জন ক্লার্ক মার্শম্যান

ইংরেজ ঐতিহাসিক

জন ক্লার্ক মার্শম্যান (১৮ আগস্ট ১৭৯৪ - ৮ জুলাই ১৮৭৭ খ্রিঃ) ছিলেন একজন ইংরেজ সাংবাদিক ও ঐতিহাসিক। শ্রীরামপুর ত্রয়ীর অন্যতম জোশুয়া মার্শম্যান তার বাবা।

প্রথম জীবন

সম্পাদনা

জন ছিলেন জোশুয়া ও হ্যানা মার্শম্যানের প্রথম সন্তান। তিনি ১৭৯৪ খ্রিঃ আগস্ট মাসে ব্রিস্টল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ধর্মপ্রচারক হিসেবে ভারতে রওয়ানা হওয়ার আগে ঐ অঞ্চলে একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন।

 
জন ক্লার্ক মার্শম্যান

ভারতে আগমন

সম্পাদনা

পাঁচ বছর বয়সে জন তার মা, বাবা ও উইলিয়াম ওয়ার্ডের সাথে ক্রাইটেরিয়ন নামক মার্কিন জাহাজে চড়ে বঙ্গে রওনা হন। ১৩ই অক্টোবর ১৭৯৯, রবিবার সকালে তারা শ্রীরামপুরে পৌঁছান।

১৮০০ খ্রিঃ জনের মা ও বাবা শ্রীরামপুরে দু'টো বোর্ডিং স্কুল স্থাপন করেন। স্কুল দু'টো অত্যন্ত জনপ্রিয় হয় এবং জন তার মা-বাবার কাছেই শিক্ষালাভ করেন। ক্রমশ প্রসারশীল মিশনারি জীবনের সাথে তিনি একাত্ম হয়ে বড় হন; সবার সাথে এক টেবিলে খাওয়াদাওয়া আর মিশনের অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলো ছিল তার রোজনামচার অঙ্গ। স্বাভাবিকভাবেই তিনি খুব ভালো করে বাংলা শিখে যান।

কর্মজীবন

সম্পাদনা

১৮১৮ খ্রিঃ জন ক্লার্ক মার্শম্যান তার বাবার সাথে যৌথভাবে দিগ্‌দর্শন নাম দিয়ে প্রথম বাংলা মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটির উপজীব্য বিষয় ছিল যুবসমাজের প্রতি শিক্ষামূলক উপদেশ। এর খুব অল্প সময় পরেই তারা সমাচার দর্পন নামে একটি সাপ্তাহিক সংবাদ-পত্রিকা প্রকাশনা শুরু করেন, যা ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দের প্রথমার্ধে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য্য সম্পাদিত বেঙ্গল গ্যাজেটি এর সাথে যুগ্মভাবে বাংলার সর্বাপেক্ষা পুরোনো সংবাদপত্রের গৌরব দাবি করে। এর পর শ্রীরামপুর মিশন ১৮২১ খ্রিঃ ফ্রেণ্ড অফ ইণ্ডিয়া (ভারতের বন্ধু) নামে একটি ইংরেজি পত্রিকাও প্রকাশ করতে থাকে যেটি এত জনপ্রিয় হয় যে ঊনবিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ সময় জুড়ে ইউরোপীয়দের মনে 'শ্রীরামপুর' আর 'ফ্রেণ্ড অফ ইণ্ডিয়া' কথা দু'টো সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মিশনের ছাপাখানার কাজকর্ম এত সফল এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে ওঠে যে হুগলি নদীর তীরে মিশনের গির্জার ঠিক উত্তরে ছাপাখানার জন্য আলাদা বাড়ি বানাতে হয়েছিল।

১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রেণ্ড অফ ইণ্ডিয়া আরও একটি সংবাদপত্র দ্য ইংলিশম্যান এর সাথে সংযুক্ত হয়ে দ্য স্টেট্‌স্‌ম্যান পত্রিকার জন্ম দেয়, যা আজ পর্যন্ত ভারতের অন্যতম মুখ্য ইংরেজি সংবাদপত্র।

স্থানীয় উইপোকার উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শ্রীরামপুর মিশনের মিশনারিরা বিশেষ এক প্রকার কাগজ প্রস্তুত করেছিলেন। জন ক্লার্ক মার্শম্যান এই কাগজের বাণিজ্যিক উৎপাদনের সুবিধার জন্য একটি কাগজের কল স্থাপন করেন। এই কাগজকে বলা হত 'শ্রীরামপুর কাগজ' আর সংলগ্ন বহু অঞ্চলে এর ব্যবহার চালু হয়।

উক্ত কাগজ কলের জন্য জন মার্শম্যান ১৮২০ খ্রিঃ ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ারের থোয়েটস্ অ্যান্ড রথওয়েল কোম্পানি থেকে ভারতে প্রথমবার বাষ্পীয় ইঞ্জিন আমদানি করান। জানা যায় জোশুয়া মার্শম্যান যন্ত্রটি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

১৮২১ খ্রিঃ জন ক্লার্ক মার্শম্যান শ্রীরামপুর কলেজে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন।

১৮৩৭ খ্রিঃ 'শ্রীরামপুর ত্রয়ীর' শেষ সদস্য জোশুয়া মার্শম্যান মারা যান। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে এবং জন ম্যাকের পক্ষে কলেজ ও মিশনের সমস্ত কাজকর্ম চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের সমস্ত উপার্জন ও কাগজ কল প্রভৃতি থেকে জন মার্শম্যানের ব্যক্তিগত উপার্জনের অর্থও মিশনের কাজে ব্যবহার করা হয়। জন স্থির করেন যে ফ্রেণ্ড অফ ইণ্ডিয়া প্রকাশনার দায়িত্ব কলেজ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। হিসেব অনুযায়ী এই সমস্ত কাজে তার মোট ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৩০,০০০ পাউণ্ডের বেশি।

কলেজ চালানোর খরচ ক্রমশ বেড়ে যাওয়ায় ম্যাক ও মার্শম্যান ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটিকে কলেজের দায়িত নিতে অনুরোধ করেন। সোসাইটি পুরোপুরি সেই অনুরোধ স্বীকার না করলেও একজন ধর্মীয় অধ্যাপকের খরচ বহন করতে সম্মত হয়।

পরবর্তীকালে জন মার্শম্যান অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভারতের সরকারি বাংলা অনুবাদকের পদে নিযুক্ত হন, এবং এর পর প্রায় দৈনিকভাবে দেশী সংবাদপত্রগুলোতে তাকে "সরকারের ভাড়াটিয়া" ইত্যাদি বলে গালি দেওয়া হতে থাকে। তার বার্ষিক ১০০০ পাউণ্ড বেতন কলেজে দিয়ে দেওয়া হত।

ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তন

সম্পাদনা

১৮৫৫ খ্রিঃ জন মার্শম্যান স্থির করেন ভারত ছেড়ে গেলেই তার মঙ্গল। তিনি এবং ম্যাক আবার ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটিকে কলেজের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। তাদের অনুরোধ এইবার স্বীকৃত হয়। মার্শম্যান সরকারি বাংলা অনুবাদকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ইংল্যান্ডের কেনসিংটন প্যালেস গার্ডেন্সে ফিরে আসেন।

জন ক্লার্ক মার্শম্যান ভারতের ইতিহাসের একজন ছাত্র ছিলেন এবং তার রচিত বাংলার ইতিহাস অনেক দিন পর্যন্ত ঐ বিষয়ে লেখা একমাত্র বই ছিল। ভারতের ইতিহাসের নানা বিবরণী লেখার কাজেও তিনি জড়িত ছিলেন। তার পড়াশোনার পরিধি ছিল অনেক দূর বিস্তৃত এবং তিনি প্রাচ্যবাদ সম্পর্কে একজন বিশিষ্ট জ্ঞানী ছিলেন। তার বাবার মতো তিনিও চীনা ভাষা জানতেন এবং প্রধান প্রধান সংস্কৃত কাব্যগুলিও তার জানা ছিল। ফার্সিতেও তার আগ্রহ ছিল।

ইংল্যান্ডে ফেরার পর অবশ্য তিনি ভারত সংসদে বসার প্রস্তাব খারিজ করে দেন। শিক্ষাক্ষেত্রে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৮৬৮ খ্রিঃ তাকে স্টার অফ ইণ্ডিয়া পদক দ্বারা সম্মানিত করা হয়। জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি ইস্ট ইণ্ডিয়ান রেলওয়ের কমিটি অফ অডিটের চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণ করেন। তিনি তিন বার ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য ব্যর্থ চেষ্টা করেন; ইপ্‌স্‌উইচ থেকে ১৮৫৭ খ্রিঃ এবং হারউইচ থেকে ১৮৫৯ ও ১৮৬১ খ্রিঃ।

বলা হয় জন ক্লার্ক মার্শম্যান মৃত্যুর সময় ভারতের অবস্থা সম্পর্কে পরপর চার জন ভাইসরয়ের ব্যক্তিগত কোনো সহকারীর সমান জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। ৮ই জুলাই ১৮৭৭ খ্রিঃ উত্তর কেনসিংটনের র‍্যাডক্লিফ স্কোয়ারে তার মৃত্যু হয়।

জন ক্লার্ক মার্শম্যান এছাড়াও 'মার্শম্যান্'স্ গাইড টু দ্য সিভিল ল অফ দ্য প্রেসিডেন্সি অফ ফোর্ট উইলিয়াম' নামে একটি বই প্রকাশ করেন, যা সম্ভবত সর্বকালের অন্যতম লাভজনক আইনের বইয়ের মর্যাদার দাবিদার।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  • সুনীল চ্যাটার্জী, "জন ক্লার্ক মার্শম্যান"