চকবাজার অগ্নিকাণ্ড
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ঢাকায় চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেখানে একটি গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ হতে সৃষ্ট আগুন পার্শ্ববর্তী ভবনসমূহে ছড়িয়ে পড়ে এবং বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটার বিস্ফোরিত হয়ে এলাকাটি বিদ্যুৎ-সংযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দমকল বাহিনী পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলেও (সরকারি হিসাব মতে) ততক্ষণে ঘটনাস্থলে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৭৮ জন মারা যান।
তারিখ | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ |
---|---|
সময় | ১০.৩০ অপরাহ্ন |
অবস্থান | নন্দকুমার দত্ত সড়ক, চকবাজার, পুরান ঢাকা, বাংলাদেশ |
কারণ | গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ[১] |
নিহত | ৭৮[২] |
আহত | ৫২[১] |
অগ্নিকাণ্ড
সম্পাদনাকারণ
সম্পাদনাশিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজার থানার চুড়িহাট্টা মসজিদ সংলগ্ন আসগর লেন, নবকুমার দত্ত রোড ও হায়দার বক্স লেনের মিলনস্থলে একটি প্রাইভেটকারের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়।[৩] সেই আগুনে প্রাইভেটকারের কাছেই থাকা গ্যাস সিলিন্ডারবাহী একটি পিকআপের সিলিন্ডারসমূহও বিস্ফোরিত হয়; বিস্ফোরিত হয় পার্শ্ববর্তী খাবার হোটেলের গ্যাস সিলিন্ডার এবং রাস্তার বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটারও। পুরো এলাকা বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে নিকটস্থ রাজ্জাক ভবন, হাজী ওয়াহিদ ম্যানশনসহ পাঁচটি ভবনে। হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনে থাকা পারফিউমের গুদাম ও অন্যান্য দোকানে রাখা প্লাস্টিক গ্রেনুলারসমূহ দাহ্য পদার্থ হিসেবে আগুন ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে।[১][১][৩][৪] আরেকটি ব্যাখ্যা অনুসারে, মোড়ে থাকা একটি বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়।[৫] পরবর্তীতে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের করা তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলায় রাখা সুগন্ধির ক্যানগুলো থেকে কোনো কারণে বাতাসে বিস্ফোরক মিশ্রণ তৈরি হয়েছিল। বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ ওই মিশ্রণের সংস্পর্শে এসে বিস্ফোরণ ঘটে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। প্রতিবেদনটিতে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুনের সূত্রপাত হওয়ার বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে।[৬]
ঘটনাক্রম
সম্পাদনাঘনবসতিপূর্ণ ও সরু গলিপথের পুরান ঢাকায় দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে; নিকটস্থ এক কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ে উপলক্ষে সড়ক ছিল জনসমাগমপূর্ণ। আগুনে পথচারী ও রিকশাযাত্রীরাসহ ভবনগুলোর বাসিন্দারা অগ্নিকাণ্ডের শিকার হন। এর মধ্যে দমকল বাহিনীর ১০টি ফায়ারস্টেশনের ৩৭টি ইউনিট অগ্নিনির্বাপনের কাজ শুরু করে; ৪টি হেলিকপ্টারের মাধ্যমে আগুনলাগা ভবনগুলোতে পানি ছিটানো হয়। রাত ৩টার দিকে আগুন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আসে, তবে এরপরেও ছোটোখাটো বিস্ফোরণ হতে থাকে। পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১টায় ১৫ ঘণ্টাব্যাপী অগ্নিনির্বাপণ অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।[৩][৭][৮]
হতাহত
সম্পাদনাদমকলবাহিনী ঘটনাস্থল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ৭০টি লাশ প্রেরণ করে; আরো ১১টি লাশ বিভিন্নভাবে এসে পৌঁছায়। এছাড়া আহত অগ্নিদগ্ধ ৫২ জনের মধ্যে ৪১ জন প্রাথমিক চিকিৎসা নেন এবং ১১ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং হতাহতদের বেশির ভাগ লোক নোয়াখালী জেলার।[১][৩]
ক্ষয়ক্ষতি
সম্পাদনাঅগ্নিকাণ্ডে একাধিক হোটেল ও দোকানসহ পাঁচটি ভবন সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। পুড়ে যাওয়া ওয়াহিদ ম্যানশন ধ্বসে পড়ার সম্ভাবনা জানান বুয়েটের প্রকৌশলীগণ।[৯] এছাড়া ৪টি গাড়ি, ১৫টি মোটরবাইকসহ অনেকগুলো রিকশা, ভ্যান ও ঠেলাগাড়ি অগ্নিদগ্ধ হয়।[১০]
প্রতিক্রিয়া
সম্পাদনাঅগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক প্রকাশ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী উদ্ধার কার্যের তত্ত্বাবধান করেন বলে জানান ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন।[১১] বিএনপি অগ্নিকাণ্ডের জন্য 'সরকারের অব্যবস্থাপনা'কে দায়ী করে এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি শোকদিবস পালনসহ দুদিনের কর্মসূচী ঘোষণা করে।[১২][১৩]
অগ্নিকাণ্ডে হতাহতদের স্বজনদের তথ্য জানাতে বিশেষভাবে হটলাইন চালু করা হয়।[১৪]
অগ্নিকাণ্ডে আহতদের চিকিৎসার খরচ সরকার বহন করবে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।[১৫] পাশাপাশি শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে নিহত শ্রমিকদেরকে ১ লক্ষ এবং আহতদেরকে ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে বলে জানানো হয়।[১৬][১৭]
মেয়র সাঈদ খোকন পুরান ঢাকায় আর কোনো রাসায়নিক গুদাম রাখতে দেয়া হবে না এবং কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান।[১৮] পুলিশ মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারী জানান যে রাসায়নিক গুদাম সরাতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে পুলিশ সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছে।[১৭] তবে 'অর্থনৈতিক প্রবাহ' বজায় রাখতে পুরান ঢাকার রাসায়নিক ব্যবসা বন্ধ করা যাবে না বলে মন্তব্য করেন শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন।[১৯][২০] অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও ভবিষ্যতে অগ্নিকাণ্ড রোধে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১২ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়।[১]
২৫ ফেব্রুয়ারি, সোমবার এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়।[২১]
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ "কেমিক্যালের কারণে নয়, অগ্নিকাণ্ড গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে"। প্রথম আলো। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
- ↑ "ধুয়েমুছে সব সাফ করা হচ্ছে"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
- ↑ ক খ গ ঘ "চকবাজার অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে শিল্প মন্ত্রণালয়ের তদন্ত: যেভাবে আগুন লেগেছে পুরনো ঢাকার এই ব্যবসা কেন্দ্রে"। বিবিসি। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
- ↑ "যে গাড়ি থেকে চকবাজার মৃত্যুপুরী"। যুগান্তর। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
- ↑ "কীভাবে আগুনের সূত্রপাত?"। প্রথম আলো। ২০১৯-০২-২২। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০২-২২।
- ↑ "দোতলা থেকেই আগুনের শুরু"। প্রথম আলো। ৭ মার্চ ২০১৯।
- ↑ "Old Dhaka fire death toll jumps to 70"। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। ৯ জুন ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
- ↑ "চকবাজারে অগ্নিকাণ্ড: উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা"। বিডিনিউজ২৪.কম। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
- ↑ "যে কোন সময় ধ্বসে পড়তে পারে ওয়াহিদ ম্যানশন: বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল"। ইত্তেফাক। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
- ↑ "এক সার্জেন্টের অবিশ্বাস্য বেঁচে যাওয়া!"। প্রথম আলো। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
- ↑ "চকবাজার অগ্নিকাণ্ড: নির্ঘুম রাত কাটালেন প্রধানমন্ত্রী"। যুগান্তর। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
- ↑ "চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের পেছনে রয়েছে সরকারের দায়িত্বহীনতা: বিএনপি"। thedailystar.net। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
- ↑ "চকবাজার অগ্নিকাণ্ড ঘটনায় বিএনপির দুই দিনের কর্মসূচি"। যুগান্তর। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
- ↑ "চকবাজারে আগুন : তথ্য জানাতে হটলাইন চালু"। jagonews.con। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
- ↑ "অগ্নিকাণ্ডে আহতদের চিকিৎসার খরচ বহন করবে সরকার: জাহিদ মালেক"। ইত্তেফাক। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
- ↑ "চকবাজারে অগ্নিকাণ্ড : হতাহত শ্রমিকদের জন্য আর্থিক সহায়তার ঘোষণা শ্রম মন্ত্রণালয়ের"। নয়া দিগন্ত। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
- ↑ ক খ "চকবাজারে আগুনের পর কর্তৃপক্ষ যা বললেন..."। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০২-২২।
- ↑ "পুরান ঢাকায় আর কেমিকেল গোডাউন রাখতে দেওয়া হবে না: সাঈদ খোকন"। ইত্তেফাক। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
- ↑ "শিল্পমন্ত্রী: এখানে কেমিক্যালের কোনো অস্তিত্ব নেই, কোনো গোডাউনও ছিল না"। ঢাকা ট্রিবিউন। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "ঢাকা শহরটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবো নাকি?"। banglanews24.com। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
- ↑ "সোমবার এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- অগ্নিদগ্ধ এলাকার কিছু ছবি - প্রথম আলো।