দেখা যায়। পার্বতী আবার"আদ্যাশক্তি"। দেবী পার্বতী পর্বতরাজ হিমবান ও সুমেরুদুহিতা মেনার কন্যা। তার অন্য নাম উমা ও অপর্ণা। তবে পূর্বজন্মে তিনি দক্ষরাজকন্যা সতী ছিলেন। তারও পূর্বে তিনি ছিলেন বিষ্ণুর যোগনিদ্রা তার পূর্বেও তিনিই ছিলেন জগৎ সৃষ্টির মূল কারণ তিনি ত্রিদেব ও লক্ষী ,সরস্বতীর সৃষ্টি করেছিলেন ও পরে দক্ষ রাজের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তার কন্যা রূপে আবির্ভূত হন পরে দক্ষ অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি শিব কে বিবাহ করেন ও পরে পতিনিন্দা সহ্য করতে না পেরে তিনি দেহত্যাগ করেন। পরজন্মে তিনি পুনরায় শিবের স্ত্রী হন। দেবী পার্বতীর দুই পুত্র ; কার্তিকেয় ও গজানন এবং কন্যা অশোকসুন্দরী।
শিব ও শক্তি
সম্পাদনাশৈবধর্মের প্রধান দেবতা শিবের অর্ধাঙ্গিনীকে শক্তি বলা হয়। শক্তি বা পার্বতী হলেন হিন্দু দেবতাগণের শক্তিদায়িনী। সগুণ রূপে, শক্তি ছাড়া শিবের কোনো অস্তিত্ব নেই, আবার শিব ছাড়া শক্তির কোনো অস্তিত্ব নেই। নির্গুণ রূপে, শক্তি একক, তাকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না।
শিব হলেন আধ্যাত্মিক চেতনার স্থাণু, স্থির ও মহৎ আধার। অন্যদিকে, শক্তি হলেন সেই চেতনার গতিময় স্বরূপ। শক্তি শিবের পত্নী তথা তার সামর্থ্যের চিহ্ন।
হিন্দুধর্মে শিব ও শক্তির কোনো পার্থক্য নেই। শিব ও পার্বতী পরস্পরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। খ্রিস্ট ধর্মের হাইপোস্ট্যাটিক ইউনিয়ন তত্ত্বের সাথে এর গভীর মিল আছে, যেখানে বলা হয়েছে, খ্রিস্টের মনুষ্যত্ব ও দেবত্ব এক ও অবিচ্ছেদ্য। শিব হলেন পরমেশ্বর, যার সেই ঐশ্বরিক রূপ শক্তিরই দান। পার্বতী কে তার বিভিন্ন রূপে পুজো করা শিবের পুজো করারই সমান, আবার শিবের পূজা ও শক্তির পূজা অভিন্ন।
আদ্যাশক্তি হলেন পরম ব্রহ্ম
আর ব্রহ্ম যে কি তা মুখে বলে বোঝানো যায়। হৃদয় দিয়ে উপলব্দি করতে হয়।
শক্তির সাকার রুপই আদ্যাশক্তি মহামায়া।হরের
এই ব্রহ্মান্ড মায়াদ্বারা আচ্ছাদিত, তাই আমরা সবাই মায়াবদ্ধ জীব। আদ্যাশক্তি মহামায়া জীবের সৎ কর্মে প্রসন্ন হয়ে ব্রহ্ম চৈতন্য দান করেন। তখন জীব চৈতন্য শক্তি ফিরে পেয়ে নিজেকে ব্রহ্মের স্বরুপ দর্শন করে। নিজে পরম ব্রহ্মের সাথে লীন হয়ে স্বয়ং ব্রহ্ম হয়ে যান।
ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির একটি গল্প
এক ঋষি মহাদেবকে প্রশ্ন করেছিলেন। হে মহাদেব আপনার পিতা কে? মহাদেব বললেন আমার পিতা স্বয়ং ব্রহ্মা।
ঋষি আবার প্রশ্ন করলেন। তাহলে আপনার পিতামহ কে? মহাদেব বললেন বিষ্ণুদেব আমার পিতামহ।
ঋষি আবারও প্রশ্ন করলেন। আপনার পিতা স্বয়ং ব্রহ্ম, বিষ্ণুদেব আপনার পিতামহ, তাহলে আপনার প্রোপিতামহ কে? মহাদেব একটু হেঁসে উওর দিলেন আমিই আমার প্রোপিতামহ।
এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, শিবের এই লীলার শুরু নেই শেষও নেই। আবার বলা যায় যেখানে শুরু সেখানেই শেষ।
মহাদেব পরম ব্রহ্মের আধার, আদ্যাশক্তি মহামায়া পরম ব্রহ্মের মহাশক্তি বা চৈতন্য। মহাদেব আদ্যাশক্তি একই মহাশক্তির চেতনা।
আর এই চেতনার প্রধান চৈতন্য হলেন বিষ্ণুদেব, বিষ্ণুদেবের শক্তি হলেন মাতা লক্ষী।
জগৎ তের প্রান সঞ্চারের জন্য আবির্ভূত ব্রহ্মা।ব্রহ্মার শক্তি হলেন মাতা সরস্বতী।
ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব হচ্ছেন ত্রিমূর্তি।
ব্রহ্ম নিরলিপ্ত কিন্তু যখন চৈতন্য শক্তিতে রুপান্তর হয় তখন চক্র আকার ধারণ করে। যার কোন শুরু বা শেষ নেই।
উদাহারন সময় দিয়ে উদাহারন দেওয়া যাক, ঘরির গোলাকার আকৃতি একটি চক্র, এই চক্রের যেখান থেকে সময় শুরু হয় শেষ হয়। যেখান শেষ হয় আবার শুরু হয়। কালচক্র ঠিক এমন যা ব্রহ্মের মধ্যে লীন থাকে।
ত্রিদেবীর মাহাত্ম্য
সম্পাদনাশক্তি বা বিমর্ষ পরম চেতনায় সমাহিত, তিনিই সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংসের প্রয়োজনীয় রসদ। তাকে ছাড়া পরম চেতনায় উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। যেইরকম শক্তিকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না, শুধু এক শক্তি থেকে অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হয় মাত্র, তেমনি আদি পরাশক্তি বিভিন্ন কার্য সম্পন্ন করতে নিজের রূপের বারংবার পরিবর্তন ঘটান। ভগবান পুরুষ ও নারী ― দুই রূপেই উপস্থিত। কিন্তু শক্তির সমস্ত স্বরূপই ত্রিদেবীর মহালক্ষ্মী, মহাসরস্বতী ও মহাকালী রূপে প্রকাশিত। অর্থাৎ, নিরাকার ঈশ্বর সৃষ্টিশক্তির মাধ্যমে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন (সরস্বতী বা শ্রুতি বা বিদ্যা), স্থিতিশক্তির মাধ্যমে সেই জগতের সংরক্ষণ করেন (লক্ষ্মী বা আলোক বা সম্পদ) এবং সংহারশক্তির মাধ্যমে ধ্বংস করেন (মহাকালী বা তাপ বা সামর্থ্য, ধংস)। দেখা যায়, দেবতারা সৃষ্টি, পালন কিংবা ধ্বংস করতে পারেন না, কারণ তাদের সেই গুণ নেই। তাই আদ্যাশক্তি গৌরী পার্বতী অসুর বিজয়ে তাদের রক্ষা করেন। পরব্রহ্ম নিজে তিনটি ভাগে বিভক্ত হন ও তিনটি কুষ্মাণ্ড তৈরি করেন। প্রথম অণ্ড প্রস্ফুটিত হয়ে প্রথম পুরুষ নারায়ণ এর উৎপত্তি হয় আর এই ব্রহ্ম ছিলেন নারায়ণী (ইনি লক্ষ্মী নন, এখানে নারায়ণী হলেন বিষ্ণুর বোন পার্বতী পুরান অনুসারে নারায়ণী শব্দের অর্থ বিষ্ণুর বোন) জন্ম হয়। নারায়ণীকে গৌরী(পার্বতী) দেবীও বলা হয় অন্যান্য দেবীর তার অংশ তিনি শিবের জায়া। এই সময় তিনি সাকার স্বরূপে ছিলেন না। ব্রহ্মা আদ্যাশক্তির পূজা করলে, দেবী বিষ্ণুর নেত্র থেকে সাকার স্বরূপে আবির্ভূত হন। দ্বিতীয় অণ্ড থেকে সংহারক শিব ও চতুর্থ মুখ থেকে জন্ম নেয় বিদ্যার দেবী সরস্বতী। অণ্ড থেকে শিবের জন্ম হয় প্রধান পুরুষ রূপে, এবং সরস্বতীর জন্ম হয় নিরাকার স্বরূপে, যিনি পরে চারটি বেদের জন্ম দেন। বসন্ত পঞ্চমী তিথিতে ব্রহ্মা পরম জ্ঞানকে আহ্বান করেন, তখন সরস্বতী সাকার স্বরূপে প্রকট হন ও ব্রহ্মা কে বিবাহ করেন। তৃতীয় অণ্ড থেকে ব্রহ্মা ও শিবের তৃতীয় মুখ থেকে লক্ষ্মীর জন্ম হয়। ব্রহ্মা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির দায়িত্ব নেন এবং লক্ষ্মী তার রসদ জোগান দেওয়ার ভার নেন।
- নারায়ণ (প্রথম পুরুষ বা ব্রহ্মের আদি স্বরূপ) এবং পার্বতী (আদ্যাশক্তি শক্তি )।
- শিব (প্রধান পুরুষ বা ব্রহ্মের মহাস্বরূপ) ও সরস্বতী ( জ্ঞান স্বরূপ)।
- ব্রহ্মা (পরম পিতামহ) ও লক্ষ্মী ( শ্রীস্বরূপ)।
যেহেতু বিষ্ণু বিশ্বের পালন করেন, তাই তার প্রচুর রসদের দরকার হয়, তাই তার লক্ষ্মীকে প্রয়োজন। তেমনিই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টিতে ব্রহ্মার দরকার হয় জ্ঞানের, যা সরস্বতী দান করেন। মৃত্যু ও সংহারকে ডেকে আনতে শংকরের প্রয়োজন হয় ক্ষমতার, যা তিনি পান তার স্ত্রী মহামায়া পার্বতীর কাছ থেকে।
ভারতের বাইরে ত্রিদেবী
সম্পাদনাজাপানি শিন্তো দেবদেবীর সাথে বৌদ্ধধর্ম ও শিনবুৎসু ধর্মের মিলনে জাপানি পুরাণে ত্রিদেবীর প্রবেশ ঘটে বেনজ়াইতেন 弁財天女 (সরস্বতী), কিশ্শৌতেন 吉祥天女 (লক্ষ্মী) ও দাইকোকুতেন 大黒天女 (মহাকালী) দেবী রূপে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "Navaratri", in Hinduism Today ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে magazine, October/November/December 2008.
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনামুম্বইয়ের মহালক্ষ্মী মন্দিরে ত্রিদেবীর মূর্তি ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে