টেরা অস্ট্রালিস (ল্যাটিন: Terra Australis; তেরা অস্ত্রালিস; দক্ষিণের ভূমি) একটি কাল্পনিক মহাদেশ যা পঞ্চদশ থেকে অস্টাদশ শতাব্দী পর্য্যন্ত বিভিন্ন বিশ্ব মানচিত্রে অঙ্কিত হতে থাকে। যদিও মানচিত্রে এই মহাদেশকে দেখানো হতে থাকে, কিন্তু এই মহাদেশের অস্তিত্বের পেছনে কোন বাস্তব প্রমাণ ছিল না। উত্তর গোলার্ধের ভূমিসমষ্টির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যে দক্ষিণ গোলার্ধেও যে সমপরিমাণ ভূমি থাকতে পারে, এই তত্ত্বে বিশ্বাস করে এই মহাদেশের কল্পনা করা হয়।[] পঞ্চম শতাব্দীতে ম্যাক্রোবিয়াস তার মানচিত্রে অস্ট্রালিস নামক এই ধরনের সামঞ্জস্য রক্ষাকারী ভূমির কল্পনা করে মানচিত্র তৈরি করেন।[]

টেরা অস্ট্রালিস
আব্রাহাম ওর্তেলিয়াসের ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দের মানচিত্র যার তলার দিকে তেরা অস্ত্রালিস নোন্দম কগণিতা নামক এক সুবিশাল কাল্পনিক মহাদেশের চিত্র অঙ্কিত রয়েছে।

ঊনবিংশ শতাব্দির প্রথম ভাগে ব্রিটিশ অভিযাত্রী ম্যাথিউ ফ্লিন্ডার্স টেরা অস্ট্রালিসের নামে অস্ট্রেলিয়ার নাম জনপ্রিয় করেন। তার মত ছিল যে, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের দক্ষিণে কোন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভূমি পাওয়ার সম্ভব নয়।[পা ১] ফ্লিন্ডার্স কর্ত্তৃক এ ভেজ টু টেরা অস্ট্রালিস নামক গ্রন্থ রচনার বহু দশক পরে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের দক্ষিণে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ আবিষ্কৃত হয়।

অন্য নাম

সম্পাদনা

দক্ষিণের কাল্পনিক মহাদেশের টেরা অস্ট্রালিস বা তেরা অস্ত্রালিস ছাড়াও আরো বেশ কিছু নাম প্রচলিত ছিল, যেমন তেরা অস্ত্রালিস ইগ্নোতা (ল্যাটিন: Terra Australis Ignota) বা তেরা অস্ত্রালিস ইনকগ্নিতা (ল্যাটিন: Terra Australis Incognita; দক্ষিণের অজানা স্থান) বা তেরা অস্ত্রালিস নোন্দম ইনকগ্নিতা (ল্যাটিন: Terra Australis Nondum Incognita; এতদবধি দক্ষিণের অজানা স্থান) ইত্যাদি। এছাড়াও ব্রাসিলিয়া অস্ত্রালিস (ল্যাটিন: Brasiliae Australis) বা ম্যাগেলানিকা (ল্যাটিন: Magellanica; ম্যাগেলানের দেশ) বা লা অস্ত্রালিয়া দেল এস্পিরিতু সান্তো (ল্যাটিন: La Australia del Espíritu Santo; পবিত্র আত্মার দেশ) ইত্যাদি নামও প্রচলিত ছিল।

উৎপত্তি

সম্পাদনা
 
তেরা অস্ত্রালিস রিসেন্তের ইনভেন্তা সেদ নোন্দম প্লেনে কগণিতা (“টেরা অস্ট্রালিস, সদ্য আবিষ্কৃত কিন্তু সম্পূর্ণ রূপে জ্ঞাত নয়”), ইয়োহানেস স্খোনার, ১৫৩৩-এর মানচিত্র: দক্ষিণ গোলার্ধ
 
কুনয়ু ওয়াঙ্গুয়ো চুয়ান্তু নামক ১৬০২ খ্রিস্টাব্দের চীনা মানচিত্রে 墨瓦喇尼加 মোওয়ালানিজিলা নামক দক্ষিণের বিশাল মহাদেশ

অ্যারিস্টটল সর্বপ্রথম টেরা অস্ট্রালিসের ধারণা দেন।[] প্রথম শতাব্দীতে টলেমি এই ধারণাকে পুষ্ট করেন এই বলে যে, ভারত মহাসাগর দক্ষিণে জমি দ্বারা বেষ্টিত ও উত্তর গোলার্ধের ভূমিভাগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য দক্ষিণ গোলার্ধে সমপরিমাণ ভূমিভাগ থাকা উচিত।[] মার্কাস তুল্লিয়াস সিসেরো সিঙ্গুলাস অস্ত্রালিস (ল্যাটিন: cingulus australis; দক্ষিণ ভাগ) কথাটি চালু করেন,[পা ২] যার অন্তর্ভুক্ত ভূমিভাগকে তেরা অস্ত্রালিস নাম দেওয়া হয়।[]

অস্তিত্বের কোন ধরনের প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও তেরা অস্ত্রালিস ইনকগণিতা বা দক্ষিণের অজানা ভূমিভাগের প্রবাদ রোমান আমল থেকে চলে এসেছে। নবজাগরণের সময় সমগ্র ইউরোপে টলেমির মানচিত্র প্রচলিত ছিল, কিন্তু তাতে এই ধরনের কোন মহাদেশ অঙ্কিত ছিল না। এই মানচিত্রে আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণের মহাসাগরের অস্তিত্ব ছিল না, তাই মনে করা হত আফ্রিকা দক্ষিণ মেরু পর্য্যন্ত বিস্তৃত হলেও হতে পারে। সম্ভবতঃ ইয়োহানেস স্খোনারের ১৫২৩ খ্রিষ্টাব্দের মানচিত্রে প্রথমবারের জন্য টেরা অস্ট্রালিস অঙ্কিত হয়। এই মানচিত্রের ওপর ভিত্তি করর১৫৩১ খ্রিষ্টাব্দে ওরোন্সে ফিনে তার হৃৎপিণ্ডাকৃতি বিশ্ব মানচিত্র প্রস্তুত করেন বলে মনে করা হয়,[][] যেখানে দক্ষিণের মহাদেশকে তেরা অস্ত্রালিস রিসেন্তের ইনভেন্তা সেদ নোন্দম প্লেনে কগণিতা (ল্যাটিন: Terra Australis recenter inventa sed nondum plene cognita; "সদ্য আবিষ্কৃত ভূমি যা সম্পূর্ণ রূপে জ্ঞাত নয়") নামে উল্লেখ করেন।[] দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ থেকে বিস্তৃত জলরাশিকে তিনি মারে ম্যাগেলানিকাম (ল্যাটিন: Mare Magellanicum) নামকরণ করেন।[১০] স্খোনার ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দে রচিত তার গ্রন্থ ওপাসকুলাম জিওগ্রাফিকাম (ল্যাটিন: Opusculum geographicum) দক্ষিণের এই মহাদেশকে ব্রাসিলিয়া অস্ত্রালিস নাম দেন।[পা ৩]

পাদটীকা

সম্পাদনা
  1. There is no probability, that any other detached body of land, of nearly equal extent, will ever be found in a more southern latitude; the name Terra Australis will, therefore, remain descriptive of the geographical importance of this country and of its situation on the globe: it has antiquity to recommend it; and, having no reference to either of the two claiming nations, appears to be less objectionable than any other which could have been selected.[]
  2. Duo [cingulis] sunt habitabiles, quorum australis ille, in quo qui insistunt adversa vobis urgent vestigia, nihil ad vestrum genus[]
  3. Brasilia Australis is an immense region toward Antarcticum, newly discovered but not yet fully surveyed, which extends as far as Melacha and somewhat beyond. The inhabitants of this region lead good, honest lives and are not Anthropophagi [cannibals] like other barbarian nations; they have no letters, nor do they have kings, but they venerate their elders and offer them obedience; they give the name Thomas to their children [after St Thomas the Apostle]; close to this region lies the great island of Zanzibar at 102.00 degrees and 27.30 degrees South.[১১]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. John Noble Wilford: The Mapmakers, the Story of the Great Pioneers in Cartography from Antiquity to Space Age, p. 139, Vintage Books, Random House 1982, আইএসবিএন ০-৩৯৪-৭৫৩০৩-৮
  2. Ambrosius Aurelius Theodosius Macrobius, Zonenkarte. Retrieved 7 July 2014.
  3. Flinders, Matthew. A voyage to Terra Australis (Introduction). Retrieved 25 January 2013.
  4. "Meteorologica Book II 5"। ২৭ জুন ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ 
  5. Alfred Hiatt, "Terra Australis and the Idea of the Antipodes", Anne M. Scott (ed), European Perceptions of Terra Australis, Ashgate Publishing, 2012, pp. 18–10.
  6. William Eisler,The Furthest Shore: Images of Terra Australis from the Middle Ages to Captain Cook, Cambridge University Press, 1995, p. 10.
  7. Albert-Marie-Ferdinand Anthiaume, "Un pilote et cartographe havrais au XVIe siècle: Guillaume Le Testu", Bulletin de Géographie Historique et Descriptive, Paris, Nos 1–2, 1911, pp. 135–202, n.b. p. 176.
  8. Franz von Wieser, Magalhães-Strasse und Austral-Continent. Auf den Globen Johannes Schöner. Beitrage zur Geschichte der Erdkunde im xvi. Jahrhundert, Innsbruck, 1881 (reprinted Amsterdam, Meridian, 1967)
  9. Pelletier, Monique (১৯৯৫)। "The cordiform World maps by Oronce Fine"Cartographica Helvetica12: 27–37। সংগ্রহের তারিখ ৩১ ডিসেম্বর ২০১১ 
  10. Orontius Fineus: Rare Book and Special Collections Division, Library of Congress, 1531, (147.03.00)
  11. Johannes Schoener, Opusculum Geographicum, Norimberga, [1533], Pt.II, cap.xx. Ioannis Schoneri ... Opusculum geographicum