জাতীয় বাংলা সম্মেলন
জাতীয় বাংলা সম্মেলন (সংক্ষেপেঃ জেবিএস) হলো কলকাতায় অবস্থিত একটি বাংলা জাতীয়তাবাদী সংগঠন। এটি পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী বাঙালিদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার সুরক্ষার লক্ষ্যে নির্মিত হয়। কর্ণাটক রক্ষণ বেদিকে-র মতো একাধিক কর্ণাটক ও তামিল নাড়ু ভিত্তিক অধিকার গোষ্ঠীগুলির আদলেই জাতীয় বাংলা সম্মেলনকে তৈরি করা হয় তথা এই সংগঠনের কার্যপ্রণালীও ঐ সমস্ত অধিকার গোষ্ঠীগুলির থেকে অনুপ্রাণিত।[১]
সংগঠনটির কালিম্পং জেলা বাদে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলায় সক্রিয় সদস্য রয়েছে। জাতীয় বাংলা সম্মেলন প্রায়শই পশ্চিমবঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিয়েছে যার জন্য সংগঠনটির উপর অনেকেই আঞ্চলিকতাবাদীর তকমা দাগিয়েছে।[২]
সংক্ষেপে | জেবিএস |
---|---|
নীতিবাক্য | জয় বাংলা |
পূর্বসূরী | বাংলা পক্ষ |
গঠিত | ৯ ডিসেম্বর ২০১৯ |
প্রতিষ্ঠাতা | সিদ্ধব্রত দাস, অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তন্বী দাস |
সদরদপ্তর | কলকাতা, ভারত |
সদস্যপদ | ৯০০ জন নিবন্ধিত সদস্য |
দাপ্তরিক ভাষা | বাংলা |
অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি | শমিত সান্যাল |
ইতিহাস
সম্পাদনাবাংলা পক্ষ নামে একটি বৃহত্তম বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগঠন হতে বিভক্ত হওয়ার পর ২০১৯ সনের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় বাংলা সম্মেলন আত্মপ্রকাশ করে। এর বেশিরভাগ সদস্যই পূর্বে বাংলা পক্ষের অংশ ছিলেন।[৩] জাতীয় বাংলা সম্মেলন এবং এইজাতীয় অন্যান্য কয়েকটি সংগঠনের স্থাপনা ২০১৮ সালের শেষাংশে পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থানের সময়ে সংঘটিত হয়। জেবিএস তথা বাংলা পক্ষ উভয়ই যেসকল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় সেগুলির মধ্যে মূল যুক্তিটি ছিল বাংলায় বলপূর্বক হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া এবং "উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতি"কে ঠেকানো। এগুলির, দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে ইতিমধ্যেই উপস্থিত বিভিন্ন অনুরূপ সংস্থা এবং গোষ্ঠীর এজেন্ডার সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে।[৪][৫] করোনাভাইরাস মহামারী চলাকালীন জাতীয় বাংলা সম্মেলন সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলির সাহায্যে দেশের বিভিন্ন কোনায় আটকে পড়া বাংলার পরিযায়ী তাঁতের শাড়ি বিক্রেতাদের রেশন এবং প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করার ব্যবস্থা করে।[৬][৭]
প্রতিবাদসমূহ
সম্পাদনানাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
সম্পাদনাজাতীয় বাংলা সম্মেলন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। ২০২০ সালের কলকাতা বইমেলায় এই আইনের বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভ কর্মসূচি চলাকালীন বিভিন্ন গোষ্ঠির সদস্যদের মাঝে বইমেলা প্রাঙ্গনে ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়। জাতীয় বাংলা সম্মেলন অভিযোগ করে যে তারা যখন মেলায় লিফলেট বিতরণ করছিলেন তখন নাকি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মীরা তাদের সদস্যদের উপর হঠাৎই চড়াও হয়ে আক্রমণ করে।[৮]
কলকাতার হ্রদগুলিতে ছট পূজার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
সম্পাদনা২০২০ সালে, জাতীয় বাংলা সম্মেলনের সদস্যরা রবীন্দ্র সরোবর এবং সুভাষ সরোবর এই দুটি পরিবেশগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হ্রদে ছট পূজা করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। সংগঠনটি কাউকে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে বাধা দিতে হ্রদের বিভিন্ন প্রবেশপথগুলিতে রাতভর নজরদারি চালায়। জাতীয় সবুজ ট্রাইব্যুনাল (এনজিটি) দ্বারা অতীতে এই হ্রদগুলিতে যেকোনো প্রকারের উৎসব পালন করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যদিও পশ্চিমবঙ্গ সরকার এনজিটি-র কাছে রবীন্দ্র সরোবরে ছট পূজা করার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিল, কিন্তু এই আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। রাজ্য সরকার পরবর্তীতে এনজিটি-র রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলেও সুপ্রিম কোর্টও রাজ্য সরকারকে কোনও ছাড় দেয়নি। এর আগের বছর হাজার হাজার ভক্তরা হ্রদে প্রবেশ করে পূজা করেছিলেন এবং সেখানে কলকাতা পুলিশের কর্মকর্তাদের এনজিটির আদেশ প্রয়োগে অনীহা প্রকাশ করতে ও তাদেরকে হ্রদ চত্বরের বাইরে অলসভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাওয়ার কারণেই জাতীয় বাংলা সম্মেলন এনজিটি-র আদেশ কার্যকর করার জন্য নিজেরাই দায়িত্বগ্রহণ করে। [৯]
হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
সম্পাদনাজেবিএস কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় শিক্ষা, চাকরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কেন্দ্রসরকার দ্বারা হিন্দি-চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। সংগঠনটি হিন্দি আগ্রাসন ঠেকাতে নিজেরা বিভিন্ন সমাবেশ, মিছিল আয়োজিত করেছে এবং আরো একগাদা বিক্ষোভকর্মসূচিকে সমর্থন করেছে। এই বিক্ষোভগুলির প্রধান উদ্দেশ্য পশ্চিমবঙ্গবাসী বাঙালিদের উপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া, কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি এবং পশ্চিমবঙ্গ সংস্কৃতির প্রতি হামলাকে প্রতিরোধ করা।[১০] [১১]
জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড
সম্পাদনাকোভিড কমিউনিটি রান্নাঘর
সম্পাদনাকোভিড -১৯ মহামারীর দ্বিতীয় তরঙ্গের জেরে বহু লোকে চাকরিহারা হয়ে যাওয়ায় জাতীয় বাংলা সম্মেলন পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে জয় বাংলা ক্যান্টিন নামে ছয়টি কমিউনিটি রান্নাঘর চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ১৭ই মে, ২০২১ থেকে এটি কলকাতা জেলার গড়িয়াহাট এবং ভবানীপুর, হাওড়া জেলায় হাওড়া স্টেশন, হুগলি জেলার চণ্ডীতলা, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এগরা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার মৌসুনি দ্বীপে কমিউনিটি রান্নাঘর পরিচালনা করে। কলকাতায় রান্নাঘরটি গড়িয়াহাট থানার পাশে একটি গেস্টহাউসে অস্থায়ী চালানো হয়। পর্যাপ্ত তহবিলের অভাবে ২০২১ সালের জুলাই মাসে কমিউনিটি রান্নাঘরটি বন্ধ হয়ে যায়।[১২]
কলকাতায় বিনামূল্যে বাস পরিষেবার উদ্যোগ
সম্পাদনাকরোনা ঠেকাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন বিধিনিষিধের ফলে কলকাতায় ট্রেন, মেট্রো ও বাস বন্ধ থাকে। এ-তে গাড়ির ব্যবস্থা না পাওয়া তথা নিজেদের দুই বা চার চাকা না থাকা সরকারী, বেসরকারী চাকুরিজীবী ও ছাত্রছাত্রীদের মতো নিত্যযাত্রীদের চূড়ান্ত সমস্যায় পড়তে হয়। তাঁদের কথা ভেবে জাতীয় বাংলা সম্মেলন ১লা জুলাই, ২০২১ থেকে বিনামূল্যে 'জয় বাংলা বাস পরিষেবা' শুরু করে। প্রথম পর্যায়ে তিনটি রুটে এই পরিষেবা শুরু হয়ঃ ১) হাওড়া ময়দান থেকে মহাত্মা গান্ধি রোড, শোভাবাজার হয়ে চিড়িয়ামোড়, ২) হাওড়া ময়দান থেকে ধর্মতলা, শিয়ালদা, বেলেঘাটা, করুণাময়ী হয়ে সেক্টর ফাইভ এবং ৩) সেক্টর ফাইভ থেকে উল্টোডাঙ্গা, গিরীশ পার্ক, এক্সাইড মোড়, খিদিরপুর, মোমিনপুর, হাজরা, রাজবিহারী হয়ে গড়িয়াহাট, যাদবপুর, বৈষ্ণবঘাটা পর্যন্ত। পরে, শহরে জয়েন্ট পরীক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে আটটি রুটে এই বিনামূল্যে বাস পরিষেবা বাড়ানো হয়।[১৩][১৪][১৫]
