খসড়া:সংস্কৃতিক রূপান্তর

 সাংস্কৃতিক অনুবাদ

সম্পাদনা

সাংস্কৃতিক অনুবাদ হল অনুবাদ চর্চার সেই দিক যা অনুবাদের ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে মাথায় রাখে। এই ধরণের অনুবাদ সাধারণত সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গে, যেমন উপভাষা, খাদ্য অথবা স্থাপত্য সম্পর্কিত বিষয়ের অনুবাদের সময় সমস্যার আলোচনা করে।

সাংস্কৃতিক অনুবাদ যে প্রধান সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করে তা হল পাঠ্যের অনুবাদের ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে তুলে ধরা এবং পাশাপাশি উৎস সংস্কৃতিকে সম্মান করা।

সংস্কৃতির অনুবাদ

সম্পাদনা

সাংস্কৃতিক অনুবাদ বিষয়টি সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান এর সাহায্যে অধ্যয়ন করা হয়। সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞানের একটি ক্ষেত্র যা মানবজাতির সাংস্কৃতিক বিষয়গুলির ওপর দৃষ্টিপাত করে। এই অধ্যয়ন ক্ষেত্র অনুবাদের ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে প্রশ্ন করে। বস্তুত, অনুবাদ বিদ্যা শুধুমাত্র ভাষাকেন্দ্রিক সমস্যা নিয়ে নয়, মানবজীবনের সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ নিয়েও আলোচনা করে।

সংস্কৃতির নৃতাত্ত্বিক অনুবাদকএর কাজ হল উৎস এবং অভীষ্ট ভাষার পার্থক্যগুলিকে নিয়ে চর্চা করা। অর্থাৎ, তাকে একই সময়ে উৎস সংস্কৃতির দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভীষ্ট সংস্কৃতির কথা মাথায় রাখতে হবে। উইলহেম ভন হাম্বল্ড ১৭৯৬ সালের ২৩শে জুলাই এ ডব্লিউ শ্লেগেল কে লেখা চিঠিতে অনুবাদ এর বিষয়ে এই মন্তব্য করেন: “আমার মনে হয় সব ধরনের অনুবাদ একটি অসম্ভব কাজকে সম্বভ করার চেষ্টা মাত্র। প্রত্যেক অনুবাদক দুইটি অসুবিধার মধ্যে যে কোনও একটির দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন: হয় তিনি নিজ জাতির রুচি ও ভাষার বদলে মূল পাঠ্যের খুব কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন, অথবা তিনি মূল পাঠ্যের মূল্যে নিজ জাতির বৈশিষ্ট্যগুলিকে তুলে ধরেন। এই দুইয়ের মধ্যবর্তী পন্থা শুধুমাত্র কঠিন নয়, একেবারে অসম্ভব।”[]

সংস্কৃতির অনুবাদ এর প্রতি সংশয়বাদ

সম্পাদনা

কিছু নৃতাত্ত্বিক সংস্কৃতির অনুবাদ এর প্রতি আপত্তি পোষণ করে থাকেন। এই গবেষকদের মতে, সংস্কৃতির জন্য একটি নির্দিষ্ট সমন্বয় দরকার যা মানুষের চিন্তাভাবনা এবং কাজে পাওয়া যায়। এই ক্ষেত্রে, সাংস্কৃতিক অনুবাদকএর পাঠ্যের অন্তর্নিহিত শিক্ষার তুলনায় অধিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

এছাড়াও, সংস্কৃতির অনুবাদ দুই সংস্কৃতির মধ্যে সমকক্ষতা বজায় রাখতে পারে না। কারণ, কিছু সংস্কৃতি অপর সংস্কৃতির অপেক্ষা অধিক প্রভাবশালী হওয়ায় ক্ষমতা সংস্কৃতির অনুবাদ এর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা হিসাবে কাজ করে। প্রকৃতপক্ষে, পাঠকদের সংস্কৃতির কথা মাথায় রেখে পাঠ্যকে বোধগম্য করার জন্য সংস্কৃতির অনুবাদ এর সময় অভীষ্ট ভাষা উৎস সংস্কৃতির উপর অধিক প্রাধান্য স্থাপন করতে পারে। সংস্কৃতির অর্থ বোঝা বেশ কঠিন, এজন্য সংস্কৃতির অনুবাদ নিশ্চিতভাবেই সীমাবদ্ধ। এই কারণে ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে সীমারেখা বর্তমান যেগুলি খুঁজে বের করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সংস্কৃতির অনুবাদ এর ক্ষেত্রে এই সীমাবদ্ধতার কথা আমেরিকান ভাষাবিদ ও নৃতত্ত্ববিদ এডওয়ার্ড সাপিরও ব্যক্ত করেছেন: “ভিন্ন সমাজ যে ভিন্ন জগতে বসবাস করে সেগুলি শুধুমাত্র একই জগতের ভিন্ন নাম নয়, সেগুলো  প্রত্যেকে এক এক স্বতন্ত্র জগৎ”।[] “প্রত্যেক ভাষাগত সম্প্রদায়ের জগৎ সম্পর্কে নিজ দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান, যেটি অন্য সম্প্রদায়ের থেকে ভিন্ন। এটি ভাষার নিরিখে ভিন্ন জগতের অস্তিত্ব এর ওপর আলোকপাত করে”।

কিছু ভাষাবিদ মনে করেন অঅনুবাদযোগ্যতা শুধুমাত্র ভাষাগত সীমাবদ্ধতার জন্যই নয়, বরং সাংস্কৃতিক সীমারেখার জন্যও তৈরি হয়। কিছু ভাষাবিদ, যেমন সি এল রেন, এর মতে, মানুষের মধ্যের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য সাংস্কৃতিক অনুবাদযোগ্যতার উপর তুলনামূলক সংকীর্ণ সীমা আরোপ করে।কিছু গবেষক, যেমন আঁদ্রে মার্টিনেট,সর্বজনীন অনুবাদযোগ্যতার তত্ত্ব অনুমোদন করতে অস্বীকার করে থাকেন। তাঁদের মতে, মানব অভিজ্ঞতা সঠিকভাবে প্রকাশ করা যায় না কারণ এটি অনন্য। ক্যাটফোর্ড, তাঁর "Linguistic Theory of Translation" (‘অনুবাদের ভাষাগত তত্ত্ব’) বইয়ে এই তত্ত্বটি যুক্তিসহকারে বোঝান: “সাংস্কৃতিক অঅনুবাদযোগ্যতা দেখা যায় যখন একটি অবস্থানগত বৈশিষ্ট্য, যেটি উৎস ভাষার পাঠ্যের জন্য কার্যকরীভাবে প্রাসঙ্গিক, সেটি অভীষ্ট ভাষার সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। যেমন, কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম, পোশাক, খাদ্য, এবং বিমূর্ত ধারণা, ও আরও অন্যান্য বিষয়ে”।[]

অ্যান্টন পোপোভিক এও মনে করেন যে ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক অঅনুবাদযোগ্যতার ক্ষেত্রে পার্থক্য বিদ্যমান। এই ধারণাকে তিনি তাঁর “A Dictionary for the Analysis of Literary Translation” (‘সাহিত্য সংক্রান্ত অনুবাদের অভিধান’) সমর্থন করে বলেন: “এটি একটি পরিস্থিতি যেখানে ব্যক্তার্থ ও জাত্যর্থের অভাবের ফলে উৎসের ভাষাগত উপাদানগুলিকে কাঠামোগত, রৈখিক, অথবা শব্দার্থিক পরিভাষার মাধ্যমে পর্যাপ্তভাবে বদল করা সম্ভব হয় না”।

ফলস্বরূপ, বিশ্ব ইতিহাসে কিছু সংস্কৃতির প্রাধান্য সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, যে সময় উপনিবেশবাদ বিভিন্ন ভূখণ্ডে একটি প্রধান ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠা করে। বস্তুত, কিছু সংস্কৃতিকে অবিমিশ্র এবং বিশ্বের কার্যকারিতার একমাত্র সত্তা হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছিল। এছাড়াও, সংস্কৃতির অনুবাদ অন্যান্য সমস্যার সৃষ্টি করে, যেমন সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব এবং ঐতিহাসিক পরিবর্তন।

একটি দ্বিজাতীয় প্রক্রিয়া

সম্পাদনা

স্পষ্টতই অনুবাদ আদান-প্রদান, স্থানান্তর এবং গতিশীলতার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, যা হল বিশ্বায়নের অন্তঃসার। এজন্য, এই অধ্যয়ন ক্ষেত্র একটি দ্বিজাতীয় প্রক্রিয়া উপস্থাপন করে। এটি হল অতিজাতীয় (সীমারেখা ছাড়িয়ে) এবং অনুবাদমূলক (অনুবাদের বিনিময়) ধারণা। এই দ্বিজাতীয় প্রক্রিয়া উৎস এবং অভীষ্ট ভাষার মধ্যেকার বিভেদ প্রত্যাহার করে এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্য আলোচনা করতে সক্ষম করে।

এইরূপ বিশ্বব্যাপী ‘পার্থক্যের মধ্যস্থতা’[] বিশেষত উত্তরঔপনিবেশিক পরিবেশে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এটিকে ‘বিপ্রসঙ্গীকরণ ও পুনঃপ্রসঙ্গীকরণ এর পদ্ধতির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক পার্থক্যের সম্পাদিত মধ্যস্থতা’[] হিসাবে দেখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে, অনুবাদকের প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত অনুবাদের উৎস এবং অভিষ্টের মধ্যে ‘ধারণাগত সাম্য’[] খুঁজে বের করা।

সংস্কৃতি ও সভ্যতা

সম্পাদনা

সাংস্কৃতিক অনুবাদ স্পষ্টতই সংস্কৃতির ধারণা ইঙ্গিত করে। সাংস্কৃতিক অনুবাদ পদটি বোঝার ক্ষেত্রে সংস্কৃতির অর্থ নির্ধারণ করা দরকার। সংস্কৃতি দুটি ভিন্ন অর্থ প্রদান করে: প্রথম সংজ্ঞা অনুযায়ী সংস্কৃতি বলতে উন্নত রাষ্ট্রের সভ্য সমাজকে বোঝায়, দ্বিতীয়টি সংস্কৃতিকে মানুষের সমগ্র আচার আচরণের অংশ এবং জীবনযাপনের পদ্ধতি হিসাবে গণ্য করে। পূর্ব আলোচনার সাপেক্ষে, অনুবাদের ক্ষেত্রে সংস্কৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং অর্থ পেয়ে থাকে। কাতান এর মতে, সংস্কৃতি হলো বিশ্বের অংশগ্রহণীয় আদর্শ, বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও কৌশলের অনুক্রমিক রকম যেটি মানুষের মধ্যে ক্রিয়া ও আলাপ আলোচনাকে পথপ্রদর্শন করে। বিভিন্ন উপায়ে যেমন শিক্ষার মাধ্যমে সংস্কৃতি অর্জন করা যায়।

সভ্যতা শব্দটিকে উন্নত সমাজের প্রতিরূপ হিসাবে ব্যক্ত করা যেতে পারে যা মানুষের মাধ্যমে নিজ সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে সক্ষম। এই ধারণা অনুসারে, অনুবাদক সংস্কৃতির বিকাশের সমস্যার সমাধান করে পাঠ্যের অনুবাদ করতে পারেন। এক্ষেত্রে, নিউমার্ক নিশ্চিতভাবে বলেন যে অনুবাদ সাংস্কৃতিকভাবে মূল্যবান, অর্থাৎ অনুবাদ সমগ্র বিশ্বের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়। সভ্যতা যেহেতু যোগাযোগের সুস্পষ্ট উপায়, যেমন বর্ণমালা, অভিধান, তৈরি করে এবং ভাষা ও সাহিত্যের অপরুপ বিকাশ ঘটায়, এই প্রক্রিয়া সাংস্কৃতিক অনুবাদের ক্ষেত্রে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করে।

আদর্শগত দিক থেকে রাষ্ট্রের সমাজ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব বিদ্যমান। অনুবাদ গবেষক যেমন ইভেন-জোহার, সুসান বাসনেট ও ত্রিবেদী এর মতে, সংস্কৃতি ক্ষমতার অভিলাষ এবং লোকেরা যেভাবে এই ক্ষমতা দাবি করে থাকে তার সঙ্গেও যুক্ত। এই অর্থে, অনুবাদ পাঠকদের কাছে মতাদর্শগত পদ্ধতিগুলি বোধগম্য করার ভূমিকা পালন করে থাকে। এজন্য সংস্কৃতির অনুবাদ নীতিবিদ্যার সাথে যুক্ত, এবং এটি নতুন চিন্তাপদ্ধতির ব্যাখ্যা করে থাকে। এই ধরনের অনুবাদের ক্ষেত্রে অনুবাদিত পাঠ্যের মাধ্যমে প্রসঙ্গ ও ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা প্রদর্শন করা আবশ্যক।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Blakesley, Jacob (২০১৪)। Modern Italian Poets: Translators of the Impossible.। University of Toronto Press। পৃষ্ঠা 28। আইএসবিএন ISBN 9781442646421 |আইএসবিএন= এর মান পরীক্ষা করুন: invalid character (সাহায্য) 
  2. Sapir, E. (১৯২৯)। [doi:10.2307/409588. hdl:11858/00-001M-0000-002C-4321-4. JSTOR 409588 "The Status of Linguistics as a Science"] |ইউআরএল= এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)Language। 5 (4): 209। 
  3. Catford, John Cunnison (১৯৬৫)। Linguistic Theory of Translation। Oxford University Press। এএসআইএন B000Y4JLOI ASIN B000Y4JLOI |asin= এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য) 
  4. Bhabha, Homi K (২০০৪)। The Location of Culture। Routledge। 
  5. Rössner, Italiano (২০১২)। Translatio. Narration, Media and the Staging of Differences 
  6. Birbili, Maria (Winter ২০০০)। "Translating from one language to another"Social Research Update। Department of Sociology, University of Surrey। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১২-০৯