জাহাজ ভাঙা শিল্প
উন্নয়নশীল দেশগুলোর বদৌলতে জাহাজ ভাঙা শিল্প পুরো বিশ্বে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। মূলত যেসব পণ্যবাহী বা যাত্রীবাহী জাহাজের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, সেসব জাহাজের মালিকেরা ঐ জাহাজগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে তা বিক্রি করে। প্রতি বছর প্রায় গড়ে ৬০০ টি[১] পুরানো জাহাজ দক্ষিণ এশিয়ার মত দেশগুলোতে কাটা হচ্ছে। জাহাজ ভাঙা শিল্পকে কেন্দ্র করে এসব দেশের সমুদ্র সৈকতগুলোতে গড়ে উঠেছে বড় বড় রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রি। যেসব এলাকায় এ ধরনের ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে সেসব এলাকার অর্থনীতির মূল চাকা এই ইন্ডাস্ট্রিকেই কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এই শিল্প যেভাবে একদিকে অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে অন্যদিকে সমগ্র বাস্তুসংস্থানের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।
ইতিহাস
সম্পাদনাবিংশ শতাব্দী [২] পর্যন্ত জাহাজ ভাঙা শিল্পায়িত দেশগুলো যেমন আমেরিকা, ব্রিটেন এর মত দেশগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে এই শিল্প উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে, যার প্রধান কারণ হচ্ছে অল্প পারিশ্রমিক, সস্তায় কাচাঁমালের যোগান ইত্যাদি। নব্বই দশকের পরে এই শিল্প দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোসহ দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীনসহ সমগ্র উন্নয়নশীলে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
অর্থনীতিতে প্রভাব
সম্পাদনাবৈশ্বিক অর্থনীতিতে জাহাজ ভাঙা শিল্পের প্রভাব খুবই সুস্পষ্ট। বিশ্ববাজারে বর্তমানে ৪০ হাজার কোটি ডলারের বাজার উন্মুক্ত রয়েছে। এই বাজার ধরতে উন্নয়নশীল দেশগুলো এই শিল্পের দিকে মনোযোগী হচ্ছে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ভারতের এক কোম্পানী অ্যালাং ১৯৮২ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মোট ৩৮০০ টি [৩] মেয়াদ উত্তীর্ণ জাহাজ ভাঙ্গে যা গড়ে প্রায় ১৮১ টি। কিন্তু আশ্চার্যজনক ভাবে ঐ একই কোম্পানী ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত গড়ে প্রতি বছর ২৫০ টি জাহাজ ভাঙ্গে। এই ছোট একটি সমীক্ষা থেকে বুঝা যায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিতে এই শিল্পের প্রভাব কতটুকু।
জাহাজ ভাঙার পদ্ধতি
সম্পাদনাজাহাজ ভাঙার পদ্ধতি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের। উন্নত দেশগুলো জাহাজ ভাঙার পদ্ধতিতে নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করছে। কিন্তু ভারত, বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো এখনও পুরানো পদ্ধতিতে এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যার কারণে এসব দেশগুলোতে নিয়মিত বিরতিতে দুর্ঘটনা ঘটছে এবং প্রাণহানি ঘটছে। জাহাজ শিল্পের সাথে সংযুক্ত মেরিন ইনসাইট[৪] নামের একটি সংগঠন এর মতে বর্তমান বিশ্বে জাহাজ ভাঙার ১০টি [৫] প্রথা চালু রয়েছে। এই ১০টি পদ্ধতির মধ্যে সবচেয়ে যে পদ্ধতি জনপ্রিয় সেটি হচ্ছে সমুদ্র সৈকতে জাহাজকে টেনে এনে সেখানে ভাঙা। অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে এই পদ্ধতিটিকে আয়ত্ত করার প্রধান কারণে হচ্ছে স্বল্প খরচ এবং অধিক লোকবলের সরবেরাহের নিশ্চিয়তা। যদিও এই পদ্ধতির কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
পরিবেশের উপর প্রভাব
সম্পাদনাজাহাজ ভাঙা একটি অতি ঝুঁকিপূর্ন কাজ। উন্নত দেশগুলোতে এখন আর এই কাজটি এখন আর করা হয়না। কারণ নানা রকম বিষাক্ত উপাদান থাকে পুরানো এইসব জাহাজে। যেমন Asbestos এবং Polychlorinated Biphenyls। Asbestos দিয়ে লোহার উপর আস্তর দেয়া হয়। মানব দেহের জন্য হ্মতিকারক হওয়ায়, ৮০ দশকের মাঝামাঝিতে জাহাজ নির্মাণে Asbestos এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। উন্নত দেশে জাহাজ থেকে এই পদার্থ অপসারণ করতে হলে অনেক ঝামেলা। জাহাজ ভাঙার কিংবা কাটার সময় একধরনের বিষাক্ত নির্গত হয়। তার উপর রয়েছে asbestos মিশ্রিত ধুলা যা অতি সহজে মানব দেহের ফুসফুসে গিয়ে বড় ধরনের হ্মতি করতে পারে। পুরাতন জাহাজ থেকে মারাত্মক বিষাক্ত পারমাণবিক বর্জ্য, বিষাক্ত রাসায়নিক, টক্সিন, প্রাণঘাতি যৌগ ডাম্প করা হয় সমুদ্রে যা সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার সমুদ্র বাস্তুসংস্থানের চরম পর্যায়ের ক্ষতি সাধন করছে।[৬]
বিশ্বময়ী জাহাজ ভাঙার দেশগুলো
সম্পাদনাবর্তমানে জাহাজ ভাঙা শিল্প দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যেমন ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, চীন, তুর্কি এই পাঁচটি দেশ বিশ্বের পরিত্যক্ত জাহাজের প্রায় ৭০-৮০ ভাগ [৭] জাহাজ রিসাইক্লিং করার জন্য নিয়ে আসে। এই থেকে বুঝা যায় এশিয়ার দেশগুলোতে এই শিল্পের প্রভাব কতটুকু। যে যে দেশগুলো এই সব পরিত্যক্ত জাহাজ ভাঙা শিল্পের সাথে যুক্ত তাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে তুলে ধরা হল।
ভারত
সম্পাদনাদক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত জাহাজ ভাঙা শিল্পে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। জাহাজ রিসাইক্লিং এর আন্তর্জাতিক সম্মেলন এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায় ভারত ২০১১ সালে প্রায় ৮৫০৪৫১৭ টন [৮] আয়তনের জাহাজ ভাঙা হয়। যা পুরা বিশ্বে আর কেউ করতে পারেনি। জাহাজ ভাঙা শিল্পে এশিয়ার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানটি ভারতেই অবস্থিত যার নাম অ্যালাং। এটি ভারেতের গুজরাটে অবস্থিত। প্রায় ১০ কি:মি: সমুদ্র তীর নিয়ে এটি ১৯৮৩ সাল [৯] থেকে তার পথ চলা শুরু করে। জোয়ার-ভাটা, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জলবায়ুর অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্যই অ্যালাং আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ
সম্পাদনা১৯৬০ সালের[১০] শুরুতে গ্রীক জাহাজ এমডি আলপাইন নামক একটি জাহাজ বাংলাদেশের চট্টগ্রামের এক সমুদ্র সৈকতে বিকল হয়ে পড়ে। ঐ জাহাজটিকে এলাকার মানুষ ও চট্টগ্রাম স্টিল মিলের শ্রমিক একত্রিত হয়ে রশি দিয়ে টেনে সমুদ্র তীরে নিয়ে আসে। বিভিন্ন নির্মাণ কাজে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করার লক্ষ্যে জাহাজটিকে ভাঙার মাধ্যমে বাংলাদেশ এক নতুন শিল্পে প্রবেশ করে।
২০০৪-২০০৯ এই পাঁচ বছর বাংলাদেশ জাহাজ ভাঙাতে বিশ্বে প্রথম স্থানে[১০] ছিল। ২০১২ সালে দ্বিতীয় স্থান দখল করে। বাংলাদেশের স্থানীয় রড এবং ইস্পাতের বাজার সর্ম্পূণভাবে এই শিল্পের উপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশের জাহাজ শিল্প মূলত চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে জাহাজ শিল্পের অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এই শিল্পের সাথে প্রায় ৫০ হাজার [১০] মানুষ সরাসরিভাবে জড়িত এবং প্রায় ২ লক্ষ মানুষ পরোক্ষভাবে এই শিল্পের সাথে জড়িত। এসব প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকেরা স্থানীয় ঠিকাদার দ্বারা জাহাজ থাকা ভিত্তিতে নিয়োগ হয়ে থাকে। অর্থাৎ এরা অন্থায়ীভাবে নিয়োগ লাভ করে।
এছাড়া ও চট্টগ্রাম এর সীতাকুন্ডে জাহাজ ভাঙা শিল্পের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে স্থানীয় হাজারের অধিক ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব্যবসায়ীরা।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
সম্পাদনাজাহাজ ভাঙা শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। এই শিল্পকে আরো এগিয়ে নেয়ার জন্য মালিক, শ্রমিক ও সামজিক নিরাপত্তা বিষয়ক সংস্থাগুলোকে একত্রিত হয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার দিকে কতৃপহ্মকে নজর দিতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে সম্পূর্ণ নিশ্চিত করতে হবে জাহাজের পরিবেশ নিরাপদ কিনা।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ END OF THE SHIP - The Human Cost of Breaking Ships (পিডিএফ)। Greenpeace International। পৃষ্ঠা 7। আইএসবিএন 90-73361-88-5।
- ↑ "History and transition"। https://en.wiki.x.io।
|ওয়েবসাইট=
এ বহিঃসংযোগ দেয়া (সাহায্য) - ↑ problems and prospects। shipbreaking in the developing world (পিডিএফ)। Petrer Rousmaniere and Nikhil Raj। পৃষ্ঠা 361, 362।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "Marine Insight"। www.marineinsight.com/।
- ↑ "10 Types of Ship Disposal Techniques"। www.marineinsight.com।
- ↑ Environmental pollution। "SHIP BREAKING INDUSTRY AND ITS IMPACT"। www.ukessays.com।
- ↑ "SHIP BREAKING IN BANGLADESH"। www.shipbreakingbd.info। YPSA। ২২ মার্চ ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ ডিসেম্বর ২০১৪।
- ↑ HTML SHIP RECYCLING MARKETS AND THE IMPACT OF THE HONG KONG CONVENTION
|ইউআরএল=
এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)। Dr Nikos Mikelis, Non-executive director, GMS। পৃষ্ঠা 6।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ] - ↑ "Demolition statistics"। www.shipbreakingbd.info। ২২ মার্চ ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ ডিসেম্বর ২০১৪।
- ↑ ক খ গ "SHIP BREAKING IN BANGLADESH"। shipbreakingbd.info। ২২ মার্চ ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ ডিসেম্বর ২০১৪।