জীবের বৃদ্ধি
এই নিবন্ধটিকে উইকিপিডিয়ার জন্য মানসম্পন্ন অবস্থায় আনতে এর বিষয়বস্তু পুনর্বিন্যস্ত করা প্রয়োজন। (সেপ্টেম্বর ২০২৪) |
এই নিবন্ধটি এমনভাবে লেখা হয়েছে যে মনে হচ্ছে এটি একটি ব্যক্তিগত ভাবনা বা মতামত সম্বলিত রচনা এবং হয়তো নিবন্ধটির পরিচ্ছন্নকরণ প্রয়োজন। (সেপ্টেম্বর ২০২৪) |
বৃদ্ধি জীবদেহের অন্যতম প্রধান লক্ষণ। প্রোটোপ্লাজম কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় জীবের আকার, আয়তন এবং শুষ্ক ওজন বর্ধিত হওয়াকে বৃদ্ধি বলে। জীবের বৃদ্ধির সময় উপচিতি প্রক্রিয়া অপচিতির তুলনায় বেশি হয়। প্রতিটি সজীব পদার্থের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বৃদ্ধি। ছোট্ট চারাগাছ আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে ও পরিণামে মস্ত বড় গাছে পরিণত হয়। প্রাণীদের বেলাতেও আমরা দেখি প্রত্যেক প্রাণীই ছোট থেকে বড় হয়, অর্থাৎ তার দেহের বৃদ্ধি ঘটে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, অনেক জড়বস্তুর মধ্যেও তো বৃদ্ধির ব্যাপারটি লক্ষ্য করা যায়, যেমন একটি বাড়ী তৈরি হওয়ার সময় আমরা দেখি কেমন করে ভিত তৈরি থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে একতলা, দোতলা কিংবা হয়তো আট-দশ তলা বাড়ী গড়ে উঠেছে। এটার সঙ্গে সজীব বস্তুর বৃদ্ধিলাভের তফাৎ কোথায়?
তফাৎ অবশ্যই আছে। সজীব বস্তু যখন বেড়ে ওঠে তখন তার জন্যে খাদ্যের দরকার। গাছপালা মাটি থেকে জল আর বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিয়ে সালোকসংশ্লেষ পদ্ধতিতে শর্করা খাদ্য প্রস্তুত করে, আর প্রাণীরা বেঁচে থাকে উদ্ভিজ্জ বা প্রাণিজ খাদ্য গ্রহণ করে। এই খাদ্যবস্তু যাই হোক না কেন উদ্ভিদ ও প্রাণীরা তা থেকে আপন দেহগঠনের উপাদান বা সজীব প্রোটোপ্লাজম পদার্থ তৈরি করে নেয় ও এর ফলেই দেহ বৃদ্ধি পায়। তার অর্থ এই বৃদ্ধি ভিতর থেকে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় ঘটে। জড়বস্তুর বৃদ্ধির ব্যাপারটি কিন্তু তা নয়। বাড়ী যখন তৈরি হয় তখন বাইরে থেকে ইট, কাঠ, পাথর ইত্যাদি যোগ করলে অর্থাৎ যে জিনিস দিয়ে বাড়ী তৈরি, সেই সব জিনিস যুক্ত হলে তবেই বাড়ি ছোট থেকে বড় হয়। একইভাবে নতুন করে কাঠ জুড়ে কাঠের আসবাবপত্রকে বাড়ানো যায় বা একতাল মাটির সঙ্গে আরও মাটি দিলে তার আয়তন বৃদ্ধি ঘটে। এসব ক্ষেত্রে ভিতর থেকে উপাদানগুলি সংগৃহীত হয় না। সেগুলি বাইরে থেকে যোগ করতে হয়।[১]
বৃদ্ধির বিভিন্ন দশা
সম্পাদনাএককোষী জীবের কেবলমাত্র কোষের প্রোটোপ্লাজমের পরিমাণ বাড়িয়ে দেহের বৃদ্ধি ঘটায়। কিন্তু বহুকোষী জীবের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি কোষ বিভাজন দশা, কোষ দীর্ঘীকরণ দশা এবং কোষ বিভেদন ও পরিণতির দশা এই তিনটি দশার মাধ্যমে সাধিত হয়।
কোষ-বিভাজন দশা
সম্পাদনাএই দশায় দেহকোষ মাইটোসিস পদ্ধতিতে ক্রমাগত বিভাজিত হয়। এর ফলে দেহকোষের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়।
কোষ দীর্ঘীকরণ দশা
সম্পাদনাএই দশায় নতুন কোষগুলি আয়তনে বাড়ে। কোষের আয়তন বাড়াতে কোষীয় বস্তুর সংশ্লেষ ব্যাপকভাবে ঘটে।
কোষ বিভেদন ও পরিণতির দশা
সম্পাদনাএই দশায় কোষগুলি আকৃতি ও কাজের ভিত্তিতে ভাগ হয়। এই দশাতেই জীবদেহে বিভিন্ন কলা ও তন্ত্র গঠিত হয়। ফলে জীবদেহ পরিণতি লাভ করে।
বৃদ্ধির শর্ত
সম্পাদনাজীব দেহের বৃদ্ধি নিম্নের অনেকগুলি শর্তের ওপর নির্ভরশীল।
খাদ্য
সম্পাদনাখাদ্যই জীবদেহের বৃদ্ধির মূল উৎস। সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য জীবকোষে নিয়মিত ও পরিমাণমতো খাদ্য সরবরাহ অবশ্যই প্রয়োজন। প্রাণিদের বৃদ্ধির জন্য কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য, খনিজ লবণ, ভিটামিন ইত্যাদির প্রয়োজন। অধিকাংশ উদ্ভিদ নিজেবা সালোকসংশ্লেষে খাদ্য উৎপন্ন করতে পারে। খাদ্যের জারণে জীব প্রয়োজনীয় শক্তি পায়। এই শক্তি দিয়েই আবার বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ পরিচালিত হয়। সবল, সুস্থ দেহগঠনের জন্য আবার বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন সাহায্য করে।
হরমোন
সম্পাদনাজীবদেহের বৃদ্ধিতে বিভিন্ন রকম হরমোন সাহায্য করে। উদ্ভিদদেহে অক্সিন কোষ-বিভাজনে এবং কোষের আয়তন বাড়াতে সাহায্য করে। সাইটোকাইনিন উদ্ভিদ হরমোনও কোষ-বিভাজনে সাহায্য করে। জিব্বেরেলিন বীজের অঙ্কুরোদ্গমে সাহায্য করে। বিভিন্ন পতঙ্গের রূপান্তর একডাইজোন হরমোন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। মেরুদণ্ডী প্রাণিদের বৃদ্ধি বহুলাংশে পিটুইটারীর সম্মুখখণ্ড থেকে নিঃসৃত সোমাটোট্রফিক হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
বায়ু
সম্পাদনাজীবের বৃদ্ধিতে বায়ু নানাভাবে সাহায্য করে। এরমধ্যে অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন-এর প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশী।
অক্সিজেন
সম্পাদনাসবাত শ্বসনে জীব প্রধানত বায়ু থেকেই অক্সিজেন গ্রহণ করে। অক্সিজেনের সাহায্যে খাদ্য জারিত হয়ে শক্তি উৎপন্ন হয়। এই শক্তির সাহায্যে জীবের জৈবনিক ক্রিয়াকলাপ চলে এবং দেহে নির্দিষ্ট তাপ উৎপন্ন হয়।
কার্বন ডাই-অক্সাইড
সম্পাদনাসালোক সংশ্লেষের সময় সবুজ উদ্ভিদ পরিবেশ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। কার্বন ডাই-অক্সাইডের কার্বন পরমাণু গ্লুকোজ অণুর মধ্যে বাঁধা পড়ে গ্লুকোজ উৎপন্ন করে, তাই খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে কার্বন ডাই অক্সাইড গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর অভাবে সালোকসংশ্লেষ বন্ধ হয়, তথা খাদ্য উৎপাদন হয় না।
নাইট্রোজেন
সম্পাদনাজীবদেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জনা নাইট্রোজেন অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। নাইট্রোজেনের অভাবে জীবদেহের বৃদ্ধি ঘটে না। উদ্ভিদেরা নাইট্রোজেন সাধারণতঃ মাটি থেকে নাইট্রেট লবণ হিসেবে গ্রহণ করে।
জল
সম্পাদনাবৃদ্ধির জন্য জল অবশ্যই প্রয়োজন। কোষের প্রোটোপ্লাজমে শতকরা প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ জল থাকে। জলের মাধ্যমে খাদ্য শোষিত ও পরিবাহিত হতে পারে। উদ্ভিদের বৃদ্ধি ঘটাতে কোষের রসস্ফীতি দরকার। এটি জল ছাড়া সম্ভব নয়। এছাড়া সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার অন্যতম উপাদান জল। জল মাধ্যমে বিভিন্ন খনিজ লবণ ও ভিটামিন জীবদেহে গৃহীত ও পরিবাহিত হয়।
আলো
সম্পাদনাউদ্ভিদের বৃদ্ধি মূলত আলোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আলোর উপস্থিতিতেই সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষে খাদ্য উৎপন্ন করে। তাই আলো ছাড়া উদ্ভিদের বৃদ্ধি হয় না। প্রাণীদের বৃদ্ধি আলোর উপর খুব একটা নির্ভর করে না। তবে বিভিন্ন পতঙ্গের জীবনচক্রে আলোর প্রভাব আছে বলে জানা গেছে। অনেক প্রাণীর দেহত্বকে ভিটামিন D সংশ্লেষে আলো সাহায্য করে। ফলে দেহ কিছুটা নীরোগ হয়। সূর্যালোকের প্রভাবে জীবদেহের অনেক রোগ-জীবাণু মারা যায়। তাই পরোক্ষভাবে আলো আবার বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
তাপমাত্রা বা উষ্ণতা
সম্পাদনাজীবকোষে নানারকম বিপাকীয় কাজের জন্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বা উষ্ণতা প্রয়োজন হয়। নির্দিষ্ট উৎসেচক নির্দিষ্ট উষ্ণতার মধ্যে সক্রিয় থাকে। দেখা গেছে, জীবের বৃদ্ধির জন্য ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা উপযুক্ত।
উৎসেচক বা এনজাইম
সম্পাদনাজীবদেহে খাদ্যের পরিপাক ও বিপাক বিভিন্ন রকম উৎসেচক দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। জীবের বৃদ্ধির সময় উপচিতি তুলনামূলকভাবে বেশী ঘটাতে উৎসেচক সাহায্য করে।
বংশগতি
সম্পাদনানির্দিষ্ট জীবের বৃদ্ধি তার বংশগতির উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই বৃদ্ধি বংশগতির একক জিন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়।[২][৩]
বৃদ্ধির হার
সম্পাদনাজীবের বৃদ্ধি আজীবন সমানভাবে হয় না। কোন সময় ধীরগতিতে আবার কোন সময় দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি ঘটে। নির্দিষ্ট কোন সময়ে জীবদেহের বৃদ্ধির মাত্রাকে বৃদ্ধির হার বলে। অঙ্কুরোদ্গমের সময় উদ্ভিদের বৃদ্ধির হার বাড়ে। তারপর তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধির হার কমে যায়। তবে উদ্ভিদ কমবেশী আমৃত্যু বৃদ্ধি পায়। অধিকাংশ প্রাণীদের ক্ষেত্রে কম বয়সে বৃদ্ধির হার বেশী। তারপর বৃদ্ধির হার কমে যায়। পরিণত বয়সে বৃদ্ধি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
জীবের বৃদ্ধি-অঞ্চল
সম্পাদনাউদ্ভিদের বৃদ্ধি-অঞ্চল
সম্পাদনাউন্নত উদ্ভিদদেহে বৃদ্ধি সব জায়গায় সমানভাবে হয় না। উদ্ভিদের মূলের আগা, কাণ্ডের আগা এবং কুঁড়িতে বৃদ্ধি দ্রুতগতিতে ঘটে। এইসব এলাকায় ভাজক কলা বা মেরিস্টেম থাকে। এই কলাগুলি ক্রমাগত বিভাজিত হয়ে উদ্ভিদ অঙ্গের বৃদ্ধি ঘটায়। ভাজক কলা, অবস্থানগত দিক দিয়ে তিনরকমের হয়। এগুলি হল প্রান্তীয় ভাজক কলা, পার্শ্বীয় ভাজক কলা ও নিবেশিত ভাজক কলা।
প্রান্তীয় ভাজক কলা
সম্পাদনাকাণ্ড ও মূলের আগায় বা প্রান্তদেশে এর অবস্থান। এই কলা উদ্ভিদের লম্বায় বেড়ে ওঠার জন্যে দায়ী।
পার্শ্বীয় ভাজক কলা
সম্পাদনাকান্ড ও মূলের পার্শ্বদেশ বরাবর এগুলি বিস্তার লাভ করে। এই কলা উদ্ভিদের মূল বা কান্ডের পার্শ্বদেশে বেড়ে ওঠার জন্য দায়ী।
নিবেশিত ভাজক কলা
সম্পাদনাস্থায়ী কলার মধ্যে এই সব ভাজক কলা সন্নিবিষ্ট থাকে।
প্রাণীর বৃদ্ধি-অঞ্চল
সম্পাদনাউদ্ভিদের মতো প্রাণীদের বৃদ্ধি কোন নির্দিষ্ট অঙ্গে সীমাবদ্ধ থাকে না। জন্মানোর পর থেকে প্রাণীদেহে সামগ্রিকভাবে বৃদ্ধি ঘটে। এর ফলে প্রাণীটি ক্রমশ আকারে বড় হয়।
নির্ধারিত বৃদ্ধি
সম্পাদনাকয়েক রকম সরীসৃপ ও মাছ বাদে প্রায় সব প্রাণীর বৃদ্ধি আজীবন ধরে চলে না। নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলে প্রাণীদের বৃদ্ধি একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এই প্রকার বৃদ্ধিকে নির্ধারিত বৃদ্ধি বলে।
অনির্ধারিত বৃদ্ধি
সম্পাদনাযে ধরনের বৃদ্ধি জীবের সারা জীবন ধরে কম-বেশী চলে তাকে অনির্ধারিত বৃদ্ধি বলে। অধিকাংশ উদ্ভিদে আজীবন বৃদ্ধি হয়। তাই উদ্ভিদের বৃদ্ধি অনির্ধারিত বৃদ্ধি।
উদ্ভিদের বৃদ্ধি
সম্পাদনাঅন্যান্য জীবের মতো উদ্ভিদেরও বৃদ্ধি ঘটে। উদ্ভিদের বৃদ্ধি অনির্ধারিত, আমৃত্যু বৃদ্ধি ঘটে। এককোষী উদ্ভিদের বেলায় কেবলমাত্র কোষের আকার ও আয়তনের পরিবর্তন ঘটে বৃদ্ধি সম্পন্ন হয়। বহুকোষী উন্নত উদ্ভিদদেহে বৃদ্ধি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়।
ভ্রূণাণুর বৃদ্ধি
সম্পাদনাউদ্ভিদদেহে নিষেক ক্রিয়ায় ভ্রূণাণু উৎপন্ন হয়। এককোষী ভ্রূণাণু ক্রমাগত বিভাজিত হয়ে বহুকোষী ভ্রূণে পরিণত হয়। উদ্ভিদের ভ্রূণ ভ্রূণমূল, ভ্রূণমুকুল এবং ভ্রূণাক্ষ নিয়ে গঠিত। বীজের মধ্যে ভ্রূণ বহুদিন যাবৎ সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। ভ্রূণ বীজপত্র বা শস্য থেকে খাদ্য পেয়ে জীবনধারণ করে।
বীজের অঙ্কুরোদ্গম
সম্পাদনাউপযুক্ত পরিমাণে জল, বাতাস, উষ্ণতা ইত্যাদির প্রভাবে বীজের সুপ্ত অবস্থা কেটে যায়। তখন বীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারাগাছে পরিণত হয়। অঙ্কুরোদগমের সময় ভ্রূণমূল মূলে এবং ভ্রূণমুকুল বিটপ অংশে (যেমন কাণ্ড, পাতা ইত্যাদি) পরিণত হয়। এই সময় বীজপত্র খাদ্য যোগায়। কিছুদিন পর বীজপত্র নষ্ট হয়ে যায়। চারাগাছ সালোকসংশ্লেষে খাদ্য উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়।
চারাগাছ থেকে বড় উদ্ভিদ
সম্পাদনাচারাগাছ সালোকসংশ্লেষ-পদ্ধতিতে খাদ্য উৎপাদন করে নিজদেহের পুষ্টি সাধন করে, এবং দিন দিন আকারে বড় হতে থাকে। এইভাবে ক্রমে স্বাভাবিক পরিণত গাছে রূপান্তরিত হয়। এই সময় কোষ-বিভাজন দশা, কোষ দীর্ঘীকরণ দশা এবং কোষ বিভেদন দশা অনুসৃত হয়। ফলে চারাগাছ শাখা, প্রশাখা, পাতা ইত্যাদি ব্যাপকভাবে বিস্তার করে বড় গাছে পরিণত হয়। উদ্ভিদের এই প্রকার বৃদ্ধিকে প্রাথমিক বৃদ্ধি বলা হয়। এই বৃদ্ধিতে ভাজক-কলা সাহায্য করে। প্রাথমিক বৃদ্ধির পর দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদে গৌণ বৃদ্ধি ঘটে।
গৌণ বৃদ্ধির ফলে উদ্ভিদ পরিধিতে বাড়ে। মূল ও কাণ্ডে অবস্থিত ক্যাম্বিয়াম নামে গৌণ ভাজক কলা বারবার বিভাজিত হয়ে কাণ্ড ও মূলকে প্রন্থে বাড়ায় বা মোটা করে। অধিকাংশ একবীজপত্রী উদ্ভিদে সাধারণত গৌণ বৃদ্ধি ঘটে না। প্রাথমিক বৃদ্ধি ও গৌণ বৃদ্ধিকে উদ্ভিদের অঙ্গজ বৃদ্ধি বলা হয়। অঙ্গজ বৃদ্ধির শেষে উদ্ভিদে ফুল, ফল সৃষ্টি হয়। ফুল ও ফলের বৃদ্ধিকে জনন-বৃদ্ধি বলা যায়। অঙ্কুরোদ্গমের পর উদ্ভিদের বৃদ্ধি দ্রুত হয়। তারপর বৃদ্ধি মন্থর গতিতে চলে এবং পরিণত অবস্থায় বৃদ্ধি খুব একটা হয় না। অঙ্কুরোদ্গমের পর থেকে উদ্ভিদের বৃদ্ধি প্রায় বন্ধ হওয়া পর্যন্ত সময়কে মুখ্য বৃদ্ধি কাল বলা হয়। উদ্ভিদের বৃদ্ধি জল, বায়ু, মাটি তথা পরিবেশের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। যে সমস্ত গাছ বহু বছর বাঁচে, কাণ্ডের বৃদ্ধির ফলে, প্রতিবছর বৃদ্ধির হারের তারতম্যের জন্যে কাঠে বলয়ের ন্যায় আকার দেখা যায়। বলয়গুলি বছর বছর এককেন্দ্রী বৃত্তের আকারে বিন্যস্ত হয়। প্রতি বছর একটি করে বলয় গঠিত হয় বলে একে বর্ষ বলয় বলে। কাণ্ডের প্রস্থচ্ছেদে বর্ষবলয় দেখে উদ্ভিদের বয়স কিছুটা অনুমান করা যায়।
প্রাণীদের বৃদ্ধি
সম্পাদনাউদ্ভিদের ন্যায় প্রাণীদের বৃদ্ধি নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকে না। বহুকোষী প্রাণীর বৃদ্ধি সর্বাঙ্গ জুড়ে ঘটে। তবে প্রাণী পরিণত অবস্থাপ্রাপ্ত হলে বৃদ্ধি প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। প্রাণীদের বৃদ্ধি নির্ধারিত। উন্নত প্রাণীদের বৃদ্ধি কয়েকটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়। এগুলি নীচে বর্ণনা করা হল:
ভ্রূণের বৃদ্ধি ও পরিস্ফুরণ
সম্পাদনানিষেকের ফলে ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু মিলিত হয়ে এককোষী জাইগোট উৎপন্ন হয়। বার বার মাইটোসিস কোষ-বিভাজনের মাধ্যমে বহুকোষযুক্ত ব্লাসটুলা উৎপন্ন হয়। ব্লাসটুলা একস্তর কোষযুক্ত বলের ন্যায়। তারপর আবার কোষ- বিভাজনের মাধ্যমে ব্লাসটুলা থেকে গ্যাসটুলা উৎপন্ন হয়। ছিদ্রাল প্রাণী ও একনালীদেহী প্রাণী ছাড়া অধিকাংশ প্রাণীর গ্যাসটুলা তিনটি কোষস্তর নিয়ে গঠিত হয়। বাইরের স্তরকে এক্টোডারম, মাঝের স্তরটিকে মেসোডারম্ এবং সবচেয়ে ভেতরের স্তরটিকে এন্ডোডারম বলে। এই তিনটি প্রাথমিক কোষস্তরকে জারম স্তরও বলা হয়। জারম স্তরের বৃদ্ধি ও পরিবর্তনের ফলে ভ্রূণ গঠিত হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, উপরোক্ত তিনরকম কোষস্তর থেকেই ভ্রূণের নির্দিষ্ট কলা, অঙ্গ এবং তন্ত্র গঠিত হয়। মাছের ভ্রূণ জলে বাড়তে থাকে। সরীসৃপ বা পাখীর ভ্রূণ ডিমের মধ্যে বাড়তে থাকে। মানুষ সহ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ভ্রূণ মাতৃদেহের জরায়ুতে বাড়ে। ভ্রূণের বৃদ্ধি সম্পূর্ণ হতে বিভিন্ন প্রাণীতে বিভিন্ন রকম সময় লাগে। দেখা গেছে, বৃদ্ধি সম্পূর্ণ হতে হাতির প্রায় ৬০০ দিন এবং মানুষের প্রায় ২৮০ দিন সময় প্রয়োজন।
ভ্রূণোত্তর বৃদ্ধি ও পরিস্ফুরণ
সম্পাদনাপ্রাণীদের ভ্রূণোত্তর বৃদ্ধি এবং পরিস্ফুরণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুধরনের হয়।
প্রত্যক্ষ পরিস্ফুরণ
সম্পাদনাভ্রূণের বৃদ্ধি সম্পূর্ণ হলে সরীসৃপ ও পাখিদের বাচ্চা ডিম ফুটে বেরিয়ে আসে। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের প্রসবকালে শিশুপ্রাণী জরায়ু থেকে বেরিয়ে আসে। এক্ষেত্রে শিশুপ্রাণীর আকার ছোট হলেও দেখতে পূর্ণাঙ্গ প্রাণীর মতো। কোষ-বিভাজনের মাধ্যমে শিশুপ্রাণীর দেহের ওজন ও আয়তন উভয়ই বাড়ে। ক্রমে নির্দিষ্ট সময়ে প্রাণীর পূর্ণাঙ্গ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। এই ধবনের পরিস্ফুরণ পদ্ধতিকে প্রত্যক্ষ পরিস্ফুরণ বলে।
পরোক্ষ পরিস্ফুরণ
সম্পাদনামশা, মাছি, মৌমাছি, রেশম মথ, প্রজাপতি ইত্যাদির পতঙ্গ, ঝিনুক, ব্যাঙ ইত্যাদির ভ্রূণ থেকে যে বাচ্চা উৎপন্ন হয় তা দেখতে পূর্ণাঙ্গ প্রাণীর মতো হয় না। এই রকম বাচ্চাকে শুক। বা লার্ভা বলা হয়। প্রজাপতির লার্ভা শুয়োপোকা, রেশম মথের লার্ভা পলু, ব্যাঙের লার্ভা ব্যাঙাচি নামে পরিচিত। লার্ভার দেহের আমূল পরিবর্তনের ফলে পূর্ণাঙ্গ প্রাণী সৃষ্টি হয়। এই ধরনের পরিবর্তনকে রূপান্তর বলা হয়। বিভিন্ন পতঙ্গ শ্রেণির প্রাণীতে ডিম, লার্ভা, পিউপা ও পূর্ণাঙ্গ এই চারটি দশা জীবনচক্রে দেখা যায়। যে পরিস্ফুরণে প্রাণীর লার্ভা বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে পূর্ণাঙ্গ প্রাণীতে পরিণত হয় তাকে পরোক্ষ পরিস্ফুরণ বলে।
জনন-বৃদ্ধি
সম্পাদনাপ্রাণী পরিণত হলে জনন-অঙ্গে কোষ-বিভাজন পদ্ধতিতে বৃদ্ধি ঘটে। একে জনন-বৃদ্ধি বলা হয়।
পুনরুৎপাদন
সম্পাদনাপ্রাণীদেহের কোন অঙ্গ কেটে গেলে বা নষ্ট হলে অনেক সময় কোষ-বিভাজনের ফলে অঙ্গটি পুনর্গঠিত হয়। যেমন- টিকটিকির লেজ খসে পড়লে আবার তা গঠিত হয়ে যায়। তেমনি, তারামাছকে কেটে ফেললে, ভগ্নাংশ থেকেই আবার সম্পূর্ণ প্রাণীটির দেহ পুনর্গঠিত হয়। তাই পুনরুৎপাদনও এক ধরনের বৃদ্ধি।[৪] [৫]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান: তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী, শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতা, বছর১৯৮৬, পৃঃ ৭২
- ↑ মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান: তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী, শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতা, বছর:১৯৮৬, পৃঃ ৭৩,৭৪
- ↑ https://www.britannica.com/science/growth-biology
- ↑ https://www.vedantu.com/biology/growth-and-development-of-organism?utm_term=SOCIAL_SHARE
- ↑ উচ্চমাধ্যমিক জীববিজ্ঞান: শৈলেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী, শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতা, বছর: ১৯৭৬ পৃঃ ৯০-৯৫