তিপ্রা রাজ্য
তিপ্রা রাজ্য (সংস্কৃত: ত্রিপুরা, ইংরেজিকৃত: টিপেরা) উত্তর-পূর্ব ভারত অঞ্চলে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম ঐতিহাসিক রাজ্যগুলোর অন্যতম একটি রাজ্য ছিলো।
ভূগোল
সম্পাদনাত্রিপুরা রাজ্যে যেসব বর্তমান রাজনৈতিক এলাকাগুলো ছিল:
- ভারতের বর্তমান আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকা (কাছাড় সমভূমি)[১]
- ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য
তিপ্রা রাজ্য বিভিন্ন যুগে সীমানা এসব অঞ্চলগুলো পর্যন্ত গঠিত ছিলো:
- উত্তরে খাসি পাহাড়
- উত্তর-পূর্বে মণিপুর পাহাড়
- পূর্বে আরাকান পাহাড়
- দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর
- পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র নদী
কিংবদন্তি
সম্পাদনাকিংবদন্তি ত্রিপুরার রাজাদের একট তালিকা প্রথম ধর্ম মাণিক্যের (শা. ১৪৩১) দরবারের পণ্ডিত রচিত ১৫শ শতাব্দীর বাংলা ভাষায় লেখা কালপঞ্জি রাজমালায় দেওয়া আছে। কালপঞ্জি রাজাদের পূর্বপুরুষদের শিকড় পৌরাণিক চন্দ্রবংশী পর্যন্ত প্রদর্শন করে। ৮ম শতাব্দীতে রাজ্যের রাজধানী পূর্বদিকে উত্তর ত্রিপুরার কৈলাসহরের নিকটে সিলেটের সুরমার দিকে স্থানান্তর করা হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
তিপ্রার ধর্মে চতুর্দশ দেবতা নামক ১৪টি ঈশ্বর রয়েছে এবং তাদের মূর্তি আগরতলার চতুর্দশ মন্দিরে এখনো সংরক্ষণ করা হচ্ছে। মন্দিরটি খান্তাই নামক ত্রিপুরার পুরোহিতেরা রক্ষণাবেক্ষণ করেন যারা ঐতিহ্য অনুযায়ী খার্চি ও কের নামক উৎসবগুলোর তদারকি করে থাকেন।
ইতিহাস
সম্পাদনাচৈনিক কালপঞ্জি
সম্পাদনাতিপ্রার নাম মিং শিলুতে দি-য়ু-লা নামে উল্লেখ রয়েছে। ১৫শ শতাব্দীর প্রথম দিকে এই জায়গাটি দা গু-লা নামক একটি অসনাক্তকৃত রাজ্য দখল করে নেয়।[২]
মুসলিম আক্রমণ যুগ
সম্পাদনাতিপ্রা রাজ্য সম্পর্কিত প্রারম্ভিক ঐতিহাসিক নথিপত্র ১৫শ শতাব্দীতে পাওয়া যায় যখন ত্রিপুরা প্রথম মুসলিম আক্রমণের চাপে পড়ে। এটা এছাড়া ছিলো মাণিক্য রাজবংশের সূচনালগ্ন, যখন চেংথুং ফা মাণিক্য উপাধি গ্রহণ করে মহা মাণিক্য হয়, এই উপাধি তারপর থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্যের মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো।[৩] প্রথম রত্ন মাণিক্যের সময় রাজ্যের রাজধানী গোমতী নদীর তীরে রাঙামাটিতে স্থানান্তর করা হয় যা বর্তমানে দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলায় অবস্থিত।
ত্রিপুরা ছিলো সেসব রাজ্যদের মধ্যে অন্যতম যারা সাফল্যের সাথে তুর্কি, আফগান ও মুঘল আক্রমণ প্রতিহত করেছে। বিভিন্ন সময়ে ত্রিপুরীরা পূর্ব থেকে বর্মী ও আরাকানি আক্রমণও প্রতিহত করেছে। সেই অবস্থায় রাজ্যটি বর্তমান ত্রিপুরা, বাংলাদেশের সিলেট বিভাগ, আসামের কাছাড় অঞ্চল ও বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গঠিত ছিলো, এবং এমনকি এটি ব্রিটিশরা আসার পূর্বে স্বাধীন থাকতে সক্ষম হয়েছিলো।
তবে ত্রিপুরার সমভূমি অঞ্চল মুঘল আক্রমণের কবলে পড়ে। এই সমভূমি বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব ঢাকা বিভাগ ও কুমিল্লা অঞ্চল নিয়ে গঠিত। একদিকে এই সমভূমি ইসলামিকরণ হলেও অন্যদিকে পার্বত্য ত্রিপুরা পূর্বদিকে প্রবেশের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বাঁধা হিসেবে কাজ করেছিলো। পার্বত্য ত্রিপুরার রাজাগণ হিন্দু ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ছিলো। আধুনিক যুগে তাদেরকে পূর্ব ভারতের দীর্ঘতম ও সবচেয়ে স্থায়ী রাজবংশ হিসেবে স্মরণ করা হয়।
