গঙ্গাঋদ্ধি
গঙ্গাঋদ্ধি, অন্যান্য নাম: গঙ্গাহৃদি/গঙ্গারিডি, গঙ্গারাঢ়ী, গঙ্গাহৃদয়, গঙ্গারিদই/গঙ্গারিডই (লাতিন: Gangaridae; গ্রিক: Γανγαρίδαι, "গঙ্গার সম্পদ"; Ganga Rashtra, "গঙ্গা নদীর জাতি"), খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ শতকের একটি অজ্ঞাত রাজ্য। ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ অঞ্চল বা বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এ রাজ্য বিস্তৃত ছিল বলে ধারণা করা হয়। গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস তার ইন্ডিকা নামক গ্রন্থে এই রাজ্যের উল্লেখ করেন।[১] গ্রিক ও লাতিন ঐতিহাসিকদের মতে, আলেকজান্ডার তার ভারতবর্ষ অভিযান থেকে সরে এসেছিলেন কারণ তাহলে তাকে গঙ্গাঋদ্ধি আক্রমণ করতে হতো। আলেকজান্ডার আশঙ্কা করছিলেন গঙ্গাঋদ্ধি সাম্রাজ্য আক্রমণ করার পরিণতি হবে ভয়াবহ। তবে এখন পর্যন্ত এই সাম্রাজ্য সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি।[২]
গঙ্গাঋদ্ধি | |||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ–অজানা | |||||||||
টলেমির মানচিত্রে গঙ্গাঋদ্ধি (Gangaridai) | |||||||||
অবস্থা | রাজ্য, সাম্রাজ্য | ||||||||
রাজধানী | গাঙ্গে, প্রাচীন বঙ্গদেশ | ||||||||
সরকার | রাজতন্ত্র | ||||||||
ঐতিহাসিক যুগ | প্রাচীন ভারত | ||||||||
• প্রতিষ্ঠা | খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ | ||||||||
• বিলুপ্ত | অজানা | ||||||||
| |||||||||
বর্তমানে যার অংশ | বাংলাদেশ ভারত |
নামের উৎপত্তি
সম্পাদনালাতিন Gangaridae বা ‘গঙ্গারিডই’ শব্দের উৎপত্তি 'গঙ্গারিড' থেকে। ধারণা করা হয়, গঙ্গারিড ভারতের গঙ্গাহৃদ বা গঙ্গাহৃদি শব্দের গ্রিক রূপ। অর্থাৎ গঙ্গা হৃদয়ে যার – "যে ভূমির হৃদয়ে বা বক্ষে গঙ্গা প্রবাহিত"। ঐতিহাসিক অতুল সুরের মতে, ‘গঙ্গাহৃদ’ থেকে ‘গঙ্গারিডি’ তার থেকে ‘গঙ্গারাঢ়ি’ ও তার থেকে 'রাঢ়' শব্দটি এসে থাকতে পারে।
অবস্থান
সম্পাদনাবিভিন্ন ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার প্রত্নস্থল চন্দ্রকেতুগড় সম্ভবত উল্লিখিত বিখ্যাত প্রাচীন বন্দর-রাজ্য 'গঙ্গারিদই'-এর রাজধানী বা 'গাঙ্গে' বন্দর। বিদ্যাধরী নদী সংলগ্ন এই প্রত্নস্থলটির সঙ্গে জলপথে প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল বিশেষত রোমের বাণিজ্যিক যোগসূত্রের সুনিশ্চিত প্রমাণ মিলেছে। [৩] বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার প্রত্নস্থল উয়ারী-বটেশ্বর কে গঙ্গাঋদ্ধি রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[৪][৫]
ধ্রুপদী গ্রিক ও ল্যাটিন ঐতিহাসিকগণ গঙ্গাঋদ্ধি রাজ্যের বিবরণ দিয়েছেন।
‘গঙ্গা নদী উত্তর হতে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত এবং গঙ্গারিডই রাজ্যের পূর্ব সীমানায় সমুদ্রে মিলিত হয়েছে।’ – মেগাস্থিনিস
‘গঙ্গা নদীর মোহনায় সমুদয় এলাকা জুড়ে গঙ্গারিডই রাজ্য’ – টলেমি
‘গঙ্গারিডই রাজ্যের ভিতর দিয়ে গঙ্গা নদীর শেষ অংশ প্রবাহিত হয়েছে’ – প্লিনি
টলেমি (২য় খ্রিষ্টাব্দে) গঙ্গারিডাই এর অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন যে, “গঙ্গার পাঁচটি মুখ সংলগ্ন প্রায় সমুদয় এলাকা গঙ্গারিডইগণ দখল করে রেখেছিল, ‘গাঙ্গে’ নগর ছিল এর রাজধানী।”
