চেরনোবিলের বিপর্যয়

বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক পারমাণবিক বিপর্যয়

তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২৬শে এপ্রিল, ১৯৮৬ তারিখে সংঘটিত ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনাটি চেরনোবিলের বিপর্যয় হিসাবে পরিচিত। ৩১ জন লোক প্রান হারান। ৩ লক্ষ ৪০ হাজার জন লোক আক্রান্ত হন।চেরনোবিল বর্তমান ইউক্রেনের অন্তর্ভূত। এই পারমাণবিক দুর্ঘটনাকে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ও বিপর্যয় হিসেবে গণ্য করা হয়।

চেরনোবিলের বিপর্যয়
বিপর্যয়ের পর নিউক্লিয়ার পারমাণবিক চুল্লী। পারমাণবিক চুল্লী ৪(কেন্দ্রে)। টারবাইন ভবন (নীচদিকে বামে)। পারমাণবিক চুল্লী ৩ (কেন্দ্রে ডানে)।
তারিখ২৬ এপ্রিল ১৯৮৬ (1986-04-26)
সময়০১:২৩ (মস্কো সময় ইউটিসি+৩)
অবস্থানপৃপিয়াত, ইউক্রেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন
কারণএকটি পরীক্ষা চলাকালে পারমাণবিক চুল্লীতে জরুরী বন্ধ করার কালে অসতর্ক বিস্ফোরণ
নিহত৩১ (সরাসরি)
জেনেভায় নিউক্লিয়ার-বিরোধী পাওয়ারের প্রতিবাদে মৃত অবসায়কদের প্রতিমূর্তি
অবস্থান

দুর্ঘটনা

সম্পাদনা

চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট পারমাণবিক চুল্লীর সংখ্যা ছিল ৪টি। ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল স্থানীয় সময় অনুযায়ী রাত ১টা ২৩ মিনিটে ইউক্রেন ও বেলারুশ সীমান্তে অবস্থিত পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির[] চতুর্থ পারমাণবিক চুল্লী থেকেই দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়। দুর্ঘটনাটি মূলত ঘটেছিলো নিরাপদ শীতলীকরণের ওপর একটি পরীক্ষা চালানোর সময়। রাতের শিফটে দায়িত্বরত কর্মীরা ভুল করে পারমাণবিক চুল্লীটির টার্বাইনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শীতল জল প্রবাহিত করে। ফলে সেখানে বাষ্প কম উৎপাদিত হয়। এতে করে পারমাণবিক চুল্লীটি উত্তপ্ত হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে।
পরপর প্রায় একই সঙ্গে সংঘটিত দুটি বিস্ফোরণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চতুর্থ পারমাণবিক চুল্লীর ওপরের প্রায় এক হাজার টন ওজনের কংক্রিটের ঢাকনা সরে যায় এবং ছাদ ভেঙে যাওয়ার ফলে এক বিশাল গহ্বরের সৃষ্টি হয়। দুর্ঘটনার ২০ ঘণ্টা পর [] বাইরের বাতাস ঢুকে পড়লে পারমাণবিক চুল্লীর দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে সেখানে বিরাট অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। এ আগুন ১০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এতে করে পারমাণবিক বিক্রিয়ায় তৈরি পদার্থ পরিবেশে প্রায় ১ কিলোমিটার উঁচু অবধি ছড়িয়ে পড়েছিল এবং প্রচুর পারমাণবিক ধুলো পরিবেশের ব্যাপক দূষণ ঘটিয়েছিল।[] পরিবেশে যে পরিমাণে পারমাণবিক পদার্থ নিক্ষিপ্ত হয়েছিল তা ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিক্ষিপ্ত প্রায় পাঁচশটি পারমাণবিক বোমার সমান। এই দুর্ঘটনার ফলে উদ্ভূত পারমাণবিক ভাবে সক্রিয় মেঘটি ইউক্রেন, বেলোরাশিয়া, রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে, গ্রেট ব্রিটেনে এমন কি পূর্ব আমেরিকার ওপর পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল।[]

দুর্ঘটনার কারণ

সম্পাদনা

দুর্ঘটনার জন্য কর্তব্যরত কর্মীদেরই দায়ী করা হয়ে থাকে। কিছু নিরাপত্তা ব্যবস্থা বন্ধ করা ছিলো এবং পারমাণবিক চুল্লীটি অনুপযুক্ত অবস্থায় চালানো হচ্ছিলো, যার ফলে শক্তি নির্গমন অতিরিক্ত হয়ে গিয়েছিল।[] আবার, একটি গবেষণায় বলা হয়েছে কর্মীদের রাতের শিফটে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। এ দৃষ্টিকোণ থেকে সার্বিক ব্যবস্থাপনাও দায়ী। একারণে ৩ জনকে ১০ বছরের শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল।

তবে বিস্ফোরণের পূর্বে কর্তব্যরত কর্মীরা উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারতো। তারা চুল্লীটি বন্ধ করে দিতে পারতো। কিন্তু পারমাণবিক চুল্লী বন্ধের এখতিয়ার তাদের ছিল না। যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চুল্লী বন্ধের নির্দেশ দিতে পারতেন এত রাতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার সাহসও নিযুক্ত কর্মীদের ছিল না। ফলে তাদের চোখের সামনেই দুর্ঘটনাটি অনিবার্য হয়ে ওঠে।

 
১৯৯৬ সালে চেরনোবিলের চারপাশে পারমাণবিক বিকিরণের মানচিত্র

পরিণতি

সম্পাদনা

ঘটনার সময় চেরনোবিলে প্রায় ১৪ হাজার বসতি ছিল। দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই ৪ জন কর্মী মারা যান। পরবর্তীতে ২৩৭ জন মানুষ পারমাণবিক বিকিরণের ফলে অসুস্থ হয়ে পরে এবং প্রথম তিন মাসে ৩১ জন মৃত্যুবরণ করে, যাদের অধিকাংশই উদ্ধারকর্মী[][]

সরকারি তথ্যমতে, দুর্ঘটনার কারণে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং তাদের মধ্যে ছিল ছয় লক্ষ শিশু। [] এই দুর্ঘটনার ফলে ক্ষতির পরিমাণ ২০০ বিলিয়ন ডলারের সমান বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।[] বর্তমানে চেরনোবিল শহরটি পরিত্যক্ত এবং প্রায় ৫০ মাইল এলাকা জুড়ে বলতে গেলে কেউ বাস করে না।

সিজিয়াম ১৩৭ দ্বারা দূষিত ইউরোপের অঞ্চল[]

সম্পাদনা
দেশ ৩৭–১৮৫ kBq/m ১৮৫–৫৫৫ kBq/m ৫৫৫–১,৪৮০ kBq/m > ১,৪৮০ kBq/m
কিমি দেশের শতাংশ কিমি দেশের শতাংশ কিমি দেশের শতাংশ কিমি দেশের শতাংশ
মলদোভা ৬০ ০.২
স্লোভেনিয়া ৩০০ ১.৫
ইতালি ৩০০ ০.১
গ্রিস ১,২০০ ০.৯১
সুইজারল্যান্ড ১,৩০০ ৩.১
বুলগেরিয়া ৪,৮০০ ৪.৩
নরওয়ে ৫,২০০ ১.৩
অস্ট্রিয়া ৮,৬০০ ১০.৩
ফিনল্যান্ড ১১,৫০০ ৩.৪
সুইডেন ১২,০০০ ২.৭
বেলারুশ ২৯,৯০০ ১৪.৪ ১০,২০০ ৪.৯ ৪,২০০ ২.০ ২,২০০ ১.১
ইউক্রেন ৩৭,২০০ ৬.২ ৩,২০০ ০.৫৩ ৯০০ ০.১৫ ৬০০ ০.১
রাশিয়া ৪৯,৮০০ ০.২৯ ৫,৭০০ ০.০৩ ২,১০০ ০.০১ ৩০০ ০.০০২
মোট ১৬২,১৬০ কিমি ১৯,১০০ কিমি

৭,২০০ কিমি ৩,১০০ কিমি

অবশিষ্ট তেজস্ক্রিয়তা

সম্পাদনা

চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং এর চারপাশের বর্তমান বিকিরণ স্তরের মানচিত্র

জলাশয়
সম্পাদনা
 
পারমাণবিক চুল্লী এবং এর আশেপাশের অঞ্চল, এপ্রিল ২০০৯

চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি প্রিপিয়াত নদীর পাশেই অবস্থিত, যা দনিপের জলাধারে মেশে, যা ইউরোপের অন্যতম বৃহত্তম জলাধার এবং কিয়েভের ২.৪ মিলিয়ন বাসিন্দাকে জল সরবরাহ করত।[১০]:৬০ জলজ ব্যবস্থার তেজস্ক্রিয় দূষণ তাই দুর্ঘটনার পরপরই একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।.[১১]

ইউক্রেনের সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলিতে দুর্ঘটনার পরে সপ্তাহ এবং মাসের মধ্যে পানীয় জলের তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।[১১] পানীয় জলে রেডিওডোডিনের মাত্রা নির্দেশিকা সাময়িকভাবে বর্ধিত করে ৩,৭০০ Bq/L করা হয়, যা বেশিরভাগ জলকে নিরাপদ হিসাবে প্রতিবেদন করে।[১১] সরকারিভাবে বলা হয়েছিল যে সমস্ত দূষকগুলি "অবিচ্ছেদ্য পর্যায়ে" নিচে স্থিত হয়ে গেছে এবং ৮০০-১০০০ বছর ধরে দ্রবীভূত হবে না।[১০]:৬৪ দুর্ঘটনার এক বছর পরে ঘোষণা করা হয় যে চেরনোবিল প্লান্টের শীতল পুকুরের জলও গ্রহণযোগ্য নিয়মের মধ্যে রয়েছে। তা সত্ত্বেও, দুর্যোগের দু'মাস পরে কিয়েভের জলের সরবরাহ নিপার থেকে দেশনা নদীর দিকে সরিয়ে দেওয়া হয়ে।[১০]:৬৪–৬৫

দুঘর্টনাপরবর্তী নিরাপত্তা ব্যবস্থা

সম্পাদনা

পারমাণবিক দূষণ থেকে পরিবেশকে সংরক্ষণ করতে একটি বিশাল কংক্রিটের খোলসের মধ্যে দুর্ঘটনাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া চতুর্থ পারমাণবিক চুল্লীটিকে ছয় মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ ভাবে ঢেকে ফেলা হয়। ওই অস্থায়ী নিরাপত্তাব্যবস্থাই এখন পর্যন্ত পারমাণবিক কেন্দ্রটির ধ্বংসাবশেষকে আটকে রাখার জন্য নির্মিত একমাত্র স্থাপনা। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, চেরনোবিলের ধ্বংসাবশেষে থাকা গলিত প্রায় ২০০ টন পরমাণু জ্বালানি থেকে যে ভয়াবহ তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়েছে তা হাজার বছরেও সম্পূর্ণ দূর হবে না। তাই এ পরমাণু জ্বালানি বাইরের পরিবেশের আওতামুক্ত রাখতে নতুন একটি নিরাপত্তা স্থাপনা নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। উচ্চাভিলাষী স্থাপনাটির নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে ১৬০ কোটি ইউরো বা ২২১ কোটি ডলার []

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "কী ঘটেছিল চেরনোবিলে?"দৈনিক কালের কণ্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ 
  2. গ্রীন ফ্যাক্টস
  3. "www.bengali.ruvr.ru"। ১২ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ মার্চ ২০১১ 
  4. "www.bengali.ruvr.ru"। ৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ মার্চ ২০১১ 
  5. গ্রীন ফ্যাক্টস
  6. Hallenbeck, William H (১৯৯৪)। Radiation Protection। CRC Press। পৃষ্ঠা 15আইএসবিএন 0-873-719-964Reported thus far are 237 cases of acute radiation sickness and 31 deaths. 
  7. Mould 2000, p. 29. "The number of deaths in the first three months were 31[.]"
  8. "দৈনিক প্রথম আলো"। ২০১৮-০৬-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০১-১২ 
  9. "3.1.5. Deposition of radionuclides on soil surfaces" (পিডিএফ)Environmental Consequences of the Chernobyl Accident and their Remediation: Twenty Years of Experience, Report of the Chernobyl Forum Expert Group 'Environment'। Vienna: International Atomic Energy Agency (IAEA)। ২০০৬। পৃষ্ঠা 23–25। আইএসবিএন 978-92-0-114705-9। সংগ্রহের তারিখ ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৩ 
  10. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; MarplesSocialImpact নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  11. Smith, Jim T.; Beresford, Nicholas A. (২০০৫)। Chernobyl: Catastrophe and Consequences। Berlin: Springer। আইএসবিএন 978-3-540-23866-9