সমালোচনা
সম্পাদনাজেবিএস তাদের কাজকর্মের ক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক এবং আঞ্চলিকতাবাদী বলে অনেক সময় সমালোচিত হয়েছে। সংগঠনটির বিরুদ্ধে এও অভিযোগ রয়েছে যে সেটি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠ যদিও জাতীয় বাংলা সম্মেলন আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেকে অরাজনৈতিক বলেই দাবি করে। সংগঠনের কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে রেলওয়ে স্টেশনের সাইনবোর্ডে কালো কালি লেপে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।[১৬]
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "Bengal sees rise of subnationalism ahead of assembly elections"। The Economic Times। আগস্ট ১৭, ২০২০।
- ↑ "TMC stokes Bengali pride calls BJP outsiders, BJP hits back"। Outlook India। ২০ নভেম্বর ২০২০।
- ↑ "বাংলা পক্ষে ভাঙন, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অভিযোগ এনে তৈরি হল পৃথক সংগঠন"। Anandabazar Patrika। ডিসেম্বর ১০, ২০১৯।
- ↑ "'Bengali Pride' to be TMC's main poll plank to counter BJP's aggressive Hindutva"। The Economic Times। নভেম্বর ৩০, ২০২০।
- ↑ "स्थानीय बनाम बाहरी का मुद्दा, बंगाल में विधानसभा चुनाव के पहले बंगाली अस्मिता का उभार"। Dainik Jagran (হিন্দি ভাষায়)। ১৭ আগস্ট ২০২০।
- ↑ "Migrants stuck over rent dues"। www.telegraphindia.com। ৫ মে ২০২০।
- ↑ "TMC stokes Bengali pride calls BJP outsiders, BJP hits back"। Outlook India। ২০ নভেম্বর ২০২০।
- ↑ Staff, Scroll (৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০)। "CAA: Several detained after scuffle at Calcutta Book Fair, mob beats up police officer"। Scroll.in।
- ↑ "Bengali Ethnic Groups Set Up Vigils, Prevent Chhath Puja In Kolkata's Lakes"। Outlook India। ২১ নভেম্বর ২০২০।
- ↑ "बंगाल की विकट जंग, ममता- मोदी में किसका दांव पड़ेगा भारी"। Outlook Hindi (হিন্দি ভাষায়)। ১৩ জানুয়ারী ২০২১।
- ↑ Desk, Bengali (৮ সেপ্টেম্বর ২০২০)। "শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে মশাল মিছিল জাতীয় বাংলা সম্মেলনের"। Kolkata24x7 | Read Latest Bengali News, Breaking News in Bangla from West Bengal's Leading online Newspaper। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ এপ্রিল ২০২১।
- ↑ "Calcutta community kitchen to shut as funds dry up"। www.telegraphindia.com। ১৪ আগস্ট ২০২১।
- ↑ "শহরে এবার বিনামূল্যে বাস পরিষেবা, কীভাবে বুক করবেন? জানুন"। EI Samay। ২ জুলাই ২০২১।
- ↑ "জয়েন্ট পরীক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে বাস পরিষেবা, কোন রুটে-কখন বাস চলবে, দেখুন"। Hindustantimes Bangla। ১৬ জুলাই ২০২১।
- ↑ "আজ জয়েন্ট পরীক্ষার্থীদের সুবিধার্থে বিনামূল্যে বাস পরিষেবা"। ETV Bharat News। ১৭ জুলাই ২০২১।
- ↑ Mali, Amit (২৩ ডিসেম্বর ২০২০)। "পাল্টা মার খাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাই হিন্দিভাষীরা বিদ্বেষের শিকার"। Hindu Voice। ৫ মার্চ ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ এপ্রিল ২০২১।