জগন্নাথ কিশোর কলেজ
জগন্নাথকিশোর কলেজ বা জে কে কলেজ পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার একটি কলেজ। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজটিই পুরুলিয়ার জেলার প্রথম আধুনিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এই কলেজ সিধো কানো বিরসা বিশ্ববিদ্যালয় অধীনস্থ। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই কলেজটিকে পুরুলিয়ার জেলার লিড কলেজ বা নেতৃ-কলেজ ঘোষণা করেছেন।
ইতিহাস
সম্পাদনাব্রিটিশ আমলে পুরুলিয়া অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার কোনও ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। সেই কারণে পুরুলিয়া সহ তৎকালীন মানভূম জেলা শিক্ষায় একটি পশ্চাৎপদ জেলা হিসাবে বিবেচিত হত। স্বাধীনতার পর জহরলাল বসু, যতীন দত্ত, শ্যামসুন্দর সিংহমহাপাত্র, ধীরেন ভট্টাচার্য, জগদীশ মুখোপাধ্যায়, অশোক চৌধুরী, মন্মথ কুইরি প্রমুখ জেলার শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ উচ্চশিক্ষাকল্পে জেলায় একটি কলেজ স্থাপনের চিন্তাভাবনা শুরু করেন। এইসময় কাশীপুর পঞ্চকোট রাজপরিবারের রাজমাতা গোকুলকুমারী দেবী এককালীন এক লক্ষ টাকা অর্থসাহায্য দান করে জেলাবাসীর কলেজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করেন। সেই কারণে তারই প্রয়াত স্বামী জগন্নাথকিশোর সিংহদেওয়ের নামে উৎসর্গিত হয়ে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জেলার প্রথম মহাবিদ্যালয় জগন্নাথকিশোর কলেজ। বর্তমান কলেজের জন্য জমির কিয়দংশ দান করেছিলেন নওয়াগড়ের রাজা ও কিয়দংশ কেতিকার শশধর চৌধুরীর দেওয়া। ঠক্করবাষ্পা আদিবাসী ছাত্রাবাস ও চিত্তরঞ্জন মাহাত ছাত্রাবাসের জমি দান করেন ডুংরার রাজা। কেনা হয় সৈনিক স্কুলের সামনের কিছু অংশ, আবার কিছুটা দান করা হয় কলেজকে। এছাড়া পুরুলিয়ার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শঙ্করলাল সিংহানিয়া এককালীন ষোলো হাজার টাকা দান করেছিলেন।
এরপর একটি কার্যকরী সমিতি গঠিত হয় কলেজ নির্মাণের জন্য। জগদীশ মুখোপাধ্যায় হন এই সমিতির সভাপতি, ধীরেন ভট্টাচার্য সহ-সভাপতি ও মানভূম ভিক্টোরিয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক জহরলাল বসু হন এর সম্পাদক। পরবর্তীকালে সম্পাদকের পদে আবৃত হয়েছিলেন শ্যামসুন্দর সিংহমহাপাত্র।
পটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আই এ ক্লাস দিয়ে কলেজের পড়াশোনা শুরু হয়। নিজস্ব ভবন না থাকায় সেই সময় ক্লাস নেওয়া হত হরিপদ সাহিত্য মন্দির, উইনিয়ন ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্কুল – ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের ভবনে। তবে শুরু থেকেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এই কলেজ। শুধু পুরুলিয়া অঞ্চলই নয়, রাঁচি, হাজারিবাগ, বাঁকুড়া, বর্ধমান এমনকি পটনা ও কলকাতা থেকেও শিক্ষার্থীরা আসতে থাকেন এই কলেজে পঠনপাঠন করার জন্য। প্রথম বছরের ছাত্র ভর্তির সংখ্যা স্পর্শ করে ১০৯।
১৯৪৮ সালের ২২ জুলাই কলেজের প্রথম ক্লাস আরম্ভ হয়। দর্শনের অধ্যাপক ধীরেন মুখোপাধ্যায় কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হিসাবে যোগ দেন। অত্যন্ত আদর্শবাদী ধীরেনবাবু ছিলেন পূর্ববঙ্গ নিবাসী এক স্বাধীনতা সংগ্রামী ও যুগান্তর পার্টির সঙ্গে যুক্ত। ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি, সিভিক্স, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন যথাক্রমে নরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নন্দদুলাল রায় (বাংলা, সংস্কৃত ও সংগীতে এমএ) শচীন্দ্রনাথ সেন, বৈদ্যনাথ কর ও আনন্দকুমার দাঁ। ১৯৪৯ সালে যোগ দেন দর্শনের কমলেশ ঘোষ ও ইংরেজিতে সুবোধ বসুরায়। এই সময় একজন শিক্ষকের অধীনে কলেজে একটি উর্দু বিভাগও ছিল। কিন্তু পরে ছাত্রাভাবে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতা সংগ্রামী ও কলেজ অন্ত প্রাণ শশাঙ্কশেখর রায় ছিলেন অফিসের বড়বাবু আর অমর চৌধুরী (গদাইদা নামে পরিচিত) ছিলেন অ্যাকাউন্টেন্ট। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন বলাই মাহাত, গুহিরাম সিং ও ননীগোপাল দে। একটি আলমারি নিয়ে গ্রন্থাগারিকের পদে যোগ দেন লালগোপাল মজুমদার। এঁদের সকলের বেতন ছিল সামান্য ও অনিয়মিত। বিহার সরকারের কাছ থেকে কোনো সরকারি সাহায্যও মিলত না। তবু এঁদের ঐকান্তিক নিষ্ঠা কলেজটিকে একটি স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করে।
ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ও ছাত্রীরাও কলেজে যোগ দিতে থাকায় কলেজের একটি নিজস্ব ভবনের প্রয়োজন হয়। ১৯৫৩ সালে বিহার সরকারের অর্থমন্ত্রী অনুগ্রহণারায়ণ সিং কলেজের বর্তমান কেতিকাস্থ ভবনটি উদ্বোধন করেন। এরপর পটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হয় এই কলেজ। ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর পুরুলিয়া জেলা পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হলে কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ হয়। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৯৬১ সালে জগন্নাথকিশোর কলেজ উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়।
বর্তমান ব্যবস্থা
সম্পাদনাবর্তমানে কলা ও বিজ্ঞান বিভাগের আঠারোটি বিষয়ে এই কলেজে অনার্স বা স্নাতক স্তরের পঠনপাঠন চলে। এছাড়া, বাণিজ্য বিভাগে অ্যাকাউন্টেন্সিতে অনার্স ও গণিতে এমএ/এমএসসি পড়ানো হয়ে থাকে। ছাত্র ও ছাত্রীর বর্তমান সংখ্যা ২২০০-এর কাছাকাছি। দূরশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষালাভের জন্য এই কলেজে ইন্দিরা গান্ধী জাতীয় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অধ্যয়ন কেন্দ্র আছে। ছাত্রছাত্রীদের স্বনির্ভর করে তোলার লক্ষ্যে নানান কর্মমুখী কোর্সও পড়ানো হয়ে থাকে এখানে। সাংসদ বীর সিং মাহাতর অর্থসাহায্যে বিগত দশককালে কলেজটি অভূতপূর্ব উন্নতিলাভ করেছে। তৈরি হয়েছে একটি আদিবাসী ছাত্রাবাস সমেত আরও দুটি ছাত্রাবাসও। ন্যাকের মূল্যায়নেও কলেজটি জেলার প্রথম সারির কলেজ।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- শ্রীনিবাস মিশ্র, প্রবন্ধ পুরুলিয়া জেলার উচ্চশিক্ষা : পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা, পুরুলিয়া জেলা সংখ্যা, জ্যৈষ্ঠ-বৈশাখ, ১৪১৪ (জুন ২০০৭), তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার