পীর বড়খাঁ গাজী
পীর বড়খাঁ গাজী (গাজীবাবা, গাজী সাহেব, মোবারক শাহ গাজী, বরখান গাজী ইত্যাদি নামেও পরিচিত) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা অঞ্চলের তথা দক্ষিণ বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের অন্যতম প্রধান পীর। তাকে সুন্দরবনের ভাটি অঞ্চলের ব্যাঘ্রকুলের অধিষ্ঠাতা হিসাবে মান্য করা হয়।[১] এখানকার ক্যানিং থানার অন্তর্গত ঘুটিয়ারি শরীফে (মতান্তরে, বাংলাদেশের সিলেট জেলার শিবগাঁও গ্রামে বা গাজীপুরে[২]) গাজী সাহেবের কবরস্থান বর্তমান। এটি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল মানুষের তীর্থস্থান। উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা তথা দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে বড়খাঁ গাজীর একাধিক দরগাহ-নজরগাহ আছে। বিভিন্ন লোককাহিনীতে তাকে একজন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ইসলামধর্ম-প্রচারক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।[৩]
![](http://up.wiki.x.io/wikipedia/commons/thumb/d/df/Pir_Gazi_and_his_tiger_in_Sundarbans.jpg/220px-Pir_Gazi_and_his_tiger_in_Sundarbans.jpg)
পরিচয়
সম্পাদনালোককথা অনুযায়ী, বর্তমান দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বেলে-আদমপুর (মতান্তরে, বৈরাটনগর) গ্রামে তার জন্ম হয়। তিনি প্রথম যৌবনে পিতার অতুল ঐশ্বর্য ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য ফকিরি গ্রহণ করেন এবং ভাটি অঞ্চল সুন্দরবনে আসেন।[১] বন্ধু কালুর সহায়তায় বড়খাঁ গাজীর বিবাহ হয় বৃহত্তর যশোর জেলার ব্রাহ্মণনগরের হিন্দু রাজা মুকুট রায়ের কন্যা চম্পাবতীর সাথে। তার দুই পুত্র দুঃখী গাজী ও মেহের গাজী। অধুনা বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজারে আজও গাজী কালু ও চম্পাবতীর মাজার বর্তমান।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সোনারপুরে জঙ্গল কেটে বসতিও নির্মাণ করেছিলেন বড়খাঁ গাজী। নদী-জঙ্গল অধ্যুষিত এই অঞ্চলে বাঘ, কুমীর, সাপ ইত্যাদিকে যখন ইচ্ছা বশ করতে ও যুদ্ধের সৈনিক করতে পারতেন। রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্র সকলের উপর তার সমান প্রভুত্ব বর্তমান। কুমীর-দেবতা গাজি কালু তার বিশেষ বন্ধু।[৪]
অনেকের মতে, বড়খাঁ গাজী কারও ব্যক্তিগত নাম নয়, মধ্যযুগীয় বাংলায় ইসলাম প্রচারকদের শীর্ষস্থানীয়রাই বড়খাঁ গাজী নামে পরিচিত। একটি মতে, পাণ্ডুয়ার প্রসিদ্ধ পীর জাফর খাঁ গাজীর পুত্রই বড়খাঁ গাজী। সুকুমার সেনের মতে, চতুর্দশ শতকের পীর সুফি খানই ষোড়শ শতকে বড়খাঁ গাজী নামে পরিগণিত হন। তৃতীয় মতে, পঞ্চদশ শতকের পীর ইসমাইল গাজীই হলেন আলোচ্য বড়খাঁ গাজী।[১][৫]
খাড়িগ্রামের মূর্তি অনুযায়ী, তিনি যোদ্ধৃবেশী, অশ্বারূঢ় দৃপ্ত বীরপুরুষ; পরনে পায়জামা চোগাচাপকান পিরান, মাথায় টুপি, মুখে ঘন লম্বা দাড়ি, দীর্ঘ গোঁফ ও গালপাট্টা ঝুলফি, বড়-বড় টানা চোখ, একহাতে অস্ত্র এবং অন্যহাতে ঘোড়ার লাগাম; বুটজুতো সমেত পা-দুটো রেকাবের ওপর স্থাপিত।[৩]
গাজী পীরের বিভিন্ন উপাখ্যান
সম্পাদনালোককাহিনী অনুসারে, স্থানীয় হিন্দুদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে গিয়ে বহুবার হিন্দু দেবদেবীদের সঙ্গে তার বিরোধ ও সংঘর্ষ ঘটেছে। আঞ্চলিক প্রভুত্বের অধিকার নিয়ে সুন্দরবনের হিন্দু ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়ের সঙ্গে তার প্রবল যুদ্ধ হয়। লোককবি কৃষ্ণরাম দাসের 'রায়মঙ্গল'(১৬৮৬-৮৭ খ্রীষ্টাব্দ) কাব্যের কাহিনী অনুসারে, জগদীশ্বর হিন্দু-মুসলিমের মিলিত দেবতা অর্ধ-শ্রীকৃষ্ণ-পয়গম্বরের (কৃষ্ণপয়গম্বর) বেশধারণ করে গাজী ও দক্ষিণরায়কে শান্ত করেন। ফলে যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী, দক্ষিণরায় সুন্দরবনের সমস্ত ভাটি অঞ্চলের, কুমীর-দেবতা কালুরায় হিজলীর এবং গাজীসাহেব সর্বত্র শ্রদ্ধা-সম্মানের অধিকার লাভ করেন।[১]
সর্বত্র সাহেব পীর সবে নোয়াইবে শির
কেহ তাহে করিবে না মানা
'গাজীমঙ্গল' বা 'গাজীর গান' কাব্যে, যুদ্ধে দক্ষিণরায়ের পরাজয় দেখানো হয়েছে। এই কাব্যে গাজীর হাতে হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণের প্রয়াসও প্রকটরূপে উপস্থাপিত হয়েছে। তবে, আব্দুল গফুরের 'কালু গাজী ও চম্পাবতী' কাব্যে গঙ্গা-দুর্গা-পদ্মা-শিব সহ সমস্ত লৌকিক হিন্দু দেবদেবী বড়খাঁ গাজীর আত্মীয়বন্ধু হিসেবে পরিণত হয়েছে।
গঙ্গা দুর্গা শিব গিয়া সকলে করিত দয়া
গাজীর মাসী সকলে বলিত।
ঘুটিয়ারি শরীফ
সম্পাদনাঘুটিয়ারি শরীফে গাজী সাহেবের কবরস্থান বর্তমান। এটি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল মানুষের তীর্থস্থান। পুরুষ, নারী এমনকি হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা এখানে মানতের জন্য আসেন; তবে মহিলা ও হিজড়ারা মাজারে প্রবেশ করে না, পাশের জানালায় ধূপ-বাতি দেয়। গাজীকে জিন্দা পীর হিসাবে মানা হয়। ৭ই আষাঢ় পীরের মৃত্যুর দিন স্মরণ করে প্রতি বছর একসপ্তাহ ধরে বিশেষ উৎসব ও মেলা হয়। এছাড়া, ১৭ই শ্রাবণ থেকে উদযাপিত বিশেষ উৎসবে অনেক লোকসমাগম হয়। এইসময় নানা ইসলামিক গজল, কাওয়ালি, সুফি তারানা গাজীপীরের উদ্দেশ্যে গাওয়া হয়ে থাকে।
গাজীবাবার অলৌকিক ক্ষমতা সম্বন্ধে এখানে নানা প্রবাদ প্রচলিত আছে। একটি জনশ্রুতি অনুসারে, একবার এই অঞ্চলে খরা হওয়ায় লোকেরা গাজীবাবাকে বৃষ্টি আনিয়ে দিতে বলেন। গাজীবাবা সেই অনুরোধে সমাধিস্থ হন। তারপর একজন পাঠান মুসলমান গাজীবাবার সঙ্গে দেখা করতে এসে তাকে মৃত ভেবে ছুঁয়ে ফেলেন। তৎক্ষণাৎ দৈববাণী হয় যে, তিনি মৃত ছিলেন না, সমাধিস্থ ছিলেন। কিন্তু স্পর্শদোষ ঘটায় তার আত্মা পর্দানশীন হয় এবং যে কেউ ভাসাপুকুরে শিরনি দিয়ে মানত করলে তা পূরণ হবে। সেই দিনটি ছিল বাংলা বর্ষপঞ্জীর ৭ই আষাঢ়, অম্বুবাচী। সেই থেকে ঐ তারিখে এখানে তিনদিনের গাজীবাবার জাত বা মেলা, এবং ৪১ দিনের দিন ১৭ই শ্রাবণ উরস অনুষ্ঠান পালিত হয়।[২]
উৎসবের দিনগুলিতে জিয়ারতের সময় বারুইপুরের রায়চৌধুরী জমিদারবাড়ি থেকে আনা শিরনি, বাতি-আতর সর্বপ্রথমে গাজী পীরকে উৎসর্গ করা হয়। কথিত আছে, রায়চৌধুরী পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মদনমোহন রায়কে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর খাজনার দায় থেকে উদ্ধার করেছিলেন পীর বড়খাঁ গাজী। মেদিনীমল্ল পরগণার জমিদারি পেয়ে রায়চৌধুরীরা গাজীকে এখানে পীরোত্তর সম্পত্তি দান করেন। এখানে হিন্দুদের মতো মুসলমানদেরও গোমাংস-ভক্ষণ একেবারে নিষিদ্ধ।[৩]
এখানকার ভাসাপুকুর বা মক্কাপুকুরে নরনারীরা শিরনি হিসাবে ফুল-বাতাসা ভাসায়। যার হাতে শিরনি পুনরায় ভেসে আসে, তার মানত অচিরেই পূর্ণ হবে বলে ধরা হয়। এছাড়া, সন্তানের মানতকারীরা সন্তান হলে কচি শিশুকে সাজিয়ে ফুল-আতর দিয়ে মাটির হাড়িতে পুকুরের জলে ভাসিয়ে দেয় এবং বিশ্বাসমতো বাচ্চা হাড়িসহ আপনজনের কাছে শেষমেশ ফিরে আসে প্রতিবার। [২]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ঝাঁপ দিন: ক খ গ ঘ বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতি কোষ, ড. বরুণকুমার চক্রবর্তী, প্রথম প্রকাশ:১৯৯৫, পৃষ্ঠা: ২৫৫-২৫৬, ISBN 81-86036-13-X
- ↑ ঝাঁপ দিন: ক খ গ বাংলার লৌকিক ধর্মসংগীত, তৃপ্তি ব্রহ্ম, পৃষ্ঠা: ৩৬০-৩৬১
- ↑ ঝাঁপ দিন: ক খ গ ঘ ঘোষ, বিনয়, "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি", তৃতীয় খন্ড, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশ ভবন, পৃষ্ঠা: ২৪৫-২৫০
- ↑ যশোর খুলনার ইতিহাস-২য় খণ্ড, সতীশচন্দ্র মিত্র, দ্বিতীয় সংস্করণ, প্রকাশ: ২০১১, পৃষ্ঠা: ৪৪, ISBN 984715143
- ↑ বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ, দুলাল চৌধুরী, আকাদেমি অব ফোকলোর, কলকাতা: ৭০০০৯৪, প্রথম প্রকাশ:২০০৪, পৃষ্ঠা: ৪৯১