ধন্য মাণিক্য (শাসনকাল ১৪৬৩ থেকে ১৫১৫) তিপ্রার অঞ্চল পূর্ববঙ্গ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। রাঙামাটির নাম উদয় মাণিক্যের নাম অনুসারে উদয়পুর রাখা হয়। রাজ্যটি ১৬শ ও ১৭ শতাব্দীর দিকে গোবিন্দ মাণিক্যর মতো রাজাদের হাতে সমৃদ্ধ হতে থাকে যে পশ্চিমের মুসলিম রাজ্যগুলোর হাত থেকে রক্ষার জন্য রাজ্যে কঠোর নিরাপত্তা প্রদান করে। যদিও সমভূমিগুলো পূর্ববঙ্গের সমভূমির মুঘল রাজ্যপাল সমর্থিত ধর্মত্যাগী ত্রিপুরী রাজপুত্রের কারণে ত্রিপুরা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপরে তিপ্রার সমভূমি একটি পৃথক মুঘল করদ রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় যেখানের রাজাদের নিয়োগে মুঘল শাসকরা প্রভাব বিস্তারকারী ছিলো। তবে মুঘলরা কোনদিন পূর্বদিকের পার্বত্য অঞ্চল দখল করতে পারেনি।
ব্রিটিশ ভারত
সম্পাদনাব্রিটিশ ভারতে রাজারা ব্রিটিশ ভারতের নিকট রাজ্যের সম্পত্তির একাংশ রেখেছিলেন যার নাম ত্রিপুরা জেলা বা চাকলা রোশনাবাদ (বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চল), অন্যদিকে স্বাধীন এলাকা তথা বর্তমান ত্রিপুরা রাজ্য পার্বত্য ত্রিপুরা নামে পরিচিত ছিলো। বীর চন্দ্র মাণিক্য (১৮৬২–১৮৯৬) ব্রিটিশ ভারতের আদলে রাজ্যের প্রশাসন ঢেলে সাজান ও আগরতলা পৌরনিগম গঠন করা সহ বহু সংস্কার প্রণয়ন করেন। শেষ রাজা ছিলো বীর বিক্রম কিশোর দেব বর্মনের পুত্র কিরিৎ বিক্রম কিশোর যিনি দুই বছর ১৯৪৭–১৯৪৯ এর জন্য রাজত্ব করেন। ১৯৪৯ সালে ত্রিপুরা ভারত প্রজাতন্ত্রের অংশ হয়। ত্রিপুরী "আপাত উত্তরাধিকারী" হল শেষ রাজার পুত্র কিরাত প্রদ্যুৎ কিশোর মাণিক্য দেব বর্মন (জন্ম ১৯৭৮) যাকে কখনো কখনো "মহারাজা" উপাধি দেওয়া হয়।
আরো পড়ুন
সম্পাদনাটীকা
সম্পাদনা- ↑ ১৫৬২ সালে, চিলারায় রাজ্য আক্রমণ করে এবং বরাক উপত্যকা অধিকার করে যেখানে খাসপুর রাজ্যটি কোচ রাজ্য) এর দেওয়ানি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। (Bhattacharjee 1994:71) ১৮শ শতাব্দীতে, একজন কাছাড়ি রাজা হাইলাকান্দি উপত্যকা দখল করেন। (Bhattacharjee 1994:72)
- ↑ "মিং শিলুর নথি উল্লেখ করে যে এই রাজ্যের অঞ্চলটি ১৫শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে "দা গু-লা" (তাই-জং ২৬৯.৩এবি) দ্বারা দখল করা হয়েছিল, যা আসামের নিকটবর্তী একটি অঞ্চলের পরামর্শ দেয়, এতে সন্দেহ নেই যে এটি ব্রহ্মপুত্র ও উত্তরাঞ্চলীয় বঙ্গের দক্ষিণে অবস্থিত ত্রিপুরাকে নির্দেশ করছে।"(Wade 1994:253)
- ↑ (Boland-Crewe ও Lea 2005, পৃ. 238)
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- Wade, Geoffrey (১৯৯৪), The Ming Shi-lu (Veritable Records of the Ming Dynasty) as a Source for Southeast Asian History -- 14th to 17th Centuries, Hong Kong
- Bhattacharjee, J B (১৯৯৪), "Pre-colonial Political Structure of Barak Valley", Sangma, Milton S, Essays on North-east India: Presented in Memory of Professor V. Venkata Rao, New Delhi: Indus Publishing Company, পৃষ্ঠা 61–85
- Boland-Crewe, Tara; Lea, David (২০০৫) [2002]। The Territories and States of India। London: Routledge। আইএসবিএন 978-1-135-35625-5।
- Tripura Buranji 17th Century Ahom Chronicle.
- Progressive Tripura, 1930
- Rajmala, royal chronicle of Tripura Kings.
- Hill Tippera – History The Imperial Gazetteer of India, 1909, v. 13, p. 118.
আরো পড়ুন
সম্পাদনা- অনলাইন বই ও উপকরণ
- ত্রিপুরা রাজমালা (১৮৫০), রেভ. জেমস লং