ঢাকাইয়া বিরিয়ানি

ঢাকাইয়া বিরিয়ানি বা ঢাকাই বিরিয়ানি হলো পুরান ঢাকায় উদ্ভাবিত, প্রচলিত ও পরিমার্জিত সমস্ত বিরিয়ানির সমষ্টিগত নাম। এটি দ্বারা একক কোনো বিরিয়ানিকে নির্দেশ করা হয় না। এই বিরিয়ানিগুলি মুঘল রন্ধনশৈলী, ঢাকার নবাবী রন্ধনশৈলী দ্বারা প্রভাবিত হলেও এবং স্থানীয় উপকরণ এবং রন্ধনশৈলীতে পেয়েছে স্বাতন্ত্র্য ও ভিন্ন রূপ।

ঢাকাইয়া বিরিয়ানি
ঢাকাইয়া কাচ্চি বিরিয়ানি
প্রকারপ্রধান খাবার
উৎপত্তিস্থলবাংলাদেশ
অঞ্চল বা রাজ্যঢাকা
প্রধান উপকরণচাল, মাংস (খাসি, মুরগি), আলু, মসলা
ভিন্নতাকাচ্চি বিরিয়ানি, পাক্কি বিরিয়ানি, মোরগ পোলাও, ব্রয়লার বিরিয়ানি, হাজী বিরিয়ানী, নান্না বিরিয়ানি, ফখরুদ্দিনের বিরিয়ানি।

ইতিহাস

সম্পাদনা

ঢাকাইয়া বিরিয়ানির শিকড় মুঘল রন্ধনশৈলীতে প্রোথিত। মুঘল শাসকরা ১৭শ শতাব্দীতে ঢাকাকে বাংলার সুবাহর রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পর এখানে বিরিয়ানির প্রচলন শুরু হয়।

মুঘল রন্ধনশৈলীর প্রভাব

সম্পাদনা

মুঘল শাসনের সময় বিরিয়ানির প্রচলন দক্ষিণ এশিয়ায় বৃদ্ধি পায়। ঢাকায় মুঘল শাসক এবং অভিজাত শ্রেণি তাদের খাবারে মসলার সমৃদ্ধ ব্যবহার এবং ধীরে ধীরে রান্নার পদ্ধতি নিয়ে আসে। মুঘল রন্ধনশৈলীর কাচ্চি পদ্ধতি ঢাকার রন্ধনশৈলীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। মুঘল রান্নায় ধীরে ধীরে রান্না করার কৌশল, ঘি ও মসলার ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার ঢাকার বিরিয়ানিতে বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

ঢাকার নবাব পরিবারের প্রভাব

সম্পাদনা

মুঘলদের রন্ধনশৈলী ঢাকার নবাব পরিবারের মাধ্যমে বিশেষভাবে বিকশিত হয়। নবাবরা মুঘল রন্ধনপদ্ধতির উপাদান গ্রহণ করে স্থানীয় উপকরণের সঙ্গে সংযুক্ত করেন। বিশেষ করে নবাব পরিবারের ভোজন তালিকায় কাচ্চি বিরিয়ানি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এতে আলুর ব্যবহার এবং মসলার মৃদুতা ঢাকাইয়া বিরিয়ানির বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্থায়ী হয়। নবাবদের অতিথিসেবা ও আড়ম্বরপূর্ণ ভোজসভাগুলো ঢাকাইয়া বিরিয়ানির প্রসার-প্রচলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।[]

আধুনিক রূপ

সম্পাদনা

১৯শ শতকের শেষ এবং ২০শ শতকের শুরুতে নবাব পরিবারের ঐতিহ্যবাহী রান্নার ধারা ঢাকার সাধারণ জনগণের মধ্যে জনপ্রিয় হয়। এটি আরও সহজলভ্য এবং বাণিজ্যিকভাবে প্রসারিত হয়। হাজীর বিরিয়ানি এবং নান্না বিরিয়ানি ঢাকাইয়া বিরিয়ানির দুটি প্রসিদ্ধ ব্র্যান্ড হয়ে ওঠে।[]

ঢাকাইয়া বিরিয়ানির বৈশিষ্ট্য

সম্পাদনা

ঢাকাইয়া বিরিয়ানির বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • কাচ্চি পদ্ধতিতে মাংস ও চাল একসঙ্গে রান্না।
  • আলুর ব্যবহার, যা এটি অন্য বিরিয়ানির থেকে আলাদা করে।
  • মৃদু মসলা এবং সুগন্ধি চালের প্রাধান্য।
  • মাংসের নরমতা এবং স্বাদের ভারসাম্য।

ঢাকাইয়া বিরিয়ানির সঙ্গে অন্যান্য বিরিয়ানির পার্থক্য

সম্পাদনা

চট্টগ্রামের বিরিয়ানি

সম্পাদনা

চট্টগ্রামের বিরিয়ানি, যা সাধারণত মেজবান বিরিয়ানি নামে পরিচিত, ঢাকাইয়া বিরিয়ানির তুলনায় বেশি ঝাল এবং মসলাদার। চট্টগ্রামের বিরিয়ানিতে গরু ও মহিষের মাংসের ব্যবহার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য, যা ঢাকাইয়া বিরিয়ানিতে দেখা যায় না। অন্যদিকে, ঢাকাইয়া বিরিয়ানির স্বাদ কম ঝালযুক্ত এবং এটি আলু ছাড়া অসম্পূর্ণ।

কলকাতার বিরিয়ানি

সম্পাদনা

কলকাতার বিরিয়ানি ঢাকাইয়া বিরিয়ানির মতো আলুর ব্যবহার করলেও মসলার স্বাদে ভিন্ন। কলকাতার বিরিয়ানিতে মিষ্টি স্বাদ কিছুটা বেশি লক্ষ করা যায় এবং এতে কেওড়া জল ব্যবহৃত হয়। এটি ঢাকাইয়া বিরিয়ানির স্বাদ থেকে আলাদা।

হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি

সম্পাদনা

হায়দারাবাদে বিরিয়ানিতে টক-মিষ্টি স্বাদের প্রভাব রয়েছে, যা ঢাকাইয়া বিরিয়ানিতে দেখা যায় না। হায়দারাবাদি বিরিয়ানিতে সাধারণত নারকেলের দুধের ব্যবহার করা হয়, যা ঢাকাইয়া রন্ধনশৈলীতে অপ্রচলিত।

জনপ্রিয়তা

সম্পাদনা

ঢাকাইয়া বিরিয়ানি শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও অত্যন্ত জনপ্রিয়। এছাড়াও যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য, এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে এটি একটি পছন্দের খাবার হিসেবে পরিচিত। ঢাকাইয়া বিরিয়ানির সহজলভ্যতা এবং বিশেষ স্বাদ এর জনপ্রিয়তার মূল কারণ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খাদ্য উৎসবে এই বিরিয়ানি উপস্থাপন করা হয়েছে, যা এটি বিশ্বমঞ্চে পরিচিত করে তুলেছে।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Ahmed, K. (2017). Mughal Cuisine and Its Influence on Dhaka's Culinary Scene. Dhaka University Press.
  2. Rahman, S. (2021). "Biryani Tales: From Mughals to Modern Dhaka", Dhaka Tribune.