তার বর্ণনাকৃত চারটি দ্রাঘিমা ডিগ্রি সমুদ্র উপকূলের সবচেয়ে পশ্চিম থেকে সবচেয়ে পূর্ব নদীমুখ পর্যন্ত অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করছে। কার্যত এর অর্থ হলো ‘গঙ্গারিডই’ বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী গঙ্গার সবচেয়ে পশ্চিম এবং সবচেয়ে পূর্ব নদীমুখ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো যে, ভাগীরথীর (তমলুক এর নিকটে) এবং পদ্মার (চট্টগ্রামের নিকটে) নদীমুখের দ্রাঘিমা রেখার পার্থক্য ৩৫ ডিগ্রির সামান্য কিছু বেশি। তাই টলেমির তথ্যানুযায়ী গঙ্গারিডই-কে শনাক্ত করা যায় বর্তমান ভারতের পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশে গঙ্গার প্রধান দুটি শাখার মধ্যবর্তী অঞ্চলটিতে।
‘গঙ্গারিডই' রাজ্য ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশের বাঙলা অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস তার 'ইন্ডিকা' গ্রন্থে এটা বর্ণনা করেছেন। ধ্রুপদী গ্রিক এবং ল্যাটিন ঐতিহাসিকদের বর্ণনানুযায়ী আলেকজান্ডার দি গ্রেট বাংলায় অবস্থিত এই গঙ্গারিডির লোকেদের পরাক্রমের কাহিনী শুনে শঙ্কিত হয়ে যমুনার পশ্চিম পাড় থেকেই ফেরৎ চলে যান।
একজন[কে?] গ্রিক নাবিক তার Periplous tes Erythras Thalasses (Periplus Maris Erythraei) গ্রন্থে বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন উড়িষ্যা উপকূলের পূর্বে অবস্থিত গাঙ্গে দেশের কথা উল্লেখ করেছেন। নদী তীরে নদীর নামে গাঙ্গে ছিল একটি বাণিজ্য শহর। এটা স্পষ্ট যে টলেমির ‘গঙ্গারিডই’ এবং পেরিপ্লাস গ্রন্থের লেখকের ‘গাঙ্গে দেশ’ বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত একই এলাকাকে ইঙ্গিত করছে। কালিদাসের 'রঘুবংশম্'-এ বঙ্গের যে বিবরণ পাওয়া যায় তাও অভিন্ন অর্থ বহন করে।[৬]
ঐতিহাসিক সূত্র
সম্পাদনাপ্রখ্যাত ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তার বাঙালির ইতিহাস (আদি পর্ব) গ্রন্থে লিখেছেন- "গঙ্গারিডাই-রা যে গাঙ্গেয় প্রদেশের লোক এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই, কারণ গ্রিক লাতিন লেখকরা এ সম্বন্ধে একমত।"[৭] দিওদোরাস-কার্তিয়াস-প্লুতার্ক-সলিনাস-প্লিনি-টলেমি-স্ত্রাবো প্রভৃতি লেখকদের প্রাসঙ্গিক মতামতের তুলানামূলক বিস্তৃত আলোচনা করে হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী দেখিয়েছেন যে গঙ্গারিডই বা গঙ্গারাষ্ট্র গঙ্গা-ভাগীরথীর পূর্বতীরে অবস্থিত ও বিস্তৃত ছিল।
বিভিন্ন বিদেশি লেখকদের বর্ণনায় গঙ্গাঋদ্ধি
সম্পাদনাবিভিন্ন বিদেশি লেখকদের বর্ণনাতেই গঙ্গাঋদ্ধি সম্মন্ধে জানা গেছে। তবে তাদের বর্ণনার অধিকাংশই শ্রবণের উপর নির্ভর করে লেখা হয়েছিল।
গ্রিক লেখকদের বর্ণনা
সম্পাদনাদিওদোরাস
গঙ্গাঋদ্ধি সম্পর্কে সর্বপ্রথম বর্ণনা পাওয়া যায় গ্রিক লেখক দিওদোরাস সিকিউলাসের লেখায়। খ্রিস্টপূর্ব ১ সালে তার Biblotheca Historica বইটিতে তিনি গঙ্গাঋদ্ধির কথা উল্লেখ করেন।
মেগাস্থিনিস
গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস তার ইন্ডিকা নামক গ্রন্থে এই রাজ্যের উল্লেখ করেন। এখন পর্যন্ত গঙ্গাঋদ্ধির যতটুকু বর্ণনা পাওয়া গেছে, তার অধিকাংশই মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা গ্রন্থ থেকে।[১]
টলেমি
গ্রিক লেখক টলেমি দ্বিতীয় খ্রিষ্টাব্দে তার Geographia বইয়ে গঙ্গাঋদ্ধির নাম উল্লেখ করেন। এখানেই তিনি সর্বপ্রথম 'গাঙ্গে' এর নাম উল্লেখ করেন।
প্লুটার্ক
গ্রিক লেখক প্লুটার্ক তার Parallel Lives বইটিতে গঙ্গাঋদ্ধির নাম উল্লেখ করেন।
রোমান লেখকদের বর্ণনা
সম্পাদনাভার্জিল
প্লিনি
কার্টিয়াস রুফাস
আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানকালে
সম্পাদনাআলেকজান্ডার ও তার সৈন্যবাহিনীর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দিওদোরাস (৬৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ-১৬ খ্রিষ্টাব্দ) সিন্ধু পরবর্তী দেশ সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, গঙ্গা পেরিয়ে যে অঞ্চল সেখানে ‘প্রাসিয়ই' ও গঙ্গারিডইদের আধিপত্য। তবে একথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, খ্রিষ্টের জন্মের পূর্বে অথবা অব্যবহিত পরে কয়েক শতকে গ্রিক ও ধ্রুপদী লাতিন লেখকদের বর্ণনার সাথে মিলে এমন কোন সামরিক শক্তিসম্পন্ন রাজ্যের সুনির্দিষ্ট অস্তিত্ব স্থানীয় কোন উৎসের ভিত্তিতে নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। উল্লেখ করা হয়েছে যে, চতুর্থ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গঙ্গারিডইয়ের রাজা অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। তার ৬০ হাজার পদাতিক, ১ হাজার অশ্বারোহী ও ৭ শত হস্তি বাহিনী ছিল। প্রাপ্ত তথ্য এ বিষয়ে ইঙ্গিত দেয় যে, পাশ্চাত্যের দূরবর্তী দেশগুলি পরবর্তী ৫০০ বছর তাদের নাম ও যশ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল।
উগ্রসেন ও মহাপদ্ম নন্দের সময়
সম্পাদনাপ্লিনির মতে ‘গঙ্গারিডই' রাজ্যের ভিতর দিয়ে গঙ্গা নদীর শেষ অংশ প্রবাহিত হয়েছে।
“ | গঙ্গার শেষ অংশের প্রস্থ ৮ মাইল, এবং যেখানে এটি সবথেকে কম প্রস্থের সেই স্থানে এর গভীরতা প্রায় ১০০ ফুট। সেই মানুষরা যারা সেই সুদুর প্রান্তে থাকেন তারা হলেন গঙ্গারিডাই। এদের রাজার ১০০০ অশ্বারোহী, ৭০০ হস্তি এবং ৬০০০০ পদাতিক সৈন্য নিয়ে সজ্জিত সেনাবাহিনী আছে। --- মেগাস্থিনিস | ” |
উৎস
সম্পাদনা- ↑ ক খ ইন্ডিকা - মেগাস্থিনিস
- ↑ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বই "গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ", লেখক বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
- ↑ Dr. Gaurishankar de & Prof. Subhradip de, Prasanga: Pratna-Prantar Chandraketugarh, First Edition: 2013, আইএসবিএন ৯৭৮-৯৩-৮২৪৩৫-০০-৬
- ↑ Enamul Haque (২০০১)। Excavation at Wari-Bateshwar: A Preliminary Study। International Center for Study of Bengal Art। আইএসবিএন 978-984-8140-02-4।
- ↑ "History"। Banglapedia। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
Shah-i-Bangalah, Shah-i-Bangaliyan and Sultan-i-Bangalah
- ↑ ভারতবর্ষের ইতিহাস (প্রাচীন ভারত) - গ্রিগোরি বোন্গার্দ লেভিন। প্রগতি প্রকাশন, মস্কো
- ↑ বাঙালির ইতিহাস (আদি পর্ব) - নীহারঞ্জন রায়। দে’জ পাবলিশিং - কলিকাতা
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা